মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্থ ব্যবস্থা গঠনে যাকাতের ভূমিকা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ওমর ইবনে আখতার।।

ইসলামের স্তম্ভ সমূহের অন্যতম একটি হলো যাকাত। ইসলাম যে একটি মানবতার ধর্ম এবং পূর্নাঙ্গ জীবন বিধান যাকাত ব্যবস্থা এর অন্যতম একটি প্রমাণ!

যেখানে পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রের মত কুফরি অর্থ ব্যবস্থাগুলো মানব সমাজের অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে, সেখানে ইসলামের যাকাত ব্যবস্থা জনগণকে চমৎকার ভারসাম্যপূর্ন নিখুঁত এক অর্থ ব্যবস্থা উপহার দিয়েছে!

ইসলাম সম্পদের লাগামহীন সঞ্চয়কে নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে এবং এক নায়কতন্ত্রের কাছে জনগণের অর্থ জিম্মি থাকার মতো ভয়ংকর সমাজতান্ত্র থেকে সমাজকে মুক্ত করেছে।

ইসলামের অর্থনীতি ব্যাবস্থা এই নির্দেশ প্রদান করে যে, ধন সম্পদ জমা ও সঞ্চয় করার জন্য নয়। বরং একে বন্টন করতে হবে। যেন মানুষের মাঝে সম্পদের ভারসাম্য অক্ষুণ্ণ থাকে এবং ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর হয়ে যায়।

এজন্য ইসলাম মনে করে, নিত্য দিনের প্রয়োজন পূরণ করার পর এবং নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাদ দেওয়ার পর যদি কারো নিকট সাড়ে বায়ান্ন তোলা (৫৯৫ গ্রাম) পরিমাণ রূপা কিংবা সাড়ে সাত তোলা (৮৫ গ্রাম) স্বর্ণ বা এর সমমূল্যের সম্পদ এক বৎসর সময় পর্যন্ত সঞ্চিত থাকে তাহলে সে ব্যক্তি সম্পদশালী। তাকে যাকাত প্রদান করতে হবে।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, তাদের সম্পদ থেকে যাকাত নিন যা তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত:১০৩] অপর এক আয়াতে বলেন, সালাত কায়েম কর, যাকাত আদায় কর, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, আল্লাহ তো চান তোমাদের কলুষমুক্ত করে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন করতে। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৩]

আর যাকাত প্রদানকে কেবল ঐচ্ছিক পর্যায়েই রাখা হয়নি বরং আবশ্যক করা হয়েছে।কেউ যদি তা আদায় না করে তার জন্য আইনগতভাবে শাস্তির সাথে সাথে পরকালীন কঠিন আযাবের ব্যাপারেও সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন- আর যারা সোনা রূপা (অর্থ-সম্পদ) জমা করে রাখে এবং সেগুলো আল্লাহর পথে যাকাত হিসেবে ব্যয় করে না তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। কিয়ামতের দিন সেগুলো জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং সেগুলো দ্বারা তাদের মুখমণ্ডল, পার্শ্বদেশ এবং পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। আর বলা হবে এগুলোই সেই সম্পদ যা তোমরা (যাকাত না দিয়ে) পুঞ্জিভূত করে রেখেছিলে। সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩৪-৩৫

মানব সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোকে ঠিক রাখতে ইসলাম যাকাতের ব্যপারে ব্যপক আকারে গুরুত্ব প্রদান করেছে, নামাজ ইসলামের সবচেয়ে বড় হুকুম মুসলমান হওয়ার পর। এই নামাজ আর যাকাত কে কুরআনে একসাথে ৩০ বার উল্লেখ করা হয়েছে! আর এদের উল্লেখ যেহেতু একসাথে, তাই যাকাত না দিলে নামাজও হবে না। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বলেন, আমাদেরকে নামাজ কায়েম করার এবং যাকাত প্রদান করার হুকুম দেয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি (সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও) যাকাত আদায় করেনা তার নামাজও কবুল হয়না! (তাবরানী কাবির থেকে সহীহ সনদে তারগীব কিতাবে ) এবং (ফাযায়েলে সাদাকাত, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৮৮) আরেক হাদিসে এসেছে, আল্লাহ তায়ালা ঐব্যক্তির নামাজ কবুল করেন না, যে যাকাত আদায় করেনা। আল্লাহ তায়ালা যখন নামাজ এবং যাকাতকে একত্রে বলেছেন তুমি তাকে পৃথক করোনা। (কানযুল উম্মাল)

