মুহাম্মদ হাসান মুরাদ।।
গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে একজন শিক্ষক এক ছাত্রকে প্রচুর প্রহার করছে, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। এমন অপ্রীতিকর ঘটনা মাঝে মধ্যেই দেখা যায়। গত বছর যশোর শিুশু আশ্রমকেন্দ্রে কর্তৃপক্ষের আঘাতে মৃতোর ঘটনাও ঘটেছে। এটা খুবই মর্মান্তিক ব্যাপার। বাচ্চাদের শাস্তির বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা জানতে পাকিস্তানের বিশিষ্ট আলেম আল্লামা ইউসুফ বান্নুর রহ. প্রতিষ্ঠিত ‘জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়া’ নিউ টউন এর ফতোয়া বিভাগ থেকে প্রাপ্ত ফতোয়াটি এখানে অনুবাদ করা হল। (ওয়েব সাইট থেকে অনুবাদ)
বর্তমানে স্কুল,মাদরাসাতে কছিু শিক্ষক ছাত্রদের প্রহারসহ বিভিন্ন শাস্তি দেয় এবং এর ফজিলত বর্ণনা করে, বলে শরিরের যে অংশে উস্তাযের প্রহার পড়েছে সে অংশ জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না। ছাত্রদের এমন শাস্তি দেয়া,ফজিলত বলা কি ইসলাম সমর্থন করে?
উত্তর- (ক) ছাত্রদের পড়ানো এবং ইসলামি পদ্ধতিমত তরবিয়ত করা অত্যন্ত নেকির কাজ।শরিয়ত নেক কাজের বর্ণনার সাথে কিছু শর্ত আরোপ করে থাকে। এবং সে নেক কাজের একটি সীমারেখা উল্লেখ করে।সুতরায় সে নেক কাজে যদি নিয়ম এর বিপরীত করা হয় তাহেল সে নেক কাজও বিপদের কারণ হয়। বাচ্চাদের শিক্ষা-দিক্ষার ক্ষেত্রে নম্রতা এবং মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা হল ইসলামের মূলনীতি। রেগে গিয়ে অতিরিক্ত প্রহার করা এবং প্রহার কে একেবারেই অপছন্দ করা দুটোই নিন্দনীয়। বাচ্চাদের আদর-সোহাগ যেমন প্রয়োজন, অনুরুপ কিছুটা কঠরোতাও প্রয়োজন।
হাদীস শরিফে এসেছে রাসুল স. বলেন বাচ্চাদের বয়স ৭বছর হলে সালাতের আদেশ কর। বয়স ১০ বছর হলে, সালাত আদায় না করলে তাদের প্রহার করো(আবুদাউদ শরীফ,সালাত অধ্যায় ১৩৩/১)। অন্য হাদীসে এসেছে ইবনে আব্বাস রা. বলেন রাসুল স. ইরশাদ করেন ঘরের এমন স্থানে লাঠি ঝুলিয়ে রাখ যেখানে বাড়ির সবার নজর পড়ে, কারণ এটা তাদের শিক্ষার মাধ্যম( আল-মুজামুল কাবির-২৮৪/১০)।
ইমাম বুখারি রহ. উল্লেখ করেছেন, ইবনে আব্বাস রা. হযরত ইকরিমা রা.কে ফরজ,সুন্নাত এবং কুরআন শিক্ষার জন্য বেধে রাখতেন। হযরত ইকরিমা বর্ণনা করেন কোরান-সুন্নাহ শিক্ষার জন্য ইবনে আব্বাস রা. আমার পায়ে শিকল পরাতেন (তবাকাতে কুবরা ইবনে সাদ)২১৯/৫) । এসব বর্ণনা থেকে বোঝা যায় প্রয়োজনে উস্তাযগণ ছাত্রদের সতর্ক এবং ব্যক্তিগঠনের উদ্দেশ্যে স্বাভাবিক শাস্তি দিতে পারেন। তবে ফুকাহাগণ শাস্তি দানের জন্য কিছু শর্ত আরপ করেছেন। শাস্তির ক্ষেত্রে এ সকল শর্ত পালন খুবই জরুরি।
১ . শাস্তির জন্য ছাত্রদের অভিভাক থেকে অনুমতি নিতে হবে।
