কাউসার লাবীব
সাব-এডিটর
সদ্য সমাপ্ত হওয়া চরমোনাই মাহফিলে উপমহাদেশের সবচেয়ে আলোচিত অন্যতম ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় মহাসচিব, রাজধানীর খিলগাঁও মাখজানুল উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল, শাইখুল হাদিস মাওলানা নুরুল ইসলামের দেয়া বক্তব্য নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আজ হেফাজতে ইসলামের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে একটি ওয়াজাহাত মূলক পোস্ট দেয়া হয়েছে। সেখানে তুলে ধরা হয়েছে মহাসচিবের ব্যাখ্যামূলক বক্তব্য।
পোস্টে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত বাংলাদেশ। -এর সভাপতি, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ -এর মহাসচিব আল্লামা হাফিজ মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম হাফিজাহুল্লাহ সম্প্রতি এক সংক্ষিপ্ত সফরে চরমোনাই বার্ষিক মাহফিলে পীর সাহেবদ্বয়ের আহ্বানে গমন করেন এবং সেখানে আয়োজিত উলামা মাশায়িখ সম্মেলনে বক্তব্য প্রদান করেন।
আমরা সে বক্তব্যের একটি অংশ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা লক্ষ্য করছি। এ বিষয়ে আমরা সরাসরি তাঁর সাথে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন; ইকদামী জিহাদকে অস্বীকার করার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এ বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহতে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। মুহাদ্দিসীন ও ফুকাহায়ে কিরামও এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। সীরাত অধ্যয়নকারীমাত্রই জানে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে উহুদ, খন্দক ব্যতীত অধিকাংশ জিহাদই ছিল ইকদামী। এমনকি তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত সর্বশেষ অভিযান ছিল গাযওয়ায়ে তাবুক। তাও ছিল ইকদামী।
বলতে দ্বিধা নেই, সেকালের রোম-পারস্যসহ ইসলামের বিশ্বব্যাপী অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে ইকদামী জিহাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একজন সচেতন নবীপ্রেমিক দিবালোকের সূর্যের ন্যায় এমন সুস্পষ্ট বিষয়কে কীভাবে অস্বীকার করতে পারে।
আমার বক্তব্যের মূল টার্নিং পয়েন্ট ছিল নাস্তিক মুরতাদসহ তাবত ইসলামবিদ্বেষীদের পক্ষ থেকে কখনো কোনো ধরনের আক্রমণ হলে অবশ্যই আমাদের নীরবে বসে থাকার সুযোগ নেই। আর তা ইসলামও আমাদেরকে বলে নি। এ কথাটি বোঝাতে গিয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে আমি আগ বাড়িয়ে কোনো নিরীহ মানুষকে হত্যার অনুমতি নেই মর্মে বক্তব্য প্রদান করি।
সেক্ষেত্রে আমার বক্তব্যে অনাকাঙিক্ষত কোনো ভুল বোঝাবুঝির জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি এবং এ বিষয়ে যারা হিতাকাঙ্ক্ষী মনোভাব নিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আল্লাহ আমাদেরকে সীরাতে মুস্তাকীমের উপর আমৃত্যু অটল ও অবিচল রাখেন।
প্রসঙ্গত, চরমোনাইয়ের এবারের মাহফিলে ওলামায়ে কেরামের সম্মেলনে মাওলানা নুরুল ইসলাম এক নাতিদীর্ঘ বলেছিলেন, চরমোইনাইয়ের ময়দানে আমি এ নিয়ে চতুর্থবার এসেছি। সর্বপ্রথম আশা চরমোনাইয়ের মহরহুম পীর সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. এর আহ্বানে। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আপনি চরমোনাই ময়দানে আসেন না কেন? তখন মাওলানা নুরুল হুদা ফয়েজী আমার আসা-যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। এছাড়া যখন এসেছি, আমি সঙ্গে পেয়েছি পটিয়ার গাজি সাহেবকে। পেয়েছি হাটহাজারীর আমার উস্তাদ মাওলানা কাসেম সাহেব ও বায়তুল মোকাররমের মরহুম খতিব সাহেবকে।
শাইখুল হাদিস মাওলানা নুরুল ইসলাম বলেন, এছাড়া একটি স্মৃতিকথা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, আল্লামা আহমদ শফী রহ. এর পূর্বে মোহতামীম, হাটহাজারী মাদরাসার ওমরে ফারুক খ্যাত, সুন্নতের কট্টর অনুসারী মাওলানা হামেদ সাহেব একবার চরমোনাই এসেছিলেন। ফেরার পথে ঢাকায় আমার মাদরাসায় তিনি মেহমান হলেন। মাদরাসা উপস্থিত হয়ে তিনি কামরায় প্রবেশের আগেই আমাকে বললেন, ‘দূর থেকে চরমোনাইকে তো মন্দ কিছু মনে করতাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে তো দেখি তাদের মতো সুন্নত পালনকরনেওয়ালা আর কেউ নাই। এমন যদি সবাই সুন্নতের ওপর আমল করতো; তাহলে পুরো দেশ পরিবর্তন হয়ে যেত।’