আর তদুপরি যাকাত আদায় না করলে মালও পবিত্র হয়না। কারণ যাকাত ধন সম্পদের পবিত্রকারী। আমাদের সমাজে বর্তমানে যাকাত হিসেবে কাপড় দেয়া হয়। এই কাপড় দেয়ার ট্রেডিশন কোথা থেকে এসেছে তা আমার জানা নেই, তবে নিয়ম হলো,যাকে দিবে তাকে টাকার মালিক বানিয়ে দিবে, একজনকে এপরিমান অর্থ প্রদান করবে যাতে সে কিছু করতে পারে। কমপক্ষে এতটুকু দেয়া যেন ঐদিন তাকে কারো কাছে হাত পাততে নাহয়। আর যদি টাকা না দিয়ে রিকশা, সেলাই মেশিন অথবা একটি গাভী বা এজাতীয় কিছু ক্রয় করে দেয় তাহলে এটা আরও ভালো হবে, তার জীবিকা উপার্জনের একটি মাধ্যম হয়ে যাবে এটি। আর যাকাতের উদ্দেশ্যও পূর্ণ হবে পরিপূর্ণভাবে।

আর একমাত্র যাকাতের মাধ্যমেই সম্ভব, এই সমাজ থেকে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা। কেননা ইতিহাসে যখনই কোন সম্রাজ্য পূর্ণরূপে যাকাত আদায় করেছে সেখানেই দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়!

যেমন, একবার ইয়েমেনের গভর্নর মুয়ায বিন জাবাল রাযি. ইয়েমেনের এক - তৃতীয়াংশ যাকাত কেন্দ্র পাঠিয়ে দিলেন। খলিফা উমর রাযি. বললেন,তোমাকে কি ট্যাক্স উসুল করতে পাঠিয়েছি? ধনীদের থেকে নিয়ে ওখানেই গরীবদের মাঝে দিয়ে দাও। গভর্নর জানালেন যাকাত নেয়ার কেউ নেই। দ্বিতীয় বছর অর্ধেক যাকাত এবং পরের বছর পুরো যাকাত মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন। জানালেন, যাকাত নেবার মতো দরিদ্র লোক ইয়েমেনে নেই। (আল আমওয়াল, পৃষ্ঠা ৫৯৬)

অনূরূপ ঘটেছে উমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহঃ এর যামানায়ও। আরও আশ্চর্যের ঘটনা ঘটেছে অটোমান সম্রাজ্যের ৭ম খমিফা মুহাম্মদ আল ফাতিহ রহ. এর সময়। তার আমলে এক মুসলমান যাকাতের টাকা দেবার কাউকে পেলনা। অগত্যা থলিতে করে চৌরাস্তায় ঝুলিয়ে দিল। লিখে দিল - ভাই, আমি অনেক খুজেঁও কোন ফকির পাইনি। তুমি যদি অভাবি হও নির্দ্বিধায় এটা গ্রহণ করতে পারো। কথিত আছে যে, তিন মাস ঝুলে ছিল থলিটি।

সুতরাং আমাদের দেশের সকল ধনী ব্যক্তিবর্গও যদি পূর্ণ রূপে সঠিক পদ্ধতিতে যাকাত আদায় করে তাহলে আগামী দুই বছর পর যাকাত গ্রহীতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে পরিপূর্ণরূপে যাকাতের হক আদায় করে যাকাত প্রদান করার তাওফীক দান করুণ, আমিন!

লেখক: শিক্ষার্থী জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