আওয়ার ইসলাম: প্রথমবারের মতো, রোহিঙ্গা ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদ প্রকাশ হতে যাচ্ছে।
রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিজ ভাষায় বুঝে পবিত্র কুরআন পড়ার সুযোগ নেই। কারণ কোরআন শরিফের কোনো রোহিঙ্গা সংস্করণ বা অনুবাদ নেই। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অনুবাদের অডিও ও ভিডিও সংস্করণ পাচ্ছে এ জনগোষ্ঠীর লোকজন।
টার্কিশ রেডিও অ্যান্ড টেলিভিশন (টিআরটি) ওয়ার্ল্ড জানিয়েছে, সরাসরি আরবি ভাষা থেকে নয়, কুরআনের রোহিঙ্গা অনুবাদ করা হয়েছে সৌদি আরবের কিং ফাহাদ ইংরেজি সংস্করণ থেকে।
কয়েক কিস্তিতে ধাপে ধাপে প্রকাশ করা হবে ৩০ পারার ১১৪টি সূরার হাই-ডেফিনিশন (এইচডি) সংস্করণ। রমজান মাস সামনে রেখে অনলাইনে রোহিঙ্গা ভাষায় অনূদিত কুরআনের প্রথম কিস্তি প্রকাশ করা হবে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে। রোহিঙ্গা ভাষায় বিশ্বের প্রথম সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল রোহিঙ্গা ভিশন ও মালয়েশিয়াভিত্তিক দাকওয়া কর্নার বুকস্টোরের (ডিসিবি) উদ্যোগ এই রোহিঙ্গা ভাষার কুরআন। ধর্মগ্রন্থটি অনুবাদে ৮১ হাজার ডলার সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছে প্রতিষ্ঠান দুটি।
রোহিঙ্গা ভাষায় কুরআন অনুবাদের কাজটি করা হবে ধর্মীয় নেতা শেখ মুহাম্মদ আইয়ুবের আরবি ভাষার তেলাওয়াত থেকে। সৌদি আরবের মক্কায় রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিবারে পঞ্চাশের দশকে জন্ম নেয়া প্রয়াত এই নেতা মদিনার পেশ ইমামও ছিলেন।
রোহিঙ্গা ভাষায় কুরআন অনুবাদের মূল কাজটি করছেন ধর্মীয় নেতা কুতুব শাহ। কারিগরি প্রকৌশলের সাবেক এই শিক্ষার্থী রোহিঙ্গা বলে তাকে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা সম্পূর্ণ করতে দেয়নি মিয়ানমার সরকার। বর্তমানে মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছেন তিনি। তার গবেষণার বিষয় ‘কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন’।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু হলো রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাদের বর্বরতার শিকার গোষ্ঠীটির ১১ লাখের বেশি মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
মানবাধিকার কর্মীদের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ বলে, রাখাইনের এ জনগোষ্ঠীর ওপর সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়াসহ নানা কায়দায় নির্যাতন চালিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
রোহিঙ্গা মুসলিমদের জাতিগতভাবে নিধন ও কাঠামোগত নির্যাতনের অংশ হিসেবে কয়েক দশক ধরে নানাভাবে নিপীড়ন চালিয়ে আসছে মিয়ানমারের বৌদ্ধ সরকার ও সেনাবাহিনী। এ লক্ষ্যে তাদের নিজ ভাষায় রচিত বই, ধর্মগ্রন্থ, শিল্প-সাহিত্যের নিদর্শন পুড়িয়ে ছাই করার পাশাপাশি নিষিদ্ধ করা হয়েছে পাঠ্যপুস্তক প্রকাশও।
রোহিঙ্গা ভাষায় কোরআন অনুবাদের অন্যতম উদ্যোক্তা, অধিকারকর্মী ও রোহিঙ্গা ভিশনের সত্বাধিকারী মুহাম্মদ নূর। তিনি বলেন, ‘নিজ দেশে রোহিঙ্গা ভাষায় লেখাপড়া করার অধিকারটুকু পাইনি আমরা। নির্দেশ অমান্য করে এইটুকু করার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি পেতে হয় আমাদের। হয় মরতে হয়, না হলে কারাবন্দি থাকতে হয়।’
তিনি জানান, অতীতেও বেশ কয়েকবার রোহিঙ্গা ভাষায় কোরআন অনুবাদের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। বিভিন্ন সময় উর্দু, আরবি ও লাতিন ভাষা থেকে রোহিঙ্গা ভাষায় বই আকারে কুরআন প্রকাশের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবারই অসম্পূর্ণ থেকে গেছে সেসব চেষ্টা। প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার হার ভীষণ কম। দশকের পর দশক মিয়ানমারে তাদের শিক্ষা গ্রহণ ও কাজ করা নিষিদ্ধ করে রেখেছে দেশটির সরকার। এমনকি রোহিঙ্গা হিসেবে নিজ জাতিগত পরিচয়ের স্বীকৃতিও দেয়া হয় না তাদের।
এমন পরিস্থিতিতে বিদেশে আশ্রয় নেয়া অনেক রোহিঙ্গা অভিবাসী নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাদের একজন ষাটের দশকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আশ্রয় নেয়া নূরের পরিবার।
রোহিঙ্গা ভাষায় কথা বলতে পারেন ও ভাষাটি বোঝেন, এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ। কিন্তু গত ১০০ বছরের বেশি সময়ে ভাষাটির লিখিত রূপ (বর্ণমালা ও শব্দ) বেশ কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। আশির দশকে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা শিক্ষাবিদ মাওলানা মুহাম্মদ হানিফ একটি ভাষা ব্যবস্থা দাঁড় করাতে সক্ষম হন, যা পরিচিতি পায় রোহিঙ্গা হানিফি নামে।
মুহাম্মদ নূর বলেন, ‘ভারত বা পাকিস্তানে গিয়ে যারা লেখাপড়া করেছেন, তাদের মধ্যে উর্দু ভাষায় কুরআন অনুবাদের প্রবণতা ছিল। আবার যারা মধ্যপ্রাচ্যে আছেন, তারা আরবি ভাষানির্ভর অনুবাদ করেছেন। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই বেশিরভাগ রোহিঙ্গা পড়তে পারেন না।’
নূর আরও বলেন, ‘এ কারণেই অডিও ও ভিডিও আকারে কুরআনের রোহিঙ্গা অনুবাদের উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। যেন তৃণমূলের মানুষদের কাজে লাগে এটি। ‘পড়ে বুঝতে হবে না, শুনে বুঝতে পারবেন তারা। তাই এখনই বই আকারে রোহিঙ্গা কুরআন বের করার পরিকল্পনা আমাদের নেই। পরে কখনো হতে পারে।’
রোহিঙ্গা হানাফি ভাষায় ইউনিকোড তৈরি করেছেন নূর। এটি ব্যবহার করে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে সহজ যোগাযোগ করা শিখে গেছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা। সূত্র: ইকনা
-এটি