দরজায় কড়া নাড়ছে কওমি মাদরাসার বিভিন্ন জামাতের কেন্দ্রীয় পরীক্ষা। তাই অল্প সময়ে পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করার কলাকৌশল বিষয়ে অনলাইন সংবাদ মাধ্যম আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম আয়োজন করেছে পরীক্ষা বিষয়ক শিক্ষাপরামর্শ ‘পরীক্ষার ভালো প্রস্তুতি ও সেরা ফলাফলের কৌশল’। ধারাবাহিক পর্ব- ১৯
লিখছেন দারুল উলুম রামপুরা বনশ্রী মাদরাসার উস্তাযুল হাদিস, দারুল উলুম দেওবন্দের ফাজেল ‘মাসুম আবদুল্লাহ’।
(গত পর্বের পর)
মূল ফসল ও আসল অর্জন কুড়াবার আরেকটি মূল জামাত মিশকাত জামাত। কুরআন-হাদিস তথা ইসলামি জ্ঞানভান্ডার থেকে উপকৃত হবার যোগ্যতা লাভের জন্যে বিগত বছরগুলোর পড়াশোনা। আর মিশকাত জামাত থেকে শুরু হয়ে যায় মূল লক্ষ্য ইলমে ওয়াহি হাসিলের পথযাত্রা।
তাই অন্য জামাতের পড়া-লেখার তুলনায় এ জামাতের পড়াশোনা হতে হবে একটু বেশি শৃঙ্খলিত ও মার্জিত। স্বপ্ন-শেখর ছোঁয়া ও স্বপ্ন-ধরার আনন্দে উদ্বেলিত ও উচ্ছ্বসিত।
অতএব—শুধু পরীক্ষায় নয় বরং জীবন সাধনার লক্ষ্য পূরণের তাগিদে ঝাপিয়ে পড়তে হবে নিয়মতান্ত্রিক মেহনত ও কঠোর অধ্যাবসায়। নিচে এ জামাতে ভালো ফলাফল ও সফলতা লাভের কিতাবভিক্তিক কিছু কৌশল ও করণীয় তুলে ধরা হল—
মিশকাতুল মাসাবিহ ১-২-৩
১. সঠিক হরকত-সহ প্রতিটি হাদিসের সহজ সরল অনুবাদ রপ্ত করবে। হাদিসগুলো বার বার পড়বে—যাতে মুখস্থ হয়ে যায়। সহজ সরল অনুবাদ শেখার জন্য ইমদাদিয়ার বাংলা মেশকাত গুরুত্বসহ পড়া যেতে পারে।
২. শব্দের তাহকিকসহ প্রতিটি হাদিসের অর্থ শিখবে। এ জন্য কিতাবের হাশিয়া দেখবে। সম্ভব হলে ‘মিরকাত’ দেখবে।
৩. হাদিস সংশ্লিষ্ট ঘটনা ও প্রেক্ষাপট গুছিয়ে লিখে রপ্ত করবে। এ ক্ষেত্রে উস্তাদের আলোচনা মনে রাখার চেষ্টা করবে।
৪. হাদিসের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা বা হাদিস সংশ্লিষ্ট মাসয়ালা-মাসায়েল ও হুকুম-আহকাম বুঝে শুনে পড়বে ও লিখে মনে রাখার চেষ্টা করবে। ইমামদের মতামত, প্রত্যেকের দলিল ও প্রতিপক্ষের দলিলের খণ্ডনসহ রপ্ত করবে। এ জন্য মিরকাত দেখবে। সম্ভব না হলে ইযাহুল মিশকাত, তানযিমুল আশতাত ও দরসে মিশকাত ইত্যাদি কিতাবের সহযোগিতা গ্রহণ করবে।
৫. হাদিাংশ বা হাদিস শরিফে থাকা ছোট ছোট বাক্যের মহল্লে ই’রাব ও তারকিব রপ্ত করবে।
৬. বিভিন্ন হাদিস শরিফ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা-উপদেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখবে রপ্ত করবে।
