মুফতী গোলাম রাজ্জাক কাসেমী।।
আমরা এখন রমজানের প্রথম দশকের শেষপ্রান্তে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘রমজানের প্রথম দশক রহমতের, মধ্য দশক মাগফিরাতের, শেষ দশক নাজাতের।’ (সহিহ ইবনে খুজাইমা :১৮৮৭) যদিও মুমিন বান্দার ওপর আল্লাহর রহমত সবসময় বর্ষিত হতে থাকে, তবে পবিত্র রমজানে এর ব্যাপকতা আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
বিশেষত রমজানের প্রথম দশকে আল্লাহ বান্দার উপর স্পেশাল রহমত বর্ষণ করেন। রমজানের প্রথম দশদিন ফুরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের রহমত পাওয়ার পাথেয় কতটুকু অর্জিত হয়েছে! অথচ রমজান মাস হল মুমিনের জীবনে রহমতের বসন্তকাল। এই মাসে মুমিনের উপর অনবরত রহমত নাজিল হতে থাকে। তাই এ মাস রহমতের পাথেয় সঞ্চয়ের মৌসুম ৷ কৃষক যেমন ধানের মৌসুমে ধান উৎপাদন করে সারা বছরের পাথেয় জমা করে, ঠিক রমজান মাসও মুসলমানদের সেই পাথেয় অর্জন করার মাস। তবে রমজান মুমিনদের জন্য যেমন কল্যাণময় মাস, ঠিক মুনাফিকদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতির মাসও এই রমজান। এই মাসে মুমিনগণ সারা বছরের পাথেয় সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে। অপরদিকে মুনাফিকরা থাকে উদাসীন আর দোষত্রুটি অন্বেষণে মগ্ন।
হজরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলার কসম! মুসলমানদের জন্য রমজানের চেয়ে উত্তম কোনো মাস আসেনি এবং মুনাফিকদের জন্য রমজান মাসের চেয়ে অধিক ক্ষতির মাসও আর আসেনি। কেননা মুমিনগণ এ মাসে ইবাদতের শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ করে। আর মুনাফিকরা তাতে মানুষের উদাসীনতা ও দোষত্রুটি অন্বেষণ করে। এ মাস মুমিনের জন্য গনীমত আর মুনাফিকের জন্য ক্ষতির কারণ। (মুসনাদে আহমদ : ৮৩৬৮)
তাই এ মাসে আপনাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, মুনাফিক হয়ে সারা জীবন মানুষের দোষত্রুটি অন্বেষণে মগ্ন থাকবেন, নাকি এই মাসে বেশি বেশি নেক আমল করে অন্য মাসগুলোর পাথেয় অর্জন করবেন।
বন্দার ওপক আল্লাহর বিশেষ রহমতের স্বরূপ এই পবিত্র রমজানে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং অভিশপ্ত শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়। আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন, যখন রমজান মাসের আগমন হয়, তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় আর শয়তানগুলোকে শিকলবন্দী করা হয়। (বুখারি : ১৮৯৯)
জান্নাতের দরজাগুলো খোলার অর্থ নেক আমল করা সহজ হয়ে যাওয়া আর জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধের অর্থ বদ আমলের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
শয়তানদের শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলার অর্থ রমজানের পূর্বে তারা স্বাধীনভাবে যথেচ্ছা বিচরণ করেছে এবং বান্দাকে অসওয়াসা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কিন্তু রমজানের প্রথম রাতেই তাদের বন্দী করা হয়, যেন রোজাদারকে ধোঁকা ও প্রতারণা দিয়ে বিভ্রান্ত করতে না পারে। তাইতো রমজানে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং নেক কাজে অগ্রগামী হওয়া অধিকতর সহজ৷
রমজানের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য হওয়ার কারণ হলো, যেন মুসলমান রোজা পালন, নামাজ আদায়, কোরআন তিলাওয়াত, দান–সদকা, ফিতরা, জাকাত প্রদান ও আল্লাহর জিকিরে মশগুল হয়ে তাকওয়া অর্জনে অধিক সচেষ্ট হতে পারে।
নবী সা. বলেছেন, 'যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমজানে সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সমস্ত গোনাহ মাফ করা হবে।' (বুখারি: ১৯০১)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. ছিলেন সকল মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় দানশীল। রমজানে জিবরাঈল আ. যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন, তখন তিনি আরো অধিক দান করতেন। রমজান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরাঈল আ. তাঁর সঙ্গে একবার সাক্ষাত করতেন। নবী সা. তাঁকে কুরআন শোনাতেন। জিবরাঈল যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন তখন তিনি প্রবাহিত বায়ু অপেক্ষা অধিক ধন-সম্পদ দান করতেন। (বুখারি : ১৯০২)
রামজানে মুমিনগণ পাপমুক্ত থেকে রোজা পালনের মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ রহমত লাভ করে৷ আল্লাহর রাসুল সা. বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, রোজা ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তাঁর নিজের জন্য, কিন্তু রোজা আমার জন্য। তাই আমি নিজে এর প্রতিদান দেব। রোজা ঢাল স্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন রোজা পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাঁকে গালি দেয় অথবা তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি রোজাদার। যার কবজায় মুহাম্মাদের প্রাণ, তাঁর শপথ! অবশ্যই রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিসকের চেয়েও সুগন্ধময়। রোজাদারের জন্য রয়েছে দু’টি আনন্দের মুহুর্ত— (১ ইফতারের সময়, (২) যখন সে (কিয়ামতের দিন) তাঁর রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। (বুখারি: ১৯০৪)
আল্লাহর রহমত লাভ করতে পারলেই বিপদ-আপদ ও বালা–মুসিবত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। যে এ মাস পেয়েও আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হল। প্রকৃত পক্ষে সে-ই সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত, তাই আমাদের উচিত আল্লাহর রহমত পাওয়ার জন্য পুণ্যের কাজে অগ্রগামী হওয়া৷ বিশেষত রহমতের বিশেষ দশকের শেষ লগ্নের একটা মুহূর্তও যেন বৃথা না যায় সে দিকে অতি মনোযোগী হওয়া। বিশেষত রহমতের এই শেষ সময়গুলোতে আমাদের করণীয় হবে আল্লাহ পাকের দয়ামায়া-সংক্রান্ত নামগুলো বেশি বেশি স্মরণ করা, উক্ত গুণাবলি অর্জন করা এবং আচরণে সর্বোচ্চ দয়া প্রদর্শন করা। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল সা. বলেন, তুমি জগদ্বাসীর ওপর দয়া করো; তবে আল্লাহ তোমার প্রতি দয়া করবেন। (তিরমিজি:১৯২৪)
লেখক: মুহাদ্দিস ও বিভাগীয় প্রধান, আরবি ভাষা ও সাহিত্য, মদিতুল উলুম মাহমুদিয়া, নারায়ণগঞ্জ।
-এটি