২ . শাস্তির উদ্দেশ্য হবে ছাত্রের ব্যক্তিগঠন। নিজের রাগ বা প্রতিশোধের জন্য নয়।
৩ .শরিয়ত নিষিদ্ধ এমন কোন শাস্তি দিবে না।
৪ .রাগান্বিত অবস্থায় প্রহার করবে না বরং রাগ প্রশমিত হলে রাগের ভান করে শাস্তি দিবে।
৫ . সহ্য ক্ষমতার বাইরে শাস্তি দিবে না।
৬ .প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ থেকে শাস্তির অনুমোদন থাকতে হবে।
৭ . হাত দ্বারা প্রহার করবে। লাঠি,ডান্ডা দ্বারা প্রহার করবে না।
৮ . এক সময় ৩টির অধিক প্রহার করবে না। এবং একই স্থানে ৩টি মারবে না বরং ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রহার করবে।
৯ .মাথা,চেহারা এবং লজ্জাস্থানে প্রহার করবে না।
১০ . ভালোমন্দ বোঝার বয়স হয়নি এমন ছাত্রকে প্রহার করবে না।
১১ . এমন শাস্তি যার কারণে হাত-পা ভেঙ্গে যায়,চামড়া ফেটে যায়, কালো দাগ পড়ে যায় অথবা দিল বা শরিরের স্পর্শকাতর স্থানে শাস্তির প্রভাব পড়ে এমন শাস্তি শরিয়তে জায়েয নেই।
১২ . অপরাধের পরিমান অনুপাতে শাস্তি দিবে। জুলুম করবে না।
হা যদি বিশেষ প্রয়োজনে শাস্তির প্রয়োজন হয় তবে তাকে ধমক দিবে,হালকা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে,কান ধরাবে সর্বপরি হাত দ্বারা মৃদু আঘাত করবে। আবাসিক ছাত্রদের ছুটি বাতিল করবে।দাড় করিয়ে রাখবে ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে ছত্রদের আদর-সোহাগ দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। অতিরিক্ত প্রহার পড়া-লেখার অন্তরায়। অনেক সময় অতিরিক্ত প্রহারের কারণে ছাত্ররা অবাধ্য হয়ে যায়। আমাদের প্রিয় নবি সা. সাহাবাদের দ্বীন শিখিয়েছন নম্রতা এবং ভালোবাসা দিয়ে। তাকওয়া দিয়ে গড়েছেন। নিজের খাদেমের সাথেও কখনো শক্ত কথা বলেন নি।
ফতুয়ায়ে শামিতে উল্লেখ করা হয়েছে উস্তায কখনো ৩টির অধিক প্রহার করবে না। কেননা রাসুল সা. ইরশাদ করেন তোমরা তিনের অধিক প্রহার করা থেকে সতর্ক থাক, কারণ তুমি যদি তিনের অধিক প্রহার করো তবে আল্লাহ তোমার প্রতিশোধ নিবেন। (ফতোয়ায়ে শামি কিতাবুস সালাত অধ্যায় ১/৩৫২)
আরো উল্লেখ আছে অন্যায় ভাবে শাস্তির কারণে যদি অঙ্গ ভেঙ্গে যায় বা চামড় কালচে দাগ পড়ে যায় তবে শাস্তি দাতার ওপরই শাস্তি ওয়াজিব।(শামি,কিতবুল হুদুদ অধ্যায় ৭৯/৪) সুরাতং বাচ্চাদের শাস্তিদানে সতর্ক থাকেত হবে অন্যথা দুনিয়াতে বেঁচে গেলেও আল্লাহর আদালতে রেহায় পাওয়া যাবে না। (খ)শরিরের যে অংশে উস্তাযের প্রহার পড়েছে সে অংশ জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না। এটা কোন হাদীসের কিতাবে খুজে পাওয়া যায়নি সুতরাং এমন ফযিলত কখনো বলা যাবে না। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। আমিন!
-কেএল