৭. বিভিন্ন বিষয় বা অধ্যায়ের ১০-১২টি করে হাদিস আরবিতে অর্থসহ লিখে মুখস্থ করবে। শুধু পরীক্ষায় নয় এগুলো তোমার পুরো জীবনের সম্পদ।
৮. বিগত বছরের প্রশ্ন সংগ্রহ করে অনুশীলন করবে।
তাফসিরুল বায়যাবি
১. শব্দের তাহকিক-সহ সাবলীল অনুবাদ রপ্ত করবে।
২. আয়াত সংশ্লিষ্ট ঘটনা ও শানে নুযুল গুছিয়ে লিখে রপ্ত করবে। এ ক্ষেত্রে উস্তাদের আলোচনা মনে রাখার চেষ্টা করবে।
৩. আয়াতের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা বা আয়াত সংশ্লিষ্ট মাসয়ালা-মাসায়েল ও হুকুম-আহকাম বুঝে শুনে পড়বে ও লিখে মনে রাখার চেষ্টা করবে।
৪. আয়াতাংশ বা আয়াতে থাকা ছোট ছোট বাক্যের মহল্লে ই’রাব ও তরকিব রপ্ত করবে।
৫. আয়াত বা সুরার ফজিলত এবং তার থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা-উপদেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখবে ও রপ্ত করবে।
৬. দীর্ঘ নেসাব হলেও পঠিত পুরো অংশ রপ্ত করার চেষ্টা করবে। একদম অপারগ হলে—সে-সব জায়গা থেকে সাধারণত প্রশ্ন আসে কিংবা বেশি আসে—অতিরিক্ত যত্নসহ সেসব জায়গা আত্মস্থ করার প্রতি মনোযোগি হবে।
৭. কিতাবে বর্ণিত বিভিন্ন কেরাত, লুগাত, ই’রাব ও তাহকিক বিশেষ গুরুত্বসহ আত্মস্থ করবে।
৮. প্রতিটি আয়াতের সঠিক তাফসির আয়ত্ত করবে। মতোবিরোধপূর্ণ তাফসিরে বিশুদ্ধতম মতটিও রপ্ত করবে। কোনো আয়াতের তাফসিরের ক্ষেত্রে তাফসিরকারের ব্যক্তিগত মত থাকলে—ঠিক-বেঠিক যাচাইসহ রপ্ত করবে।
৯. বিগত বছরের প্রশ্ন সংগ্রহ করবে এবং প্রশ্নের ধরণ ও ব্যপ্তি উপলব্ধি করে উত্তর লেখার অনুশীলন করবে।
হিদায়া ৩-৪
১. প্রতিটি মাসায়ালা বুঝে পড়বে। প্রথমে মতন তারপর শরাহ আয়ত্ত করবে। মতন-শরাহ মিলেয়ে মাসয়ালা হল করবে। প্রয়োজনে কিতাবের হাশিয়া দেখবে। সহজ সরল অনুবাদের জন্য ইসলামি ফাউন্ডেশনের বাংলা হিদায়া পড়বে। আর কিতাবের ইবারত হলের জন্য ‘ইনায়াহ’ দেখতে পার। সূরতে মাসয়ালা ও ইমামদের মতামত, দলিল ও খণ্ডন ইত্যাদি তফসিলের জন্যে ‘আশরাফুল হেদায়া’ দেখা যেতে পারে। সংক্ষেপে রপ্ত করার জন্য কিতাবের হাশিয়াও দেখা যেতে পারে।
অবশ্য আরবিতে পরীক্ষার উত্তর লিখলে আরবি কিতাব মুতায়ালা করবে। আর বাংলায় উত্তর লিখলে উত্তরের উপস্থাপনা শৈলি রপ্তের জন্য বাংলা দেখবে। তবে যে-কোনো লাইব্রেরির বাংলা দেখবে না। সচেতন উস্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করে নেবে—কোন্ লাইব্রেরির বাংলা দেখবে।
২. তুলনামূলক কঠিন মাসয়ালাগুলো বিশেষ যত্নসহ পড়বে। পরস্পরে মুজাকারা করবে। সাজিয়ে গুছিয়ে খাতায় লিখে অনুশীলন করবে।
