মুহিউস সুন্নাহ হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক রহ.।।
শয়তান অনায়াসেই যবানের গুনাহে মানুষকে লিপ্ত করে দেয়। আমরা মনে করি, এতে কিছু হবে না। বড় বড় গুনাহে মানুষ ব্যাপকহারে লিপ্ত। কুদৃষ্টি করা, অন্যের ব্যাপারে খারাপ ধারণা করা, মিথ্যা ও খারাপ কথা বলা, হিংসা করা ইত্যাদি। গীবত এমন একটা গুনাহ, যেটার মধ্যে শয়তান নেককার আহলে ইলমদেরও পর্যন্ত লিপ্ত করে দেয়। এ কারণেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
الغِيبَةُ أَشَدُّ مِنَ الزِّنَا، قالوا : يا رسول الله وكيف الغيبة أشد من الزنا ؟ قال : إن الرجل ليزني فيتوب فيتوب الله عليه. وفي رواية : فيتوب فيغفر له، وإن صاحب الغيبة لا يغفر له حتى يغفرها له صاحبه
গীবত যদিও যবানের গুনাহ কিন্তু এটা যিনার চেয়েও মারাত্মক। সাহাবায়ে কেরাম এ কথা শুনে আশ্চর্য হলেন। গীবত কীভাবে যিনার চেয়ে মারাত্মক! তাঁরা নবীজির কাছে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! গীবত কীভাবে যিনার চেয়েও মারাত্মক গুনাহ? নবীজি বললেন, মানুষ যিনা করে, পরে তওবাও করে। আল্লাহ তায়ালা তাকে মাফ করে দেন। কিন্তু গীবতকারীর ক্ষমা তখন পর্যন্ত করা হয় না, যতক্ষণ না-পর্যন্ত যার গীবত করার হয়েছে, সে মাফ না-করবে। -(বায়হাকি : ৬৪৬৫, মেশকাত : ৪৮৭৪)
গীবতের গুনাহ যিনার চেয়েও ভয়াবহ। যিনার গুনাহ আল্লাহ তায়ালা তওবা-ইসতেগফার করার দ্বারা মাফ করে দেবেন। গীবতের গুনাহের কোনো তওবা নেই; যার গীবত করা হয়েছে তার থেকে মাফ নেওয়া ছাড়া। যার গীবত করা হয়েছে আগে তার থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।
যার গীবত করা হয়েছে, সে যদি আখেরাতে হাজার রাকাত নামায হজ দান-সদকার সওয়াব নিয়ে ক্ষমা করতে চায়, তা হলে তাকে দিয়ে দিতে হবে। আমরা নেকআমল তো খুব করছি। কিন্তু যদি মানুষের গীবত করি, তা হলে সব সওয়াব ও নেকি চলে যাবে অন্যের আমলনামায়।
আজকাল গীবত বড় জোরেসোরে চলছে। অথচ এটা এমন বদঅভ্যাস, যার কারণে দীন ও দুনিয়া উভয় জগতে চরমভাবে লজ্জিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। কিছু দোস্ত-আহবাবের আবদারের কারণে সংক্ষিপ্তভাবে গীবতের কিছু ক্ষতি এবং এর কিছু চিকিৎসা বুযুর্গদের কিতাব ও বয়ান থেকে একত্র করে দেওয়া হয়েছে। এ কথাগুলো বারবার স্মরণ ও ভাবনা-চিন্তা করার দ্বারা এবং এগুলোর ওপর আমল করার দ্বারা গীবত করার রোগ দূর হয়ে যাবে। এবং এ জঘন্য গুনাহ থেকে হেফাযত ও নিরাপদ থাকা নসিব হবে। ইনশাআল্লাহ।
এক. গীবতের নুকসান ও ক্ষতি হলো, এর দ্বারা বিবাদ ও বিভেদ সৃষ্টি হয়। পরস্পর বিবাদের কারণে ঝগড়া-লড়াই, মামলা-মুকাদ্দমা সব কিছু হতে থাকে। একত্রে ও একসঙ্গে থাকার কারণে যে কল্যাণ হয়; গীবতের কারণে বিভেদ সৃষ্টি হওয়ার পর মানুষ সেই ফায়দা থেকে মাহরুম ও বঞ্চিত হয়।
দুই. গীবত করার সঙ্গে সঙ্গে দিলের মধ্যে এমন যুলমত ও অন্ধকার সৃষ্টি হয়, যার দ্বারা মানসিক কষ্ট হয়। যেন কেউ অন্তরের মধ্যে ময়লা-আবর্জনা ফেলে দূষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত করে ফেলেছে। যার দিলের মধ্যে সামান্য অনুভব-অনুভূতিও রয়েছে, সে এই ক্ষতিটা অনুধাবন ও উপলব্ধি করে।
তিন. গীবত করার দ্বারা দীন-দুনিয়া উভয় জগতে নুকসান ও ক্ষতি হয়। যার গীবত করা হয়েছে, সে যদি এটা শোনে, তা হলে গীবতকারীকে অপমান ও লাঞ্ছিত করে। যদি ক্ষমতা থাকে, তা হলে খারাপভাবে তার থেকে প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়ে। দীনি ক্ষতি হলো, গীবত করার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা নারাজ হন। আর আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টি ও নারাজি হলো জাহান্নামে যাওয়ার সামান ও উপকরণ। নাউযুবিল্লাহ!
চার. হাদিস শরিফে আছে, গীবত যিনার চেয়েও মন্দ ও ক্ষতিকর।
পাঁচ. গীবতকারীকে আল্লাহ তায়ালা মাফ করবেন না, যতক্ষণ না যার গীবত করা হয়েছে সে মাফ না করবে। গীবত হল হুকুকুল ইবাদ। বান্দার হক।
ছয়. গীবত করার অর্থ, নিজের মরা ভাইয়ের গোশত খাওয়া। কে এমন আছে, যে নিজের মৃতভাইয়ের গোশত খাবে! মরা ভাইয়ের গোশত খাওয়া যেমন অপছন্দনীয়; গীবত করাটাও তেমনি জঘন্য ও অপছন্দনীয় কাজ।
সাত. গীবতকারী ভীতু হয়ে থাকে। যে কারণে পিছে-পিছে মন্দ কথা বলে বেড়ায়।
আট. গীবত করার দ্বারা চেহারার নুর চলে যায়। আর এ ধরনের লোককে মানুষ অসম্মানের দৃষ্টিতে দেখে।
নয়. গীবতের বড় ক্ষতি হলো, গীবতকারীর নেকআমল যার গীবত করা হয়েছে তাকে দিয়ে দেওয়া হবে। যদি তাতে কমি পুরা না হয়, তা হলে যার গীবত করা হয়েছে তার গুনাহ ও বদআমল গীবতকারীর গরদানে চাপিয়ে দেওয়া হয়। যে কারণে গীবতকারীকে জাহান্নামে যেতে হবে।
যাদের আমল অন্যদের দিয়ে দেওয়া হবে হাদিস শরিফে তাদের মিসকিন বলা হয়েছে। তাই যার গীবত করা হয়েছে, দুনিয়াতেই তার থেকে মাফ নিয়ে নেওয়া চাই।
(মুহিউস সুন্নাহ হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক রহ.-এর বয়ানের কিতাব সাবীলুন নাজাত থেকে)
অনুবাদ: সাদ আবদুল্লাহ মামুন
এনটি