সারিব সুইজা: নবম হিজরির শেষ দিকের ঘটনা। দিকে দিকে তখন ছড়িয়ে পড়েছে ইসলামের দাওয়াত। আরবের সব এলাকার লোক মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। শুধু একটিমাত্র এলাকার জনগণ ছাড়া সবাই মেনে নিয়েছে মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্বে ইসলামী আদর্শ ও হুকুমাত। সেটি হচ্ছে নাজরান। নাজরান হলো ইয়েমেনের অন্তর্গত এক সমৃদ্ধশালী খ্রিস্টান বসতি। সমসাময়িক খ্রিস্টবিশ্বের মিশনারি সেন্টার হিসেবে বিখ্যাত ছিল এই নাজরান। এখানকার খ্রিস্টান পাদ্রিদের জ্ঞান-গরিমা সারা খ্রিস্ট জগতে ছিল সুপরিচিত। এ নিয়ে নাজরানবাসীদের ছিল অনেক গর্ব। আরব উপদ্বীপের সকল গোত্র উপগোত্র ইসলামের দাওয়াত কবুল করলেও এই নাজরানবাসীরা তা থেকে দূরে সরে থাকে।
নবী করিম (সা.) ইসলামের দাওয়াত দিয়ে নাজরানের প্রধান বিশপ আবু হারিস বিন আলকামার কাছে একটি চিঠি লিখেন। মদীনা থেকে নবী (সা.)-এর প্রতিনিধি যথারীতি ঐ চিঠি নিয়ে নাজরানের বিশপের কাছে পৌঁছে দিলেন।
চিঠি পেয়ে একটু অবাক হলেন বিশপ। তাঁকে এবং তাঁর জনগণকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়ে সুদূর মদীনা থেকে নবী মুহাম্মদ (সা.) চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, হয় শান্তির ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করে আনুগত্য স্বীকার করতে হবে নয়তো কর প্রদান করে বশ্যতা স্বীকার করতে হবে। অন্যথায় মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।
বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন বিশপ। একবার ভাবলেন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন। তাঁদের মানমর্যাদা তো কম নেই। জ্ঞান-গরিমায় গোটা খ্রিস্ট জগতে নাজরানবাসীরা অতুলনীয়। প্রয়োজন হলে সারা দুনিয়ার খ্রিস্টানরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু পরক্ষণে আবার ভাবলেন হুট করে বোকার মতো কোন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। মদীনার শাসনকর্তা সত্যিই যদি আল্লাহর নবী হয়ে থাকেন তাহলে তাঁর আহ্বান অমান্য করার পরিণতি অবশ্যই মারাত্মক হবে। অনেক ভেবে-চিন্তে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিভিন্ন জ্ঞানীগুণীদের নিয়ে একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করলেন তিনি।
অনেক আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো নাজরান থেকে একটি প্রতিনিধি দল পাঠানো হবে মদীনায়। সেখানে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে নবী করিম (সা.) সত্যিই আল্লাহর নবী কিনা।
ষাটজন শিক্ষিত ও জ্ঞানী খ্রিস্টানকে নিয়ে একটি দল গঠন করা হলো। এদের নেতৃত্ব দানের জন্য নির্বাচিত হলেন তিনজন বিশিষ্ট পাদ্রি। এরা হলেন নাজরানের প্রধান বিশপ আবু হারিস বিন আলকামা, মহাজ্ঞানী আবদুল মসিহ এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় আইহাম।
এই তিনজনের নেতৃত্বে নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধিদল মদীনার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। মদীনায় পৌঁছেই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন জাঁকজমক দেখিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে তাঁরা অবাক করে দেবেন। এই উদ্দেশ্যে প্রতিনিধিদল নিজেদের ভ্রমণজনিত মলিন পোশাক পরিধান করলেন। তারপর আঙ্গুলে সোনার আংটি ও গলায় ঝলমলে ক্রুশ ঝুলিয়ে বেশ আড়ম্বরের সাথে মহানবী (সা.)-এর সাথে দেখা করতে চাইলেন। মসজিদে গিয়ে তাঁরা নবী করিম (সা.)-কে অভিবাদন জানালেন।
কিন্তু মহানবী (সা.) তাদেরকে একবার দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। কোন কথা বললেন না। এতে প্রতিনিধিদলে নেতৃবৃন্দ দারুণ অবাক হয়ে গেলেন। ব্যাপার কী কিছুই বুঝতে পারলেন না। অপ্রস্তুত অবস্থায় মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলেন। নবী (সা.) স্বয়ং চিঠি দিয়ে তাঁদেরকে ডেকে এনেছেন আর এখন কী আচরণ করলেন! মনে মনে যেমন ক্ষুব্ধ হলেন তাঁরা তেমনি চিন্তিতও হলেন। নেতৃবৃন্দ অবশেষে তাঁদের পূর্ব পরিচিত হযরত ওসমান এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফের সাথে দেখা করলেন। তাঁদের কাছে অভিযোগ করে খ্রিস্টান নেতৃবৃন্দ বললেন, ‘এ কেমন ব্যবহার হলো। এভাবে অপমান করার জন্যই কি আপনাদের নেতা আমাদেরকে এখানে ডেকে এনেছেন?’
