কাউসার লাবীব
সাব-এডিটর
সদ্য সমাপ্ত হলো চরমোনাইয়ের ফাল্গুনের মাহফিল। এ মাহফিলকে বলা হয় বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ মুসলিম ধর্মীয় গণ জমায়েত। সুনিপুণ সূচিমালায় সাজানো হয় এ মাহফিল। থাকে অনন্যকিছু আয়োজন। এর মধ্যে অন্যতম দ্বিতীয় দিন আয়োজিত ‘ওলামা সম্মেলন।’ বরাবরের মতো এবারও আয়োজিত হয় এ আয়োজন। মহামারী করোনা পরিস্থিতির কারণে বিদেশি আলেমগণ উপস্থিতে হতে না পারলেও উক্ত আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন দেশ-বরণ্যে ওলামায়ে কেরাম। উপস্থিত ছিলেন উপমহাদেশের সবচেয়ে আলোচিত অন্যতম ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় মহাসচিব, রাজধানীর খিলগাঁও মাখজানুল উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল, শাইখুল হাদিস মাওলানা নুরুল ইসলাম। তিনি নাতিদীর্ঘ একটি বক্তব্যও রাখেন এ ওলামা সম্মেলনে।
বক্তব্যে তিনি বলেন, চরমোইনাইয়ের ময়দানে আমি এ নিয়ে চতুর্থবার এসেছি। সর্বপ্রথম আশা চরমোনাইয়ের মহরহুম পীর সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. এর আহ্বানে। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আপনি চরমোনাই ময়দানে আসেন না কেন? তখন মাওলানা নুরুল হুদা ফয়েজী আমার আসা-যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। এছাড়া যখন এসেছি, আমি সঙ্গে পেয়েছি পটিয়ার গাজি সাহেবকে। পেয়েছি হাটহাজারীর আমার উস্তাদ মাওলানা কাসেম সাহেব ও বায়তুল মোকাররমের মরহুম খতিব সাহেবকে।
শাইখুল হাদিস মাওলানা নুরুল ইসলাম বলেন, এছাড়া একটি স্মৃতিকথা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, আল্লামা আহমদ শফী রহ. এর পূর্বে মোহতামীম, হাটহাজারী মাদরাসার ওমরে ফারুক খ্যাত, সুন্নতের কট্টর অনুসারী মাওলানা হামেদ সাহেব একবার চরমোনাই এসেছিলেন। ফেরার পথে ঢাকায় আমার মাদরাসায় তিনি মেহমান হলেন। মাদরাসা উপস্থিত হয়ে তিনি কামরায় প্রবেশের আগেই আমাকে বললেন, ‘দূর থেকে চরমোনাইকে তো মন্দ কিছু মনে করতাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে তো দেখি তাদের মতো সুন্নত পালনকরনেওয়ালা আর কেউ নাই। এমন যদি সবাই সুন্নতের ওপর আমল করতো; তাহলে পুরো দেশ পরিবর্তন হয়ে যেত।’
মাখজানুল উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল বলেন, আসলে আমরা মাঝে মাঝে ভুলে যাই কীভাবে আজকের এ মজমা হলো। এমনি এমনিতেই এ মজমা জমেনি। এটি হযরত গাঙ্গুহী রহ. এর ফোকাস, হযরত থানভীর ফোকাস, উজানীর কারী ইবরাহিম রহ. এর ফোকাস। আমরা অনেক সময় ইতিহাস ভুলে যাই। এ ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। একটি কথা মনে পড়লো, দেশ যখন স্বাধীন হয়; তখন পুরো দেশে টুপি দাড়িওয়ালারা কোথায় কথা বলতে সাহস পেতেন না। লোক জমায়েত করতে পারতেন না। ওয়াজ মাহফিল করতে পারতেন না। তখন খতিবে আজম সিদ্দীক আহমাদ সাহেব রহ. একবার মরহুম দাদা পীর সৈয়দ ইসহাক রহ.কে বলেছিলেন, আমি তো জলসা-টলসা করতে পারছি না। তখন ইসহাস সাহেব তাকে বলেছিলেন, জলসা কোথায় করবেন ? কখন করবেন? বলেন। আমি লোক নিয়ে হাজির হবো। এরপর খতিব সাহেবের ইশারায় তিনি বিশাল এক টুপি দাড়িওয়ালার জামাতকে ঢাকার রাজপথে নামিয়েছেন।
হেফাজত মহাসচিব বলেন, দোয়া করি আল্লাহ এ মজমাকে ভরপুর কামিয়াবি দান করুক। কেয়ামত পর্যন্ত কবুল করুক। তবে একটা কথা না বলে পারছি না, আমরা বাড়িতে গেলে চরমোনাইয়ের কথা ভুলে যাই। নির্বাচনের সময় নিজের দলের প্রার্থী রেখে চরমোনাইয়ের প্রার্থীর দিকে ফিরেও তাকাই না। কথাগুলো তিক্ত হলেও সত্য। নিজের দলের প্রার্থি ফাসেক হোক আর ফাযের হোক তার পেছনে দৌড়াই।
