মাওলানা মোঃ আব্দুল মান্নান।।
অফুরন্ত রহমত বরকত ফজিলত ঘরে তুলতে ও সীমাহীন নিয়ামত হাসিল করতে বিশ্ব মুসলিমের জন্য শবে বরাত একটি যথাপোযুক্ত রাত। এ রাতকে অবহেলা করা উচিৎ নয়। ১৪ শাবান দিবাগত রাতকেই শবে বরাত বলা হয়। ফার্সি শব্দ ‘শব’ অর্থ রাত আর ‘বরাত’ অর্থ ভাগ্য বা মুক্তি।
‘শবে বরাত’ অর্থ ভাগ্য রজনী বা মুক্তির রাত। আরবীতে ইহাকে লাইলাতুল বারাআতও বলা হয়। যেহেতু এই রাতে আল্লাহ্ সুবহানাহু তা’য়ালা অসংখ্য পাপীকে ক্ষমা করে, রোগীকে রোগ মুক্ত করে, ঋণীকে ঋণ মুক্ত করে, বিশেষ আবেদনকারীর আবেদন পূরণ করে দেন; শুধু তাই নয়, অভাবীদের অভাব পূরণের জন্য তিনি লোকদেরকে আরও কাছে ডেকে আনেন। যেন মায়া মমতা মাখানো কণ্ঠে বলেন, তোমাদের কার কি অভাব বা অসুবিধা রয়েছে? তোমরা আস। এসে আমাকে জানাও। আমি তোমাদের অভাব পূরণ করে দেব। অসুবিধা দুর করে দেব। মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে অসহায় বান্দার প্রতি সহমর্মী হয়ে মমতাবোধ নিয়ে এমনভাবে ডাকা বান্দার জন্য কি ভাগ্যের ব্যাপার নয়? অভাব ও আশা প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে রাজা নিজেই যদি প্রজাকে ডাকেন বা স্মরণ করেন তবে নিশ্চয়ই তা ভাগ্যের ব্যাপার। তখন আমরা এমন রাতকে কি বলব? নিশ্চয় ভাগ্য রজনী বলতে পারি।
এ রাতে আগামী বছরে কে জন্ম নিবে, কে মৃত্যুবরণ করবে, কার রিযিক কোথায় কি পরিমাণ থাকবে ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করা হয়। তাই এ রাতে বেশি করে ইবাদাত করে মাওলাকে খুশি করা উচিত। ইবাদাতে মাশগুল হওয়া উচিত। যাতে তিনি আমার পক্ষে লিখেন। আমার ভাগ্যকে সুপসন্ন করে দেন। ইবাদাতে মাশগুল না হয়ে বা আল্লাহ্র সিদ্ধান্তের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করে বরং এক শ্রেণীয় লোকেরা ঠাট্টা বিদ্রুপ করে বলে ফেলেন, সারা রাত আল্লাহ্ ধনীদের দিয়ে শেষ করেন।
সকাল বেলায় আমরা গরীবদের ভাগ্য ডট ডট (’’) দিয়ে রাখছেন অর্থাৎ তরাড্ডি আগের মতই। যারা রিক্সা চালায় তারা রিক্সাই চালাবে, যারা কুলিগিরি করত তারা কুলিগিরিই করবে। গরীবের ভাগ্যের পরিবর্তন নেই। কিন্তু মূলত বিষয়টি এমন নয়। আল্লাহ্ কখনও পক্ষ পাতিত্ব করেন না। বরং যে একেবারে ইবাদাত করে না তাকেও তিনি বি ত করেন না সুযোগ দেন।
এ রাত সম্পর্কে হযরত নাবী কারিম (সঃ) ফরমায়েছেন, যখন শাবান মাসের ১৫ তারিখ উপস্থিত হয় তখন তোমরা ঐ রাতে নামায পড় এবং ঐ দিনই রোজা রাখ। কেননা আল্লাহ্ তায়ালা ঐ সূর্যাস্তের সময় প্রথম আসমানে অবতরণ করে বলতে থাকেন, তোমাদের মধ্যে কে আছ ক্ষমা প্রার্থী? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।
কে আছ রিযিক প্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দান করব। কে আছ বিপদগ্রস্থ? আমি তার বিপদ দূর করব কিন্তু আমরা কি এখলাসের সাথে যথাযথভাবে তা পালন করি? ইবনে মাজাহ শরীফে আছে এভাবে আল্লাহ সুবহানা তায়ালা বান্দাকে ফজর পর্যন্ত আদরের সাথে ডাকতে থাকেন। আমাদের মাওলা কতইনা দয়ালু! এ মাসে রোজা রাখার জন্য নাবী করিম (সঃ) উৎসাহ দিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি এ মাসে তিনটি রোজা রাখবে আল্লাহ তায়ালা তাকে বেহেশতি উঠে আরোহন করিয়ে কবর হতে উঠাবেন। আম্মাজান আয়শা সিদ্দিকা (রাঃ) বলেন, শাবান মাসে হুজুর (সঃ) এত বেশি রোজা রাখতেন যে অন্য কোন মাসে তিনি তা রাখেননি।
