উবায়দুল্লাহ তাসনিম ।।
বছর ঘুরে ফিরে আসছে মাহে রমজান ৷ মুমিনের পূণ্য উৎসবের মাস রমজান ৷ রহমত বরকতের বৃষ্টি বর্ষণের মাস রমজান । রমজান মাসে সেহরী, রকমারি ইফতার আর নানা আয়োজনে জেগে উঠে মু’মিন-মুসলমান ৷ খাবার কেন্দ্রিক উৎসব শুধু না; ইবাদত -বন্দগীরও ধূম পড়ে মু’মিনের ঘরে ঘরে৷ রমজান সংযম শিক্ষার মাস, মাগফিরাতের মাস, মুক্তি অর্জনের মাস। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মহান প্রভুর নৈকট্য লাভ, আল্লাহর হাতে পুরস্কার প্রাপ্তি এ মাসের একান্ত দাবী।
রমযানের মর্যাদা:
এ মাসে রোযা রাখা আমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে।রোযা শুধু উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর ফরজ হয়েছে তা না, অন্যান্য নবির উম্মতের উপরও তা ফরজ ছিল৷ রোযার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, সংযম-পরহেজগারির মাধ্যমে বান্দার তাকওয়া অর্জন৷ কুরআনে কারীমের ঘোষণা,
يا أيها الذين آمنوا كتب عليكم الصيام كما كتب على الذين من قبلكم لعلكم تتقون
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।'(সূরা বাকারা-১৮৩)
রমজান মাস কুরআন নাযিলের মাস। কুরআন যেমন মহা মূল্যবান, রমজানও তেমনি মহামর্যাদার অধিকারী। আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা’য়ালার ইরশাদ,
شَهْرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِىٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلْقُرْءَانُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٍ مِّنَ ٱلْهُدَىٰ وَٱلْفُرْقَانِ
‘রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।'(সূরা বাকারা ১৮৫)
এ মাসটিতে এমন এক রাত রয়েছে, যে রাতে ইবাদত করা হাজার মাস ইবাদত করার চেয়েও বেশি উত্তম।
রমজান অত্যন্ত বরকতপূর্ণ মাস। এ মাসে রহমতের অঝোরে বৃষ্টি নেমে আসে৷ জাহান্নাম তালাবদ্ধ হয়। শয়তান আটকে পড়ে। প্রিয় নবীজি সা ইরশাদ করেন,
إذا دخل شهر رمضان فتحت أبواب السماء وغلقت أبواب جهنم و سلسلت الشياطين
‘রমযান মাস আসলে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ শয়তানকে জিঞ্জিরাবদ্ধ করা হয়।'(বুখারী, ১৮৯৯)
এ মহান মাসে বান্দার জন্য রহমতের দরোজা খুলে যায়। হাদিসের ইরশাদ,
إذا جاء رمضان فتحت أبواب الجنة
‘রমজান মাস আসলে জান্নাতের দরোজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়।’
(বুখারী,১৮৯৮, মুসলিম, ১০৭৯)
রোযাদারের পুরস্কার:
রোযাদারের রোযা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে। রোযা লৌকিকতা বিবর্জিত এক আমল। যে আমল রিয়া বা লোক দেখানো থেকে মুক্ত। এজন্য রোযার পুরস্কারও বিরাট। নবীজি সা ইরশাদ করেন,
من صام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه
যে ব্যক্তি ইমানের সাথে সওয়াব প্রাপ্তির প্রত্যাশায় রমজানের রোজা রাখে, তার পূর্ববর্তী সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।
(বুখারী,১৮০২)
রোযার ইখলাসে বদৌলতে আল্লাহর কাছে (দীর্ঘ সময় পানাহার না করার কারণে সৃষ্ট) রোযাদারের মুখের দূর্গন্ধ মেশকের চেয়েও বেশি প্রিয়। রোযা এমন একটা মহান আমল, যার পুরস্কার আল্লাহ নিজ হাতেই দিবেন৷ প্রিয় নবীজি সা ইরশাদ করেন,
والذي نفسي بيده لخوف فم الصائم أطيب عند الله من ريح المسك يترك طعامه وشرابه وشهوته من أجلي ، الصيام لي وأنا أجزي به، والحسنة بعشر أمثالها