প্রথমে কিছু বুঝতে না পেরে হযরত ওসমান এবং হযরত আবদুর রহমান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। খ্রিস্টানরা ব্যাপারটা খুলে বলতেই তাঁরা দু’জনই বেশ অবাক হয়ে গেলেন। নবী (সা.)-এর এই আচরণের রহস্য তাঁরা বুঝতে পারলেন না।
‘রাসূলুল্লাহ (সা.) এ রকম ব্যবহার করলেন কেন? কিছুই তো বুঝতে পারছি না’- এভাবে তাঁরা মন্তব্য করতে লাগলেন।
‘তাহলে এখন কী করব?’ প্রধান বিশপ বললেন, ‘আমরা কি ফিরে যাব?’
হযরত ওসমান বললেন, ‘এক কাজ করুন। আপনারা তাড়াতাড়ি আমাদের ভাই আলী বিন আবি তালিবের কাছে চলুন। তিনি এ ব্যাপারে ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন।’
কথামতো তাঁরা সবাই হযরত আলী (রা.)-এর কাছে গিয়ে হাজির হলেন। সব শুনে হযরত আলী বললেন, ‘প্রথমেই তো ভুল করেছেন আপনারা। রেশমি পোশাক আর সোনার আংটি পরে আল্লাহর নবীর কাছে এসেছেন। এ কারণেই তিনি মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন। এগুলো খুলে ফেলে সাধারণ ভদ্রোচিত পোশাক পরে আপনারা হযরতের সাথে দেখা করুন। তাহলেই তিনি আপনাদের সাদরে গ্রহণ করবেন।’
হযরত আলীর পরামর্শ অনুযায়ী খ্রিস্টান প্রতিনিধিরা নিজেদের বিলাসী বেশভূষা ত্যাগ করে সাধারণ পোশাক পরে নবীজীর সাথে দেখা করতে গেলেন। এবার নবী করিম (সা.) তাঁদেরকে সাদরে গ্রহণ করলেন। হাসিমুখে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে নিজের পাশে বসালেন। তারপর সাহাবাদের উদ্দেশে বললেন, ‘যিনি আমাকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন সেই প্রভু আল্লাহর শপথ, প্রথমবার তাঁরা যখন এসেছিলেন তখন তাঁদের সাথে ছিল শয়তান।’
এরপর মহানবী (সা.) প্রতিনিধিদলকে কিছু ধর্মোপদেশ দান করলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করার আহ্বান জানালেন। প্রতিনিধি দল বললেন, ‘মহান এক সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসই যদি ইসলাম হয় তাহলে আমরাও তো তাঁকে বিশ্বাস করি।’
নবী করিম (সা.) বললেন, ‘আপনাদের কিছু কার্যকলাপই প্রমাণ করে আপনারা ইসলামে বিশ্বাসী নন। আপনারা ক্রুসের পূজা করেন, শুকরের গোশত খান আর আল্লাহর ছেলে রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন। তাহলে কিভাবে তাওহীদী আদর্শে বিশ্বাসী হলেন আপনারা?’
