।।রাবেতা হক।।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে সময়ের ব্যবধানে আমরা মাহে রমযানের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। রহমত বরকত ও কল্যাণে ভরপুর এ মাসের আগমনে মুমিন-হৃদয় আনন্দিত হয়। কারণ, গোটা মাসকে আল্লাহ পাক এমন কিছু নিয়ামত ও ইবাদতের দ্বারা সজ্জিত করেছেন, যা অন্য সময় করার বা পাওয়ার অবকাশ নেই। তাই খাঁটি মুমিন বান্দা রমযানের বিদায়ান্তে তার ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে ভারাক্রান্ত হয়। এজন্য দয়াময় আল্লাহ তা'লা তা ঘুচানোর সুযোগ দিয়ে রমযানের সর্বশেষ ইবাদত হিসেবে যাকাতুল ফিতরকে ধার্য করেছেন, যা আমরা সদকায়ে ফিতর বলে জানি। রমযানের শেষে সামর্থ্যবান রোযাদারের ওপর তা আদায় করা আবশ্যক।
কেন সাদকায়ে ফিতর দিতে হবে:
প্রথমত- রোজা রাখার ক্ষেত্রে রোজাদারের যে অসঙ্গতি ও ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে, তা ঘুচিয়ে রোজাকে পূর্ণতা দান করা।
দ্বিতীয়ত- অসহায় ও মিসকিনদের খাবারের ব্যবস্থা করা, যাতে ঈদের খুশিতে তারাও সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।
তৃতীয়ত- এ পর্যন্ত আল্লাহ পাক নেয়ামত রাজি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার কারণে শরীরের হকস্বরূপ তা আদায় করা।
আর এ কারণেই তা নাবালেগ সন্তানের পক্ষ থেকেও আদায় করতে হয় যদিও তার ওপর রোজা ফরজ নয়।
চতুর্থত- রোজা রাখার শক্তি দিয়ে আল্লাহ পাক যে দয়া করেছেন তার শোকর আদায় করা।
হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সদাকায়ে ফিতরের বিধান ধার্য করেছেন রোজাদারকে অর্থহীন ও অশ্লীল কথা-কাজ থেকে পবিত্র করার জন্য এবং মিসকিনদের খাবারের ব্যবস্থা স্বরূপ। যে ব্যক্তি তা (ঈদের) নামাজের আগে আদায় করবে তা গ্ৰহণযোগ্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে আর যে নামাজের পর আদায় করবে তা সাধারণ (নফল) সদকা হিসেবে বিবেচিত হবে। (সুনানে আবু দাউদ-১৬০৯)
উল্লেখ্য যে, ঈদের দিন সুবহে সাদেকের সময় যার কাছে মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে ৫২ তোলা রূপার মূল্য পরিমাণ সম্পদ (প্রায় পঞ্চাশ/পঞ্চান্ন হাজার টাকা) থাকে তার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। তাই মুসলিম নর-নারী, বালেগ-নাবালেগ, স্বাধীন-দাস এই ছয় শ্রেণির মানুষ তা আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রত্যেকে নিজের ও নাবালেগ সন্তানেরটা আদায় করবে। অবশ্য বালেগ সন্তান ও মা-বাবার পক্ষে থেকেও চাইলে আদায় করতে পারে।
ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসুল সা. সদকাতুল ফিতর আবশ্যক করেছেন। এর পরিমাণ হলো, এক সা যব বা এক সা খেজুর। ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন সামর্থ্যবান সবার ওপরই এটা আবশ্যক। (বুখারি, হাদিস নং : ১৫১২)
ঈদের চাঁদ উদিত হওয়ার পরপরই সদকায়ে ফিতর দেয়া ওয়াজিব হয়। কারণ, ফিতর অর্থ রোজা খোলা, ভাঙ্গা। তাই রোজা ভাঙ্গার পর থেকে ঈদের নামাজের আগে তা আদায় করা মুস্তাহাব। অবশ্য আগে আদায় করাও জায়েয আছে।