যার হাতে আমার প্রাণ, তার শপথ! রোযাদারের (দীর্ঘ সময় পানাহার না করার কারণে সৃষ্ট) মুখের দূর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের (এক প্রকার দামি সুগন্ধি) চেয়েও অধিক প্রিয়। কারণ (আল্লাহ তায়ালা বলেন) রোযাদার কেবল আমার জন্যই পানাহার ও প্রবৃত্তির বাসনায় লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকে। রোযা কেবল আমার জন্যই রাখা হয় এবং আমি নিজেই তার প্রতিদান দেবো। (আর প্রত্যেক) সৎকাজের সওয়াবই দশগুন বাড়িয়ে দেওয়া হয়।(বুখারী: ১৮৯৪, মুসলিম, ১১৫১)
রোযাদারের বিশেষ দু’টি আনন্দের কথা রাসূল সা বলেছেন,
للصائم فرحتان يفرحان، إذا أفطر فرح، وإذا لقي ربه فرح بصومه
দু’টি আনন্দ রয়েছে, যা রোযাদারকে আনন্দিত করে। এক, যখন সে ইফতার করে। দুই, যখন সে তার প্রভুর সাথে সাক্ষাত করবে, তখন (আল্লাহ প্রদত্ত) রোযার (প্রতিদানের) কারণে সে আনন্দিত হবে। (বুখারী, ১৯০৪, মুসলিম, ১১৫১)
কিয়ামতের দিন রোযাদারদের বিশেষ সম্মান অর্জিত হবে৷ হাদিসে ইরশাদ হয়েছে,
إن في الجنة بابا ، يقال له ريان، يدخل منه الصائمون يوم القيامة، لا يدخل منه أحد غيرهم ، فإذا دخلوا أغلق ، فلم يدخل منه أحد
‘জান্নাতে ‘রাইয়্যান’ নামক একটি দরজা রয়েছে, কিয়ামতের দিন যা দিয়ে শুধু রোযাদাররাই প্রবেশ করবে। রোযাদার ছাড়া অন্য কারোর এ দরজা দিয়ে প্রবেশাধিকার নেই। রোযাদাররা প্রবেশ করার পর তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। এরপর আর কেউ তা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।(বুখারি, ১৮৯৬,মুসলিম,১১৫২)
এ মাসে যা যা করণীয়:
রমজান মাসে বান্দার অন্যতম কাজ হল, কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা অনুযায়ী সওম পালন করা। তারাবীর নামায রমজান মাসের অনন্য বৈশিষ্ট্য। মনেপ্রাণে তারাবীর নামায আদায় করাও এ মাসের অন্যতম করণীয় বিষয়। রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন,
من قام رمضان إيمانا وإحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه
যে ব্যক্তি রমজানে ঈমান ও ইহতেসাবের (সওয়াবের আশা ) সাথে নফল(তারাবী) নামায পড়বে, তার পিছনের গোনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে।(বুখারি,১৯০৫)
এ ছাড়া এ পবিত্র মাসটিতে অন্যান্য নফল নামাযের ব্যাপারে তুলনামূলক বেশি মনোনিবেশ করা উচিত। অঝোরে বর্ষিত রহমতের এ মাসে দুআ ইসাতেগফারের প্রতি যত্নবান হওয়া একজন মু’মিনের অন্যতম কাজ। কুরআনে কারিমে সবসময়ই দুআর ব্যপারে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে,
أدْعُوا۟ رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً
তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাক, কাকুতি-মিনতি করে এবং সংগোপনে। (আরাফ,৫৫)
ويَسْتَجِيبُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّٰلِحَٰتِ وَيَزِيدُهُم مِّن فَضْلِهِۦ وَٱلْكَٰفِرُونَ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ
” তিনি মুমিন ও সৎকর্মীদের দোয়া শোনেন এবং তাদের প্রতি স্বীয় অনুগ্রহ বাড়িয়ে দেন। আর কাফেরদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি।”(সূরা আস-শূরা ২৬
সুতরাং করোনা মহামারীর দূর্যোগময় পরিস্থিতিতে রমজানের এ মহান মাসে দোয়ার প্রতি আরো বেশি যত্নবান হওয়া জরুরী৷ করোনার শাস্তি যদিও আমাদের কৃতকর্মের শাস্তি, তবুও নিরাশ হলে চলবে না। কুরআনে এরশাদ হয়েছে,
قُلْ يَٰعِبَادِىَ ٱلَّذِينَ أَسْرَفُوا۟ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا۟ مِن رَّحْمَةِ ٱللَّهِ إِنَّ ٱللَّهَ يَغْفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُۥ هُوَ ٱلْغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ
বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।(সূরা যুমার,৫৩)