খ্রিস্টানরা বললেন, ‘আমরা হযরত ঈসা (আ.)-কে খোদা বলে বিশ্বাস করি। কারণ, তিনি মৃতকে জীবন দান করেছেন, রোগীকে আরোগ্য দান করেছেন এবং এমনকি কাদামাটির তৈরি পাখির দেহেও জীবন দিয়েছেন। এ থেকেই প্রমাণিত হয় তিনি খোদা।’
নবী (সা.) বললেন, ‘কখনো নয়। তিনি তো একজন আল্লাহর বান্দা মাত্র। হযরত মারইয়াম (আ.)-এর গর্ভে আল্লাহ তাআলা তাঁকে রেখেছিলেন। আল্লাহই তাঁকে সব ক্ষমতা ও শক্তি দান করেছিলেন।’
প্রতিনিধি দল বলে উঠলেন, ‘অবশ্যই হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র। কারণ, কোন পিতা ছাড়াই কুমারী বিবি মারইয়ামের গর্ভে তাঁর জন্ম হয়েছিল।’
ঠিক এই সময় মহানবী (সা.)-এর কাছে আল্লাহর ওহী নাযিল করেন। হযরত (সা.) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন, ‘হযরত ঈসা (আ.)-এর ব্যাপারটা হযরত আদম (আ.)-এর মতো। হযরত আদম (আ.)-কে আল্লাহ তাআলা কোন পিতামাতা ছাড়াই কাদামাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। পিতা ছাড়া জন্ম গ্রহণ করলে যদি আল্লাহর পুত্র হবার সম্ভাবনা থাকে তাহলে হযরত আদমই তো তার অধিক যোগ্য। কারণ, তিনি পিতা এবং মাতা উভয় ছাড়াই জন্ম গ্রহণ করেছেন।’
নবী (সা.)-এর এ রকম অকাট্য যুক্তি শুনে কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন তাঁরা। কি জবাব দেবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না। পরক্ষণে পাদ্রিরা চিন্তা করলেন, এভাবে পরাজয় স্বীকার করা চরম লজ্জাকর ব্যাপার। খ্রিস্টসমাজে তাঁরা মুখ দেখাবেন কী করে। তাই নবীজীর যুক্তিকে সরাসরি অস্বীকার করে তাঁরা বললেন, ‘আমরা আপনার যুক্তি মানি না। আপনার ব্যাখ্যা আমাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।’
মহানবী (সা.) খ্রিস্টান পাদ্রিদের কথা শুনে অবাক হলেন। যারা যুক্তি মানতে চায় না তাদেরকে বুঝানো তো খুবই মুশকিল। ঠিক এমনি সময় আল্লাহর প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হলো। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা খ্রিস্টানদের এই ধৃষ্টতার চ্যালেঞ্জ করে বললেন, ‘হে নবী! আপনার কাছে সুস্পষ্ট জ্ঞান আসার পরেও কেউ যদি তর্ক করে তাহলে (তাদেরকে) বলে দিন, এসো একত্র হই আমাদের সন্তানদের আর তোমাদের সন্তানদের নিয়ে, আমাদের নারীদের আর তোমাদের নারীদের নিয়ে আর আমাদের নিজেদের নিয়ে আর তোমাদের নিজেদের নিয়ে। তারপর প্রার্থনা জানাই একান্ত মনে এবং আল্লাহর অভিশাপ কামনা করি তাদের ওপর যারা মিথ্যাবাদী।’ (আলে ইমরান : ৬১)
আল্লাহ তাআলার আদেশ পেয়ে নবী (সা.) খ্রিস্টান নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনারা যদি কোন যুক্তিই স্বীকার করতে না চান তাহলে আসুন মোবাহালা (অভিসম্পাত) করি। তাহলেই কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী তার ফয়সালা হয়ে যাবে।’
মোবাহালা হলো দুই পক্ষের মধ্যে কোন সত্য বিষয় নিষ্পন্নের উদ্দেশ্যে আল্লাহকে সাক্ষী রেখে পরস্পর পরস্পরের জন্য অভিশাপ প্রার্থনা করা। এতে যে পক্ষ মিথ্যাবাদী সেই পক্ষের ওপর আল্লাহর গজব নাযিল হয়।