বি.দ্র. কোনো গরিব লোক একাধিক ফিতরা পাওয়ার কারণে তার কাছে যদি ফিতরা ওয়াজিব হওয়া পরিমাণ সম্পদ এসে যায়, তবে তাকেও ফিতরা দিতে হবে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সে সর্বনিম্ন মূল্য দিয়ে দিবে।
কী দ্বারা সদকায়ে ফিতর দিতে হবে:
হাদিসের ভাষ্যমতে এক সা' যব, খেজুর, পনির, কিসমিস বা অর্ধ সা' গম দ্বারা কিংবা এর মূল্য দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করবে। যেহেতু এর মূল্যে তফাৎ রয়েছে, তাই যার যে পণ্যের সামর্থ্য আছে তিনি সে পণ্য দ্বারাই দেবেন। সকলের জন্যই নিম্নমানের পণ্য নির্ধারণ উচিত নয়, এতে হাদিসের উদ্দেশ্যে ব্যহত হয় ও কয়েকটি অংশ আমলহীন থেকে যায়। তাই উক্ত পণ্যগুলো নিজের ও পরিবারের জন্য যে মানের ক্রয় করা হয়, সদকায়ে ফিতর কমপক্ষে এই মানের দিতে হবে। নবী সাল্লাল্লাহুকে সর্বোত্তম দান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে বলেন, যার মূল্য সবচেয়ে বেশি ও দাতার কাছে সর্বোৎকৃষ্ট।( সহিহ বুখারি-৩/১৮৮)
লক্ষণীয় যে, টাকা দিয়ে সাদকায়ে ফিতর আদায় শুধু বৈধ নয়, অভাবীদের প্রয়োজন বিবেচনায় তা উত্তম ও কল্যাণকর। সালাফ ও খালাফের এক জামাত এমন-ই বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারি রহ. এর মতে সদকায়ে ফিতর টাকা দিয়ে আদায় করা যাবে। তিনি এ ব্যাপারে আলাদা অধ্যায় উল্লেখ করেছেন।(ফাতহুল বারি শরহে বুখারি)
প্রখ্যাত তাবেয়ি হাসান বসরি রহ. বলেন, টাকা দ্বারা ফিতরা আদায়ের ব্যাপারে কোন সমস্যা নেই।( মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-৪/৩৭'৩৮)
উমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহ. জনপ্রতি অর্ধ দিরহাম করে ফিতরা আদায় করতে আদেশ করেছেন।( মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-৪/৩৭,৩৮)
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. মানুষের কল্যাণ হলে টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় জায়েয বলেছেন। ( মাজমুয়া ফাতাওয়-২৫/৭৯)
বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী ফিতরার হার নিম্নরূপ:
১) উন্নত মানের গম বা আটা দিলে অর্ধ সা' (১ কেজি ৬৫০ গ্রাম) এর বাজার মূল্য ৭০ টাকা দিতে হবে।
২) যব দিলে এক সা'( ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম) এর বাজার মূল্য ২৮০ টাকা দিতে হবে।
৩) কিসমিস দিলে এক সা'(৩ কেজি ৩০০ গ্রাম) বা এর বাজার মূল্য ১,৩২০ টাকা দিতে হবে।
৪) খেজুর দিলে এক সা' (৩ কেজি ৩০০ গ্রাম) বা এর বাজার মূল্য ১,৬৫০ টাকা দিতে হবে।
৫) পনির দিলে এক সা' (৩ কেজি ৩০০ গ্রাম) বা এর বাজার মূল্য ২,৩১০ টাকা ফিতরা দিতে হবে। দেশের সব বিভাগ থেকে সংগৃহীত গম, আটা, যব, কিশমিশ, খেজুর ও পনিরের বাজার মূল্যের ভিত্তিতে এ ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সূত্র:ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
আসুন, রোজাকে পরিশুদ্ধ করতে ও অসহায়ের মুখে হাসি ফোটাতে ঈদের নামাজের আগেই সাদকায়ে ফিতর আদায় করি।
লেখক- প্রধান শিক্ষিকা, মানারাতুল উলূম মহিলা মাদরাসা, সিলেট
-কেএল