রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


হিফ্জ বিভাগের ছাত্ররা যেভাবে ‘কেন্দ্রীয় পরীক্ষা’র প্রস্তুতি নিবেন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

দরজায় কড়া নাড়ছে কওমি মাদরাসার বিভিন্ন জামাতের কেন্দ্রীয় পরীক্ষা। এবার কোভিড-১৯ এর কারণে শিক্ষাবর্ষের সময় কম হলেও কমেনি পরীক্ষার সিলেবাসের পরিমাণ। তাই অল্প সময়ে দীর্ঘ এ নেসাব থেকে পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করার কলাকৌশল বিষয়ে অনলাইন সংবাদ মাধ্যম আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম আয়োজন করেছে পরীক্ষা বিষয়ক শিক্ষাপরামর্শ ‘পরীক্ষার ভালো প্রস্তুতি ও সেরা ফলাফলের কৌশল’। আজ থেকে শুরু হচ্ছে জামাত ও কিতাব ভিত্তিক পড়াশোনা ও পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার কৌশল। ধারাবাহিক পর্ব- ৬

লিখছেন দারুল উলুম রামপুরা বনশ্রী মাদরাসার উস্তাযুল হাদিস, দারুল উলুম দেওবন্দের ফাজেল ‘মাসুম আবদুল্লাহ’


(গত পর্বের পর)

হিফয বিভাগ
পরীক্ষা মানুষকে সম্মাণিত করে। আবার অপমানিতও করে। তাই পরীক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। আর সেজন্যে পড়া-শোনার প্রতি শতভাগ মনোযোগি হতে হবে। পড়া-লেখা ছাড়া বাকি সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।

পরীক্ষার পূর্বপ্রস্তুতি পরীক্ষা ভালো হবার একমাত্র মাধ্যম। সেরা প্রস্তুতি ভালো ফলাফলের আস্থা জন্মায়। পরীক্ষাভীতি দূর করে। নিয়মতান্ত্রিক সাধনা ও ধারাবাহিক অনুশীলন পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের নিশ্চয়তা দেয়। পরীক্ষার সেরা প্রস্তুতিই ভালো ফলাফলের ভীত ও সূচনাধাপ। পরীক্ষার সেরা প্রস্তুতি ও ভালো ফলাফলের জন্যে হিফযখানার ছাত্রদের নিম্নের বিষগুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেয়া উচিৎ—

ক. বছরের শুরু থেকেই কুরআন শরীফ ইয়াদ করার ব্যাপারে ভরপুর চেষ্টা করা।
খ. নির্ভুল সবক শুনানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
গ. সবক শুনানোর সময়ই মদ-গুন্নাহ, মাখরাজ-সিফাত ও লেহানের প্রতি জোর দেয়া। প্রথম দিন থেকেই তেলাওয়াতকে শ্রুতিমধুর করার আপ্রাণ চেষ্টা করা।
ঘ. সবক পড়া অবস্থায়-ই পিছনের পারা ইয়াদের ব্যাপারে বিশেষ খেয়াল রাখা। এ জন্যে আমুখতা সাতসবক ও সবিনার প্রতি পূর্ণ গুরুত্ব দেবে। পিছনের কোনো পারা কাঁচা হলে সবক বন্ধ করে হলেও ইয়াদ করে নেবে।
ঙ. সবক শেষ হবার সাথে সাথে উস্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রতিদিনের পড়াশোনা ও তেলাওয়াতের রুটিন করে নেবে।
চ. নিজেদের মাঝে প্রশ্ন ধরাধরি করবে। প্রতিদিন পুরো ৩০ পারা থেকে প্রশ্ন ধরাধরি করবে। প্রতিটি পারা থেকে একাধিক প্রশ্ন ধরাধরি করবে। এ ক্ষেত্রে বিগত বছরের বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সামনে রাখা বেশি ফলপ্রসূ।
ছ. নামাযে প্রতিদিন কমপক্ষে দু’জনে দুই পারা তেলাওয়াত করবে। সুন্নত ও নফল নামাযে সাধ্যানুযায়ী তেলাওয়াত করার অভ্যাস করবে।
জ. মশকের প্রতি মনোযোগী হবে। ভালো মানের কোনো তেলাওয়াত দৈনিক কিছু কিছু শুনবে। এবং তা রপ্ত করার ভরপুর চেষ্টা করবে। সম্ভব হলে ব্যক্তিগতভাবে কারো কাছে মশক করে নিজের ভুলত্রæটিগুলো ঝালিয়ে নেবে।
ঝ. তাজভিদ ও দোয়া-মাসায়েল বুঝে বুঝে মুখস্থ করবে। পরস্পরে ধরাধরি করবে। বিগত বছরের প্রশ্নগুলো সংগ্রহ করে তার সঠিক উত্তর বের করে মুখস্থ করবে। আর যে বিষয়গুলো বুঝে আসে না বা যেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওনা—উস্তাদের শরণাপন্ন হয়ে বুঝে নেবে এবং উত্তর জেনে নেবে।
ঞ. সর্বাবস্থায় কুরআন শরীফের আদব রক্ষা করবে। তেলাওয়াতের আদব-কায়দা জেনে তার উপর আমল করবে। উস্তাদের প্রতি ভাক্তি-শ্রদ্ধা রাখবে। তার খেদমত করবে। কোনোভাবেই যেনো বেয়াদবি না হয় তার প্রতি পূর্ণ খেয়াল রাখবে। এমন কিছু ঘটলে উস্তাদ থেকে মাফ চেয়ে নেবে। নতুবা সফলতা পরের কথা তোমার শিক্ষাজীবনই বিপন্ন হবে। মাদরাসার আদব-সম্মান বজায় রাখবে। বেশি থেকে বেশি সময় মাদরাসায় থাকার চেষ্টা করবে। বাসা-বাড়িতে কম যাবে। আড্ডাবাজি, যে-কোনো গর্হিত কর্মকাণ্ড ও গুনাহের কাজে নিজেকে একদমই জড়াবে না। সর্বোপরি দোয়া-নামায ও আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটির অভ্যাস রাখবে। সফলতা ইনশাআল্লাহ আসবেই।