সাথে সাথে হুজুর (সঃ) বেশি বেশি দান করতেও বলছেন। শবে মেরাজ, শবে বরাত, শবে কদর ও দুই ঈদের রাত হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী খুবই রহমতপূর্ণ, বরকমময় ও মাগফেরাতের রাত। এসব রাতে রাহমানুর রাহীম আল্লাহ বান্দার প্রতি অত্যন্ত দয়া পরবশ থাকেন। বান্দার সার্বিক বিষয়গুলো যত্নসহকারে দেখেন ও ব্যবস্থা নেন। তারপরও কিছু অপদার্থ লোক আছেন যাদের প্রতি তিনি এতই অসন্তোষ্ট থাকেন যে তাদেরকে ক্ষমা করেন না। এরা হল যাদুকর, শরাবখোর, যিনাকারী, আত্মীয়তা ছিন্নকারী, মা-বাবার অবাধ্য নাফরমান সন্তান, পরনিন্দাকারী, ইয়াতিম-অনাথ বিধবার মাল ভক্ষণকারী, কৃপণ, হিংসুক এগুলো আল্লাহর দুশমন।
তিনি যেন এদেরকে সহ্য করতে পারেন না। তবে কান্না-কাটি করে চোখের পানি বের করত: তাওবা করলে এবং এসব গুনাহ আর না করার প্রতিজ্ঞা করলে আল্লাহ এদেরকেও মাফ করতে পারেন। হাদীসের ব্যাখ্যায় রয়েছে, এ রাতে সালাতুত তাসবীহসহ যে কোন নফল নামায যে কোন সুরা দিয়ে যত রাকাত সম্ভব পড়তে পারেন।
নফল নামায ঘরে পড়া উত্তম। তাই বলে মসজিদে গিয়ে পড়তে পারবেন না, তা নয়। মসজিদেও পড়তে পারেন। তবে সতর্ক থাকতে হবে যাতে কোনভাবেই কোন প্রকার উচ্চ আওয়াজ ঝগড়াঝাটি ইত্যাদি অনিয়ম বেয়াদবি না হয়। রজব মাস আসলেই আল্লাহর রাসুল এ দোয়া বেশী বেশী করে পড়তেন ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রাজাবা ওয়া শা’বান ওয়া বাল্লিগনা রামাদ্বান।
এ দোয়ার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি রমজান মাস আর বেশি দূরে নয়। ঐ মাসে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যেসব অফুরন্ত সাওয়াব রেখেছেন উহা যেন আমরা পেতে পারি, সে মাস পর্যন্ত তিনি যেন আমাদের হায়াত দারাজ করেন এ জন্য বেশি বেশি দোয়া করা ও সার্বিকভাবে আমাদের প্রস্তুত হওয়া উচিত।
শবেবরাতের ইবাদতে বাচ্চারাও অংশ গ্রহন করতে পারে। যেহেতু এসব রাতগুলোকে ইবাদতের বা নেকী কামায়ের সীজন বলা হয়। সীজনাল সুবিধাগুলো লাভ করতে ঘরে মহিলারাসহ ছেলে মেয়ে সবাইকেই আমরা উৎসাহিত করব। তবে ছোট বাচ্চাদেরকে মসজিদে আনার আগে বাসা থেকে বুঝিয়ে আনতে হবে, যাতে কোন প্রকার গন্ডগোল না করে।
এ রাতে ইবাদাতে বাঁধা সৃষ্টি হয় এমন কাজ করা যাবে না। ছোট বেলা থেকেই আমরা বাচ্চাদেরকে এসব বিষয়ে শিক্ষা দেবার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ। কাজেই শবেবরাত উপলক্ষে এই রজনীতে শিন্নি-ফিন্নি, খাবার-দাবার, তবারক বা কোন প্রকার বিদআতি রেওয়াজ অনৈসলামিক কাজকর্ম পরিহার করতে হবে।
ইবাদাতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়, এমন কাজ নিয়ে ব্যস্ত হওয়া, হৈচৈ বা গন্ডগোল করা যাবে না। যিকির আযকার, দান সদকা, তিলাওয়াত, কবর যিয়ারত, দরুদ, তওবা, ইস্তিগফার, নামায, মুনাজাত ইত্যাদি বিভিন্ন ইবাদতের প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত। আতশবাজি করা, কবর স্থানে মোমবাতি জ্বালানো, আগর বাতি জ্বালানো, রং ছিটানো ইত্যাদি বর্জন করতে হবে। এতে সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা সকল মুসলমান নরনারীকে শবে বরাতের বরকত ও ফজিলত হাসিল করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমীন।
লেখক: প্রিন্সিপাল, দারুল ইহসান কাসিমিয়া (এক্সিলেন্ট) মাদ্রাসা, সরকারি কলেজ রোড, ফুলপুর, ময়মনসিংহ।