বেলায়েত হুসাইন
এ যেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা-পঙ্তি ‘জাহান্নামের আগুনে বসে পুষ্পের হাসি’র জ্বলন্ত উদাহরণ। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকাকে আক্ষরিক অর্থে দখলদার ইসরায়েল একটি ‘জাহান্নামে’ রূপান্তরিত করেছে। প্রতিদিন ইসরায়েলি বাহিনীর ছোড়া বোমা, বিষাক্ত গ্যাস ভর্তি ক্যান গাজা উপত্যকায় উড়ে আসাটা স্বাভাবিক ঘটনা।
যুগের পর যুগ ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের এই অমানবিক নিগ্রহে এখানের অসংখ্য নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু এরপরেও থেমে নেই গাজাবাসীর জীবনযাপন।
অসহ্য নির্যাতনের মধ্যেও তারা প্রতিনিয়ত শান্তির বার্তা দিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন-ই কিছু স্থিরচিত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে-যেখানে দেখা যাচ্ছে-ইসরায়েলের ছোড়া প্রাণনাশী বোমার খোসায় সবুজ প্রাণের ছোঁয়া দিচ্ছেন আবদুল করিম আবু আতায়া নামের ফিলিস্তিনি এক হস্তশিল্পী। বোমা ও গ্যাসের খোসাগুলোতে তিনি ফুল গাছ সহ নানা ধরণের উদ্ভিদ রোপন করছেন।
তা ছাড়া সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন শৈল্পিক পণ্যও বানাচ্ছেন তিনি। গাজার একজন বাসিন্দা হিসেবে নিশ্চিতভাবে আবদুল করিমকেও প্রতিদিনই এ আশঙ্কায় থাকতে হয় যে, এই বুঝি ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ গেল! এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও তার এ শান্তির বার্তা বিশ্বব্যাপী বেশ প্রশংসা কুড়াচ্ছে। বোমা কিংবা গ্যাসের ক্যানের উপরের অংশ কেটে তার মধ্যে মাটি ভরে, গাছের বীজ ও চারা রোপন করেন তিনি। বোমার ছোট ছোট অংশ দিয়ে তিনি তৈরি করেন তসবিহ।
কিছু অংশ ব্যবহার করেন জায়নামাজ তৈরির কাজে। সীমান্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে তিনি এসব সংগ্রহ করেন। ৩৬ বছর বয়সী আব্দুল করিম আবু আতায়া বলেন, ‘ইসরায়েলি বাহিনী আমাদের ওপর বোমা, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে নিয়মিত।
হামলার পর এগুলোর খোসা পড়ে থাকে, আমি চিন্তুা করলাম এগুলো দিয়ে কিছু বানানো যায় কিনা-সেই চিন্তা থেকেই এগুলো দিয়ে গাছের টব, ফুলদানি, জায়নামাজ ও তসবিহ বানাতে শুরু করলাম।’ মাতৃভূমিতে ফেরার আন্দোলন ‘গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন’ কর্মসুচিতে নিয়মিতই অংশ নেন তিনি। ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় কয়েক শ নাগরিক নিহত হয়েছে।
এরইমধ্যে আবু আতায়ার পুরনো এ ছবিগুলো অনলাইন প্লাটফর্মে ভাইরাল হলো। আবু আতায়া বলেন, যুদ্ধের উপকরণ দিয়ে শিল্পকর্ম বানিয়ে আমি বিশ্ববাসীকে ‘জীবন ও শান্তির’ বার্তা দিতে চাই।
তারা আমাদের প্রাণ কেড়ে নিতে এসব ছুড়লেও আমি চাই সেগুলোকে নান্দনিক শিল্পকর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে।’ মিডল ইস্ট মনিটরকে আবু আতায়া বলেন, ‘শিল্পকর্মগুলোর মাধ্যমে আমাদের দেশের পক্ষ থেকে ভালোবাসা আর জীবনের বার্তা পৌঁছে দিতে চাই এবং এও জানাতে চাই যে, আমরা উত্তরাধিকার সূত্রেই এই ভূখণ্ডের মালিক। এখান থেকে আমাদের পূর্বসূরীদের তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দখলদার বাহিনী মনে করছে, বৃদ্ধরা মারা যাবে আর তরুণরা ভুলে যাবে সেসব কথা।
কিন্তু তা নয়। আমার কোন কিছুই ভুলি না, স্মরণ করি অতীতের কথা এমনকি আমাদের নানা-দাদাদের চেয়েও বেশি।’ শত্রুর বারুদে ফুল ফুটিয়েও যে কার্যকর প্রতিবাদ করা যায়- নারীদের মধ্যে এটি সর্বপ্রথম দেখান নুর-ই-ফাতিমা কাওমি নামের আরেক ফিলিস্তিনি নারী।
রামাল্লাহর এ নারী ২০২০ সালে বোমার খোসায় ফুল গাছ লাগিয়ে বিশ্ববাসীর নজর কাড়েন তিনি। করুণার প্রতীক নুর-ই-ফাতিমা কাওমি বিশ্বাস করেন, যদিও মরণাস্ত্রগুলো তৈরিই হয়েছে মানুষের অস্তিত্ব বিনাশের জন্য; এরপরেও প্রচণ্ড ভালোবাসা আর গভীর আবেগ দিয়ে বোমার খোসায় ফুল ফোটাই। পৃথিবীতে এই যে এতো রঙ, এতো বর্ণের মানুষ; তাদের বেঁচে থাকাই পৃথিবীর আসল সৌন্দর্য। সূত্র: আলজাজিরা স্টোরিজ ও আল খালিজ অনলাইন
-এটি