৩. খুঁটি-নাটি ও ছোট-খাট মাসয়ালাসমূহ বিশেষ গুরুত্বসহ আত্মস্থ করবে।
৪. নিত্য প্রয়োজনীয় ও প্রচলিত মাসয়ালা-মাসায়েলের হুকুম বুঝে-শুনে ঠাণ্ডা মাথায় আয়ত্ত করবে।
৫. পুরো কিতাবের আরবি ইবারত সঠিক হরকত দিয়ে বার বার পড়বে—যাতে তা মুখস্থের মতো হয়ে যায়।
৬. বিভিন্ন প্রসঙ্গে উল্লেখিত দোয়া-কালাম অরবিসহ সঠিক হরকত দিয়ে মুখস্থ করবে। অর্থসহ লিখে অনুশীলন করবে।
৭. নানা পরিভাষার শাব্দিক ও পারিভাষিক সংজ্ঞা এবং তার প্রকারগুলো গুছিয়ে সুন্দর করে লিখে মুখস্থ করবে।
৮. যে সব মাসয়ালায় ইমামদের মতোবিরোধ রয়েছে—সেসব মাসয়ালা ইমামগণের মাযহাব, প্রত্যেকের দলীল এবং ভিন্ন মাযহাবের ইমামদের দলিলের জওয়াবসহ রপ্ত করবে। বিশেষ করে কিতাবের শুরুর দিকের মাসয়ালাগুলো।
৯. বিগত বছরের প্রশ্ন সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী অনুশীলন করবে।
১০. যে সব অধ্যায় থেকে বেশি প্রশ্ন আসে—সে সব প্রশ্নের উত্তর লিখে দক্ষ অভিজ্ঞ কোনো উস্তাদকে দেখাবে।
শরহুল আকাইদ
১. পুরো কিতাব বুঝে বুঝে সঠিক হরকত লাগিয়ে পড়বে।
২. বিভিন্ন দলের বিশুদ্ধ নাম, নামকরণের কারণ, উদ্ভব, ক্রমবিকাশ ও বিস্তার এবং তাদের বিশেষ আকিদা ও ভ্রান্ত আকিদাসমূহ সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রপ্ত করবে।
৩. আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের পরিচয়, নামকরণের কারণ, বৈশিষ্ট্য ও আকিদা পৃথক পৃথকভাবে কিতাবের ধারাবাহিকতায় মুখস্থ করবে।
৪. বিভিন্ন আকিদার শাখা-প্রশাখা, কোরআন-হাদিস ও যৌক্তিক দলিলসহ সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে আত্মস্থ করবে।
৫. প্রচলিত ফেরাকে বাতেলা ও তাদের খণ্ডন সম্পর্কে অবহিত হবে। এ ক্ষেত্রে মাওলানা হেমায়েত সাহেব রচিত ‘ইসলামি আকিদা ও ভ্রান্তমতোবাদ’এর সহযোগিতা নেয়া যায়।
৬. বিগত বছরের প্রশ্ন সংগ্রহ করে অনুশীলন করবে।
শরহু নুখবাতিল ফিকর
১. কিতাবটি পড়ার পূর্বে মতন আলাদাভাবে মুখস্থ করে নিলে ভালো হয়। অন্তত শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ.-এর মুকাদ্দামায়ে মিশকাতটি বুঝেশুনে মুখস্থ করে নেবে।
২. পুরো কিতাবটি সঠিক হরকতসহ বুঝে বুঝে পড়বে। বুঝার জন্য কিতাবের ‘হাশিয়া’ ও ‘বায়নাস্ সুতুর’-এর সহযোগিতা নিবে। আলোচনার সারসংক্ষেপ খাতায় লিখে আত্মস্থ করবে।
৩. হাদিস সংক্রান্ত নানা পরিভাষা, পরিভাষার সংজ্ঞা ও হুকুম উদারহণসহ আয়ত্ত করবে। এ ক্ষেত্রে ‘আল-কাফয়ুল আসার’ বা ‘আদ্দুরারুস সামিনাহ’-এর সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। ‘নজমুদ দুরার’ও দেখা যেতে পারে।