মুসলিমদের ঐক্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, এখনো আমরা একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করার প্লাটফর্ম দাঁড় করাতে পারিনি। এটা খুব দরকার। ভাল কাজ যেই করুক তার সঙ্গ একাত্বতা প্রকাশ করতে হবে। আমাদের একতা না থাকার কারণে আমাদের বিশাল জামাত থাকা সত্ত্বেও ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছি না। কিন্তু তারা পেঁচার মতো আমাদের বাগান নষ্ট করে যাচ্ছে। আমি তাদের ওপর আক্রমণ করার কথা বলছি না। ইসলাম কারো ওপর আক্রমণ করার কথা বলেনি। আবার নিরবে, অযথা ও অকারণে কারো আক্রমণ সহ্য করার কথাও বলেনি। দেফায়ি সুরতের কারণে আল্লাহর নবী সা. নিজে জিহাদের মধ্যে শরিক হয়েছেন। আমরা দেফা করবো আক্রমণ করবো না। দেফা ইসলামে আছে। কিন্তু আক্রমণ নেই, হামলা নেই। তাই দেফাকে বাদ দেয়া যাবে না।
কাদিয়ানি বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে কাদিয়ানি ও নাস্তিকদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। আমরা কাদিয়ানিদের নতুন এক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে পেরেছি, তারা চায় পুরো বাংলাদেশকে একটা কাদিয়ানি রাষ্ট্র বানাতে। আর তাদের এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে আমরা চরমোনায়ের মুরিদ হওয়ার পরও প্রান-আরএফএল’র পণ্য ব্যবহার করছি। এর চেয়ে কষ্টের ও লজ্জার আর কী হতে পারে! এসব বলে তিনি উপস্থিত জনতার কাছ থেকে কাদিয়ানি পণ্য বর্জনের ওয়াদা নেন।
সবশেষে তিনি বলেন, পৃথিবীর প্রায় ৪০টি রাষ্ট্রে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করেছে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে এখানো তা হয়নি। কাদিয়ানিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার জন্য আমাদের আরো সোচ্চার হতে হবে।
প্রসঙ্গত, আজ শনিবার সকালে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হয় বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ মুসলিম ধর্মীয় গণ জমায়েত ঐতিহ্যবাহী চরমোনাই দরবারের ফাল্গুন মাসের বার্ষিক মাহফিল। সকালে চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম মোনাজাত পরিচালনা করেন।
মোনাজাতে দেশ, মানবতা, ইসলাম ও দেশের মানুষের শান্তি ও কল্যাণের জন্য দোয়া করা হয়। এছাড়াও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামবিরোধী, মানবতাবিরোধী অপশক্তির হেদায়াত কিংবা ধ্বংসের জন্য দোয়া করা হয়। দোয়া করা হয় মুসলমানদের ঐক্যের জন্য।
২৪ ফেব্রুয়ারি, বুধবার বাদ জোহর চরমোনাইয়ের পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের উদ্বোধনী বয়ানের মাধ্যমে শুরু হয় এই মাহফিল। মাহফিলে প্রধান ৭টি অধিবেশনের মধ্যে তিনি ৫টিতে বয়ান পেশ করেন এবং নায়েবে আমীরুল মুজাহিদীন, শায়েখে চরমোনাই মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম ২টি অধিবেশনে বয়ান পেশ করেন।
আখেরি বয়ানে হজরত চরমোনাই পীর বলেন, ‘মানুষ যখন আল্লাহ বিমুখ হয়ে যায় তখন মানুষের মধ্যে মানবতা থাকে না বিধায় তারা যে কোনো অপরাধে জড়িয়ে পরে। সুতরাং আমাদের সবার মধ্যে আল্লাহ ভীতি এবং আল্লাহ ও রাসূলের পূর্ণ আনুগত্য থাকতে হবে। আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মনোনীত দীন ছাড়া অন্য কোনো তন্ত্রমন্ত্র কখনোই গ্রহণ করা যাবে না। যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের আদর্শ ছাড়া অন্য আদর্শ গ্রহণ করে কিংবা সে আদর্শের দিকে লোকদিগকে আহ্বান করে, নিশ্চয়ই তারা পথভ্রষ্ট।’
এই বছর চরমোনাই মাহফিলে এসে বেশ কয়েক অমুসলিম চরমোনাই পীরের হাতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। নতুন এ মুসলমানদের সার্বিক দায়িত্ব বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি নিবে বলেও আশ্বাস দেন। এছাড়া মাহফিলে বেশ কয়েকজন মুসল্লি ইন্তেকাল করেন। এদের সবার জানাজা মাহফিলের মঞ্চেই অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার পরে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়।
-কেএল