নবী করিম (সা.) শেষ পর্যন্ত মোবাহালার আহ্বান জানালে খ্রিস্টানরা ভড়কে গেল। পাদ্রিরা জানতেন যে, হযরত ইবরাহীমের পুত্র হযরত ইসমাইলের বংশে একজন মহানবীর আবির্ভাব ঘটবে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) যে সেই নবী তারও কিছুটা আভাস তাঁরা পেয়েছিলেন। তবু জিদের বশে তাঁরা নিজেদের আভিজাত্য ও বংশমর্যাদা ছেড়ে অন্য কারো আনুগত্য স্বীকারে রাজি ছিলেন না। এখন মোবাহালায় অংশ না নিলে মান-সম্মান বজায় থাকে না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মোবাহালায় অংশগ্রহণ করতে রাজি হলেন। ঠিক হলো পরদিন শহরের বাইরে মরুভূমির এক নির্দিষ্ট স্থানে এই মোবাহালা অনুষ্ঠিত হবে।
মোবাহালার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। মদীনার সর্বসাধারণের মাঝে একটা উত্তেজনা জেগে উঠল। খ্রিস্টান জনগণ ভাবল এবার মুসলমানদের দফা রফা হবে। এখন খোদ নাজরানের নেতৃস্থানীয় লোকদের মোকাবেলা করতে হবে নবী করিম (সা.)-কে। মদীনার ইহুদিরা তো বেশ আনন্দিত হলো এই ভেবে যে, এবার মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মধ্যে লড়াই হবে। মুসলমানরা ভালো করেই জব্দ হবে। মুহাম্মদ (সা.)-এর হাতে খ্রিস্টানরা নাজেহাল হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। তবে খ্রিস্টানরা জয়ী হলে তাদের লাভ। সুদী ব্যবসায় কেউ তাদের বাধা দেবে না। অপরদিকে মদীনার মুসলমানদের মাঝে চরম এক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা গুমরে মরছে। না জানি কী হয়। মনে মনে তারা প্রার্থনা করছে- হে আল্লাহ! আমাদের মুখ উজ্জ্বল কর, নাসারাদের হাতে মুসলমানদের অপদস্থ কর না। আমাদের প্রিয় নবীকে তুমি জয়যুক্ত কর। হে প্রভু! দীন ইসলামের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত কর।’
পরদিন যথাসময়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) মোবাহালার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। আল্লাহ তাআলার নির্দেশ অনুযায়ী নিজেদের সন্তান হিসাবে ইমাম হাসান (রা.) ও হোসাইন (রা.)-কে, নিজেদের নারী হিসাবে হযরত ফাতেমা (রা.)-কে এবং নিজেদের সত্তা হিসাবে হযরত আলী (রা.)-কে সঙ্গে নিলেন। তারপর দু’হাত তুলে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! এরাই আমার পরিজন, আহলে বাইত, এদেরকে তুমি কবুল কর।’
পরিবারের আর কাউকে তিনি সঙ্গে নিলেন না, শুধু চারজনকে নিয়ে রওয়ানা হলেন মোবাহালার উদ্দেশ্যে। নবী করিম (সা.) ইমাম হাসানকে একহাতে ধরলেন, ইমাম হোসাইনকে বুকে তুলে নিলেন। তাঁর পিছনে নিলেন হযরত ফাতেমা (রা.)-কে। তাঁর পিছনে থাকতে বললেন হযরত আলী (রা.)-কে। সবাইকে বলে দিলেন, “আমি যখন দোয়া শুরু করব তখন তোমরা সবাই ‘আমীন, আমীন’ বলবে।”
এদিকে খ্রিস্টান পাদ্রিদের মাঝে এক নিদারুণ অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতটুকু আত্মবিশ্বাসও তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন। হুট করে মোবাহালায় রাজি হয়ে যাওয়া একেবারেই ঠিক হয়নি। সত্যিই যদি মুহাম্মাদ (সা.) নবী হয়ে থাকেন তাহলে তো মোবাহালায় খ্রিস্টানদের ধ্বংস অনিবার্য। এই আশঙ্কাজনক অবস্থায় পাদ্রিরা নবী (সা.)-কে তাঁর সাথিদের নিয়ে আসতে দেখলেন। নবী ও তাঁর আহলে বাইতের সদস্যদের চেহারা দেখেই পাদ্রিরা ভড়কে গেলেন। তাঁদের চেহারায় কী যেন এক নূরানী দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। স্বর্গীয় সুষমায় দীপ্তিমান তাঁদের মুখম-ল। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান আহলে বাইতের অবয়ব জুড়ে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। নবী করিম (সা.)-এর চেহারা মুবারকে অপূর্ব স্বর্গীয় আভা। তাঁর গভীর প্রশান্ত দৃষ্টিপাতে ম্লান হয়ে যায় অন্য সব অভিব্যক্তি।