মাখজানুল উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল বলেন, আসলে আমরা মাঝে মাঝে ভুলে যাই কীভাবে আজকের এ মজমা হলো। এমনি এমনিতেই এ মজমা জমেনি। এটি হযরত গাঙ্গুহী রহ. এর ফোকাস, হযরত থানভীর ফোকাস, উজানীর কারী ইবরাহিম রহ. এর ফোকাস। আমরা অনেক সময় ইতিহাস ভুলে যাই। এ ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। একটি কথা মনে পড়লো, দেশ যখন স্বাধীন হয়; তখন পুরো দেশে টুপি দাড়িওয়ালারা কোথায় কথা বলতে সাহস পেতেন না। লোক জমায়েত করতে পারতেন না। ওয়াজ মাহফিল করতে পারতেন না। তখন খতিবে আজম সিদ্দীক আহমাদ সাহেব রহ. একবার মরহুম দাদা পীর সৈয়দ ইসহাক রহ.কে বলেছিলেন, আমি তো জলসা-টলসা করতে পারছি না। তখন ইসহাস সাহেব তাকে বলেছিলেন, জলসা কোথায় করবেন ? কখন করবেন? বলেন। আমি লোক নিয়ে হাজির হবো। এরপর খতিব সাহেবের ইশারায় তিনি বিশাল এক টুপি দাড়িওয়ালার জামাতকে ঢাকার রাজপথে নামিয়েছেন।
হেফাজত মহাসচিব বলেন, দোয়া করি আল্লাহ এ মজমাকে ভরপুর কামিয়াবি দান করুক। কেয়ামত পর্যন্ত কবুল করুক। তবে একটা কথা না বলে পারছি না, আমরা বাড়িতে গেলে চরমোনাইয়ের কথা ভুলে যাই। নির্বাচনের সময় নিজের দলের প্রার্থী রেখে চরমোনাইয়ের প্রার্থীর দিকে ফিরেও তাকাই না। কথাগুলো তিক্ত হলেও সত্য। নিজের দলের প্রার্থি ফাসেক হোক আর ফাযের হোক তার পেছনে দৌড়াই।
মুসলিমদের ঐক্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, এখনো আমরা একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করার প্লাটফর্ম দাঁড় করাতে পারিনি। এটা খুব দরকার। ভাল কাজ যেই করুক তার সঙ্গ একাত্বতা প্রকাশ করতে হবে। আমাদের একতা না থাকার কারণে আমাদের বিশাল জামাত থাকা সত্ত্বেও ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছি না। কিন্তু তারা পেঁচার মতো আমাদের বাগান নষ্ট করে যাচ্ছে। আমি তাদের ওপর আক্রমণ করার কথা বলছি না। ইসলাম কারো ওপর আক্রমণ করার কথা বলেনি। আবার নিরবে, অযথা ও অকারণে কারো আক্রমণ সহ্য করার কথাও বলেনি। দেফায়ি সুরতের কারণে আল্লাহর নবী সা. নিজে জিহাদের মধ্যে শরিক হয়েছেন। আমরা দেফা করবো আক্রমণ করবো না। দেফা ইসলামে আছে। কিন্তু আক্রমণ নেই, হামলা নেই। তাই দেফাকে বাদ দেয়া যাবে না।
কাদিয়ানি বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে কাদিয়ানি ও নাস্তিকদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। আমরা কাদিয়ানিদের নতুন এক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে পেরেছি, তারা চায় পুরো বাংলাদেশকে একটা কাদিয়ানি রাষ্ট্র বানাতে। আর তাদের এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে আমরা চরমোনায়ের মুরিদ হওয়ার পরও প্রান-আরএফএল’র পণ্য ব্যবহার করছি। এর চেয়ে কষ্টের ও লজ্জার আর কী হতে পারে! এসব বলে তিনি উপস্থিত জনতার কাছ থেকে কাদিয়ানি পণ্য বর্জনের ওয়াদা নেন।
সবশেষে তিনি বলেন, পৃথিবীর প্রায় ৪০টি রাষ্ট্রে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করেছে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে এখানো তা হয়নি। কাদিয়ানিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার জন্য আমাদের আরো সোচ্চার হতে হবে।
উল্লেখ্য, আল্লামা নূরুল ইসলাম শুধু একজন বরেণ্য আলেমই নন, তিনি এ দেশের আকাবিরে দীনের একান্ত স্নেহ ও আস্থাভাজন। তিনি মুফতীয়ে আযম আল্লামা ফয়জুল্লাহ রহিমাহুল্লাহ'র গর্বিত ছাত্র। খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দিক আহমাদ রহিমাহুল্লাহ'র একান্ত কাছের ব্যক্তিত্ব ও খলিফাও বটে। কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সংকটকালে তাঁর আপসহীন দূরদর্শী ভূমিকা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। আমরা এমন একজন পরিচ্ছন্ন ইমেজের অধিকারী আলিমে দীনের সুস্থতার সাথে দীর্ঘায়ূ কামনা করছি।
-কেএল