শ্রুতিমধুর ও উন্নত তেলাওয়াত রপ্ত করার কৌশল
শ্রুতিমধুর তেলাওয়াত বা উন্নত মানের তেলাওয়াত হিফয বিভাগের ভালো ফলাফলের অন্যতম শর্ত। তাই তেলাওয়াতের মান উন্নয়নের নিম্নের বিষয়গুলো করণীয়—
ক. উন্নতমানের তেলাওয়াতের প্রথম শর্ত বিশুদ্ধ ও সঠিক উচ্চারণ। আরবি হরফ ২৯টি। এ হরফগুলোর উচ্চারণস্থল বা মাখরাজ ১৭টি। প্রতিটি হরফকে তার সঠিক উচ্চারণস্থল থেকে ষোলো আনা উচ্চারণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। প্রতিটি হরফের সিফাতসহ মাখরাজ থেকে উচ্চারণের অভ্যাস করা। এক্ষেত্রে যে-কোনো ত্রুটি তেলায়াতকে শ্রুতি মধুর ও উন্নত করার পথে সবচে বড় বাধা। তাই এ বিষয়ে যারপর নাই গুরুত্ব দিতে হবে।
খ. তাজভিদের কায়দা-কানুন জানা ও মানা। বরং তেলাওয়াতে সঠিক মাত্রায় তা শতভাগ প্রয়োগ করা। ইজহার-ইখফা, ইদগাম-ইকলাব, পুর-বারিক, কল্কলা ও মদ-গুন্নায় ভারসাম্যতা বজায় রাখা। সব জায়গায় একরকম আদায় করার অভ্যাস গড়া।
গ. উন্নমানের শ্রুতি মধুর কোনো একটি তেলাওয়াতের অনুসরণ করা। বর্তমানে দেশিয় ও আন্তর্জাতিক পরিমÐলে বহু লাহজা-লেহান পরিচিত ও প্রচলিত। সেগুলো থেকে তোমার কণ্ঠের সাথে যুৎসই কোনো লাহজা-লেহানের তেলাওয়াত নকল করবে। এ লেহানের তেলাওয়াত বেশি বেশি শুনবে ও তোমার কণ্ঠে তুলবে। যখনই তেলাওয়াত করবে সে লেহানে পড়বে। এভাবে শুনতে শুনতে ও পড়তে পড়তে একসময় সে লেহান তোমার রপ্ত হয়ে যাবে ইনশা-আল্লাহ।
ঘ. তেলাওয়াতের উন্নয়নে সবচে’ বেশি গুরুত্ব রাখে মশ্ক। তাই উস্তাদ যখন মশ্ক করান—যত্নসহ মশক করবে। মশ্ক হলো হাতে-কলমে তেলাওয়াত উন্নত ও শ্রুতিমধুর করার ক্লাস। তাই এ অনুশীলন ক্লাসের প্রতি মনোযোগি হবে। এখান থেকেই নিজের ভুল-ত্রুটি ঝালিয়ে নেবে। প্রয়োজনে ব্যক্তিগতভাবে উস্তাদের শরণাপন্ন হয়ে নিজের লেহজা-লেহান ঠিক করবে। নিজের তেলাওয়াতকে উন্নত থেকে উন্নত করবে। মনে রাখবে সর্বক্ষেত্রে তোমার ইচ্ছা ও সঠিক চেষ্টা-ই তোমাকে তোমার সফলতার কাঠি ছুঁতে সর্বাপেক্ষা বেশি সহযোগিতা করবে। তাই জ্বলে ওঠো আপন শক্তিতে। নিজেকে এগিয়ে রাখো আপন চেষ্টার মহিমায়।