দৃপ্ত, অকুতোভয় নবী (সা.) ও তাঁর সাথিদের দেখে বাস্তবিকই কম্পন শুরু হয়ে গেল খ্রিস্টান পাদ্রিদের। প্রধান পাদ্রি তাঁর সাথিদের উদ্দেশ্যে বললেন : ‘তাঁদের চেহারা দেখেছ? কেমন নির্ভীক আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান। কেমন যেন স্বর্গীয় দ্যুতি চমকাচ্ছে তাঁদের অবয়ব জুড়ে। আমার তো মনে হয় তাঁরা যদি আল্লাহর কাছে এই বিশাল পর্বতটাও স্থানচ্যুত হয়ে চলে আসতে প্রার্থনা করেন তাহলে তাই কবুল হয়ে যাবে। ইনি সত্যি নবী না হলে এ রকম দৃঢ় আস্থার সাথে অতি আপনজনদের নিয়ে মোবাহালা করার জন্য এগিয়ে আসতেন না। আমাদের উচিত অবিলম্বে মুহাম্মাদের সাথে আপোস করা। অন্যথায় মোবাহালার মাধ্যমে খ্রিস্টান জাতির অস্তিত্বও দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।’
অন্য পাদ্রিরাও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। উপায়ান্ত না দেখে প্রধান পাদ্রির সাথে একমত হলেন। তাঁরা সকল পাদ্রি একযোগে নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নিকট এসে করজোড়ে বললেন, ‘জনাব! বেয়াদবি হয়ে গেছে, আমাদের মাফ করে দিন। মোবাহালা থেকে আমাদের অব্যাহতি দিন। এর বদলে আপনার দেয়া সকল শর্ত মানতে আমরা রাজি আছি।’
নবী (সা.) মৃদু হেসে বললেন, ‘তাহলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন না কেন?’
পাদ্রিরা বললেন, ‘জানি আপনি সত্যিই নবী। তবে এই মুহূর্তে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা থেকে আমাদেরকে রেহাই দিন। অন্য যে কোন শর্ত মানতে আমরা রাজি আছি।’
খ্রিস্টানদের এ রকম হঠাৎ নতি স্বীকারের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মুসলমানরা খুশিতে আত্মহারা হলো। আল্লাহ তাআলার দরবারে তারা অশেষ ধন্যবাদ জানাল। দুনিয়ার বুকে মুসলমানদের মুখ আজ উজ্জ্বল হয়েছে। ইসলাম যে একমাত্র আল্লাহর মনোনীত ধর্ম তা আবারো সকলের সামনে প্রমাণিত হয়েছে। অন্য সকল ধর্মের ওপর বিজয় লাভ করেছে ইসলাম। তাই এই দিনটি হয়ে উঠল মুসলমানদের জন্য একটি খুশির দিন।
এ দিন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাফির-মুশরিকদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে ইসলাম ধর্মের সত্যতাকে জগৎবাসীর কাছে তুলে ধরেছেন। তাই ইসলামের ইতিহাসে এ এক মহা বিজয়ের দিন। তাছাড়া এই ঘটনার মাধ্যমে নবী করিম (সা.)-এর প্রকৃত আপনজন বা আহলে বাইত কারা তাও মুসলমানদের মাঝে চিহ্নিত হয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলার স্পষ্ট নির্দেশেই তিনি পবিত্র পাঁচজনকে নির্দিষ্ট করে নিয়েছেন।
যাহোক, শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ জিজিয়া (কর) ধার্যের মাধ্যমে খ্রিস্টানদের অব্যাহতি দেয়া হয়। নিয়মিত এই কর প্রদানের মাধ্যমে তারা ইসলামী রাষ্ট্রে নিরাপদে বসবাসের নিশ্চয়তা গ্রহণ করে।
-কেএল