৪. ইখতেলাফি বিষয়গুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ বুঝে শুনে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে রপ্ত করবে।
৫. কিতাবে উল্লেখিত বিভিন্ন উদাহরণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল আলোচনা সাজিয়ে গুছিয়ে আত্মস্থ করবে।
৬. কিতাবটি যেহেতু উসুলে হাদিসের কিতাব তাই বুঝে শুনে পড়া এবং সাজিয়ে গুছিয়ে মুখস্থ করার প্রতি বেশি জোর দেবে।
৭. বিগত বছরের প্রশ্ন সংগ্রহ করে উত্তর লেখার ব্যাপক অনুশীলন করবে।
তাহরিকে দেওবন্দ
১. কিতাবের প্রতিটি আলোচনা বার বার পড়বে। যাতে মুখস্থের মতো হয়ে যায়। আলোচনার সারকথা নিজ ভাষায় লেখার অনুশীলন করবে।
২. ক্লাসের উস্তাদ যখন যে বিষয়টি আলোচনা করেন মনোযোগসহ আলোচনা শুনবে। কিতাবটি ইতিহাস বিষয়ক হওয়ার কারণে শুনে শুনে তা আয়ত্ত করা বেশি সহজ। তাই মনে রাখার সুবিধার্থে মনের কান দিয়ে উস্তাদের আলোচনা-পর্যালোচনা শুনবে ও মনে রাখার চেষ্টা করবে। উস্তাদের আলোচনার সারকথা খাতায় গুছিয়ে লিখে নেবে।
৩. বিভিন্ন জীবনীতে বর্ণিত ব্যক্তির নাম, স্থানের নাম এবং সঠিক সন-তারিখ বিশেষ গুরুত্বসহ রপ্ত করবে।
৪. কিতাবের যে-সব বিষয়গুলো মুখস্থ করার—কিতাবের মতো হুবহু মুখস্থ করে খাতায় লেখার চেষ্টা করবে। লিখে লিখে মুখস্থ করলে বানান ভুল কম হবে।
৫. পুরো কিতাবের কোথায় কি-আছে¬—সংক্ষেপে একটি ছক ও ডাটা এঁকে আয়ত্ত করলে ভালো হয়।
৬. যে-সব জায়গা থেকে প্রশ্ন বেশি আসে—যত্নসহ সে-সব জায়গাগুলো বার বার পড়বে ও লিখে মুখস্থ করবে। এ জন্যে বিগত বছরের প্রশ্ন সংগ্রহ করা যেতে পারে।
৭. প্রতিটি জবীবনী ও আলোচনার নানা ধাপ ও দিকগুলো পৃথক পৃথক শিরোনামে আলাদা আলাদা লিখবে। নম্বর বেশি পাওয়া যাবে।
৮. প্রত্যেকের জীবনী ও জীবন সংক্রান্ত ঘটনাদি, তথ্যাদি ও বৈশিষ্ট্যাবলি পৃথক পৃথকভাবে অনুশীলন করবে—যাতে একজনের ঘটনা অপরজনের সঙ্গে জুড়ে না যায়। বা প্যাঁচ লেগে না যায়।
৯. বছর শেষে বা পরীক্ষার পূর্বমূহুর্তে বড় বোঝা না হয়ে যায় তাই বছরের শুরু থেকে অল্প অল্প করে কিতাটি রপ্ত করার চেষ্টা করবে—এতে বোঝা হালকা হবে। দীর্ঘ নেসাব হলেও অল্প মনে হবে। পরীক্ষা ভীতি দূর হবে।
১০. বিগত বছরের প্রশ্ন সামনে রেখে নিয়মিত সামান্য সামান্য অনুশীলন করলেও বেশি লাভবান হওয়া যাবে। (চলবে)
এ আয়োজনের বাকি পর্ব আমাদের ‘শিক্ষাঙ্গন’ ক্যাটাগড়িতে।
-কেএল