ইয়াদ পাক্কা ও মজবুত করার কৌশল
হিফয বিভাগে ভালো ফলাফলের জন্যে পাক্কা ইয়াদের কোনো বিকল্প নেই। র্কুআন শরীফের ইয়াদ পাক্কা ও মজবুত করতে নিম্নের বিষয়গুলো করণীয়—
ক. প্রতিদিনের সবকের পৃষ্ঠা পাঁচওয়াক্ত নামাজের সুন্নতে দৈনিক পাঁচবার পড়ার চেষ্টা করা। নামাজে তেলাওয়াত ইয়াদ পাক্কা হওয়ার ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর। নামাজের বাইরের বিশবার পড়লে যতটুকু ইয়াদ পাক্কা হয় নামাজে একবার পড়লে ততটুকু ইয়াদ মজবুত করে। এটি নামাজের বরকত। নামাজে তেলাওয়াত ইয়াদকে পাক্কা করে—বিষয়টি শত পরীক্ষিত।
খ. প্রতিদিনের আমুখতা রাতে ঘুমানোর পূর্বে দু’রাকাত নফল নামাজে অবশ্যই পড়ে ঘুমাবে। এতে দেখবে তোমার ৫/১০ পৃষ্ঠার আমুখতা অনেকটা ঝরঝরে হয়ে ওঠবে।
গ. বেশি বেশি তেলাওয়াত করা। যত বেশি তেলাওয়াত করবে তত বেশি ইয়াদ পাক্কা হবে। এক পারা থেকে দশ পারা যাদের সব পড়া হয়েছে—তারা পেছনের পারাগুলো দৈনিক একবার তেলাওয়াত করবে। আর এগারো থেকে বিশ পারা পর্যন্ত যাদের সবক পড়া হয়েছে—তারা দু’দিনে পেছনের পারাগুলো তেলাওয়াত শেষ করবে। আর যাদের সবক একুশ পারা থেকে ত্রিশ পারা পড়া হয়েছে—তারা তিনদিনে পেছনের পারাগুলো একবার তেলাওয়াত শেষ করবে। এভাবে যত বেশি তেলাওয়াত করতে পারবে তত বেশি ইয়াদ পাক্কা হবে।
ঘ. গুনাহ করা, টিভি-সিনেমা দেখা, অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করা, প্রচলিত প্রেম-প্রীতের সম্পর্কে জড়ানো, অসৎ সঙ্গ গ্রহণ করা, অতিরিক্ত খেলা-ধুলা করা, নেশা করা, মোবাইল, এফএম—এমপি থ্রি/ফোর ইত্যাদি ব্যবহার করা, ইবাদত-বন্দেগিতে কোতাহি করা, কুরআনে কারীমের আদব রক্ষা না করা, বই-কিতাবের আদব রক্ষা না করা, উস্তাদের সঙ্গে বেয়াদবি করা, উস্তাদের হক আদায় না করা, সবকে অনুপস্থিত থাকা, মাদরাসা কামাই দেয়া, ছাত্রভাইদের হক নষ্ট করা, মদরাসার হক নষ্ট করা, মাদরাসার নিয়ম-কানুন না মানা—এসব আল্লহর রহম থেকে দূরে ঠেলে দেয়। মন-মস্তিষ্ক বিগড়ে দেয়।

পড়াশোনার মনোযোগ ও বরকত নষ্ট করে দেয়। যা কখনো কখনো কুরআন শরীফ ভুলে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বরং কুরআন শরীফ ইয়াদ না থাকা ও লাইনচ্যুত হওয়ারও কারণ হয়ে যায়—আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন। (চলবে)

এ আয়োজনের বাকি পর্বের লেখাগুলো আমাদের  ‘শিক্ষাঙ্গন’ ক্যাটাগড়িতে পাবেন।

-কেএল

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