আর রমজানের শেষ দশকের ইতেকাফের গুরুত্ব প্রচুর৷ নবী করিম সা এ মাসে খুব গুরত্বের সংগে ই’তেকাফ করতেন।
عن عبد الله بن عمر قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعتكف العشر الأواخر من رمضان
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা থেকে বর্ণিত, রাসূল সা রমজানের শেষ দশকে ই’তেকাফ করতেন।(বুখারী, ২০২৫, মুসলিম, ১১৭১)
ইতেকাফের গুরত্ব এতোটাই যে, নবীজি সা এর মৃত্যুর পর তার পবিত্র স্ত্রীগণ পর্যন্ত এতেকাফ করেছেন।
আয়শা রা থেকে বর্ণিত,, রাসূল সা মৃত্যু পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ই’তেকাফ করছেন। তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীগণ ইতেকাফ করেছেন। (বুখারী,১৯২২)
হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও যে এক রাতের ইবাদত শ্রেষ্ঠ, তাও এই শেষ দশকেই৷ এ রাতে কেউ ঈমান ও ইখলাসের সঙ্গে ইবাদত করলে পিছনের গোনাহ ধুয়ে-মুছে বান্দা নির্মল হয়ে যায়।
ومن قام ليلة القدو إحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه
যে ব্যক্তি কদরের রাতে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় নফল নামায পড়বে, তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে।(বুখারী, ২১৪, মুসলিম, ৭৬০)
একজন মু’মিন-মুসলমান তাই রমজানের শেষ এই দশকটিতে ই’তেকাফ করবে, শবে কদর তালাশ করবে তা এ মাসের অন্যতম আবেদন।
এমাসে যা যা বর্জনীয় :
ইসলাম সবসময়ই ঝগড়া, গালমন্দ এসব নিঁচু কাজ থেকে মানা করে। বিশেষ রমজানের পবিত্র মাসে তা খুব ন্যাক্কারজনক। রাসূলুল্লাহ সা পবিত্র রমজানের মাসে ঝগড়া,গালমন্দ, থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে,
الصيام جنة ،فلا يرفث، ولا يجهل، و إن إمرؤ قاتله أو شاتمه فليقل إني صائم
‘রোযা (জাহান্নাম থেকে বাঁচার) ঢাল স্বরূপ। সুতরাং রোযাদার ব্যক্তি যেনো অশ্লীলতায় না জড়ায়। এবং জাহেলিযুগের কোন (মন্দ) কাজ না করে।কেউ যদি তার সাথে ঝগড়ায় করতে চায়
যায় বা তাকে গালি দেয়, তখন সে যেনো বলে দেয়, আমি রোযাদার। (বুখারী, ১৮৯৪, মুসলিম, ১১৫১)
মিথ্যার পরিণাম চিরকালই ভয়ঙ্কর। মিথ্যায় কোনদিন প্রকৃত সফলতা আসে না। মিথ্যা বিপদ টেনে আনে। মিথ্যাকে হাদিসে ‘উম্মুল খাবাইছ ‘( সব গোনাহের মূল) বলা হয়েছে৷ রমজানের পবিত্র মাসে এটা আরো জঘন্যতম অপরাধ। মিথ্যা রোজার সত্তায় আঘাত হানে৷ এ জন্য
হাদিসে নববীতে মিথ্যার ব্যাপারে বিশেষ করে রমজান মাসে কঠোর হুঁশিয়ারী এসেছে,
من لم يدع قول الزور والعمل به فليس لله حاجة في أن يدع طعامه وشرابه
যে ব্যক্তি(রোযা রেখে) মিথ্যা কথা ও কাজ ছাড়তে পারল না, পানাহার ছেড়ে তার রোয রাখা আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ আল্লাহর দরবারে তা গ্রহণ হবার আশা করা যায় না৷ (বুখারী,১৯০৩)
অশ্লীলতা প্রকৃত রুচিবোধ বিকৃত একটা কাজ। ইসলাম শুরু থেকে অশ্লীলতাকে ‘না’ বলে এসেছে । রমজানের পবিত্র আবহে তা আরো জঘন্যতম কাজ। নবীজি সা ইরশাদ করেছেন,
إذا كان يوم صوم أحدكم، فلا يرفث، ولا يخصب، فإن سابه أحد أو قاتله فليقل إني صائم
তোমাদের কেউ যখন রোযাবস্থায় থাকে, সে যেনো অশ্লীলতায় না জড়ায়, (অযথা, অপ্রীতিকর, অনৈতিক) শোরগোল না করে। কেউ যদি তাকে গালি দেয় বা তার সাথে ঝগড়া করতে যায়, তাহলে সে যেনো বলে দেয়, আমি রোযাদার।(বুখারি,১৮০৫)
তাই আসুন, আমরা রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করি। রমজান থেকে সংযমের শিক্ষা নেই। রাশি রাশি পাপে ডুবে থাকা জীবন মাগফিরাতের পানিতে নির্মল করি। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সবাইকে রমজানের পবিত্রতা, আবেদন সবকিছু রক্ষা করার তাওফিক দিন। আমিন!