আওয়ার ইসলাম: দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ব্যাপক হারে বাড়ছে। রাজধানী ঢাকায় অনেক কোভিড-১৯ রোগী হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি হতে পারছেন না বলে অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার কারণে হাসপাতালগুলো ইতোমধ্যে পূর্ণ হয়ে গেছে। চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হাসপাতালগুলোর ওপর যে হারে চাপ বাড়ছে, তাতে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা সেবা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
সংক্রমণ অব্যাহত বাড়তে থাকায় গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার জন। এক দিনে মৃত্যু হয়েছে ৫৯ জনের।
ঢাকায় একের পর এক সরকারি হাসপাতালে ঘুরেও একজন যুবক তার বাবাকে ভর্তি করাতে পারেননি। তাদের বাড়ি বগুড়ায়। বগুড়ায় তিন দিন আগে তার বাবার করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হয়। তখন থেকেই শ্বাস কষ্ট দেখা দেয়। অক্সিজেন দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে তিনি তার বাবাকে ঢাকায় এনে একটি শয্যার জন্য হাসপাতাল হাসপাতালে ঘুরতে থাকেন। সরকারি হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে তিনি তার বাবাকে ভর্তি করিয়েছেন। ওইখানেও তার ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে।
নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ওই যুবক বলেন, ঢাকাতে প্রায় ১০টা হাসপাতালকে নক করেছি। সবাই বলতেছে, সিট খালি নাই। এর মধ্যে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে সিট হবে বলে কনফার্ম করা হয়। কিন্তু যাওয়ার পরে তারা বলতেছে, ওখানে ইয়োলো জোনে বা নির্ধারিত সাধারণ ওয়ার্ডে কোনো সিট খালি নাই। তিনি আরো বলেন, ‘আরেকটা প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করার পর ওইখানে ভিন্ন অভিজ্ঞতা হলো। তারা রোগীর অবস্থা না জেনেই সিসিইউতে ভর্তি করে। কিন্তু তার সিসিইউর দরকার ছিল না। তারা জানায়, সাধারণ সিট খালি নাই। সিসিইউতেই রোগী রাখতে হবে। তখন আমরা আরেকটা প্রাইভেট হাসপাতালে বাবাকে নিয়ে ভর্তি করলাম।’
ঢাকার মালিবাগ এলাকার একজন গৃহিনী করোনাভাইরাস আক্রান্ত তার স্বামীকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন কয়েক দিন আগে। কোভিড-১৯-এর জন্য নির্ধারিত সাধারণ ওয়ার্ডে রেখে তাকে হাই-ফ্লো অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই গৃহিনী জানিয়েছেন, তার স্বামীর মুমূর্ষু অবস্থায় আইসিইউতে নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু হাসপাতালটিতে আইসিইউর ১৬টি শয্যাতেই রোগী থাকার কারণে তাদের অন্য কোনো হাসপাতালে রোগীকে নিতে বলা হয়েছে। তারা টাকার অভাবে বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন না।
এ দিকে রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকরাও রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক নাদিরা হক বেসামাল বলেন, ‘হঠাৎ রোগীর ফ্লোটা বেড়ে গেছে হাসপাতালে। বর্তমানে আমাদের কোনো বেড খালি নাই। আমাদের আইসিইউতে ১৬টি বেডেই রোগী আছে। অনেক কাজের চাপ। প্রতিদিনই নতুন রোগী আসছে। অনেক রোগী আমাদের বাইরে থেকেও টেলিফোন করছে আইসিইউ শয্যার জন্য, যাদের আমরা বেড দিতে পারছি না।’
ডা: নাদিরা হক আরো বলেন, ‘আমাদের ওয়ার্ডেও বেশ কিছু ক্রিটিক্যাল রোগী আছে, যারা প্রতি মিনিটে ১৫ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন নিচ্ছেন। তাদেরও অনেকের আইসিইউ সাপোর্ট দরকার। কিন্তু আমরা দিতে পারছি না।’
ঢাকায় কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সরকারি ১০টি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা আছে ১০৪টি। এর মধ্যে মাত্র চারটি শয্যা খালি ছিল গত ২৪ ঘণ্টায়। আর নির্ধারিত বেসরকারি নয়টি হাসপাতালে ৩৭৬টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে খালি ছিল ৪৭টি। বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার জন্য বড় অঙ্কের অর্থ গুণতে হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেছেন, ৩৩টি জেলায় সংক্রমণ দ্রুত হারে বাড়ছে। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণের যে হার তার ৪০ ভাগেরও বেশি রোগী ঢাকাতেই।
একটি বেসকারি হাসপাতালের কর্ণধার ডা: লেলিন চৌধুরী বলেছেন, ঢাকার বাইরে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলো বাদ দিয়ে অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা ও আইসিইউ ব্যবস্থাপনা উন্নত না হওয়ায় অনেক কোভিড-১৯ রোগী চিকাৎসার জন্য ঢাকায় আসছে।পরিস্থিতি সামলাতে এখনই ব্যবস্থা না নেয়া হলে চিকিৎসা সেবা ভেঙ্গে পড়তে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।
তিনি মনে করেন, গত বছর করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কার পর চিকিৎসা ব্যবস্থায় অবকাঠামোসহ বিভিন্ন সুবিধা কিছুটা বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু তারপরে যে পরিমাণে বাড়ানো দরকার ছিল, তা হয়নি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অতিরিক্ত ১০টি আইসিইউ শয্যার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেছেন, ঢাকা সরকারি হাসপাতালগুলোতে আড়াই হাজার সাধারণ শয্যা ও বেসরকারি হাসপাতালগুলো এক হাজারের বেশি শয্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
একইসাথে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে করোনার ভয়াবহতার ইঙ্গিতও এসেছে। তিনি বলেন, ‘করোনায় সংক্রমণ গত এক সপ্তাহ ধরে ব্যাপকহারে বাড়ছে। মৃত্যুর হারও বেড়ে গেছে। প্রতিদিন যদি পাঁচ হাজার করে শনাক্ত হয়, তার একটা অংশ যদি হাসপাতালে আসে, তাহলে হাসপাতালে জায়গা করা সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যেই হাসপাতালগুলো প্রায় ভরে গেছে।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে, হাসপাতালের বেড বাড়িয়ে আমরা কিন্তু রোগী সংকুলান করতে পারবো না। উৎপত্তি স্থলগুলোকে যদি আমরা বন্ধ না করি লাভ হবে না। কারণ ঢাকাতে দেড়-দুই কোটি মানুষ বাস করে। ফলে পুরো ঢাকা শহরকেই হাসপাতালে কনভার্ট করলেও কিন্তু রোগী সংকুলান হবে না।’
হাসপাতালের ওপর চাপ কমাতে করোনাভাইরাসে প্রতিরোধের ব্যাপারে জোর দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। সরকারও ১৮ দফা নির্দেশনাসহ বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ রয়েছে।
সূত্র: বিবিসি
এনটি