আবুল ফাতাহ কাসেমী।।
প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট সময়ে নারীদের পিরিয়ড হয়ে থাকে। নারীর জন্য এটি একটি জন্মগত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ পিরিয়ড তাকে প্রতি মাসে গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত করে। পিরিয়ড কমপক্ষে তিন দিন থেকে শুরু করে সাত দিন পর্যন্ত হয়ে থাকে।
পিরিয়ডকে হায়েজও বলা হয়। পিরিয়ডের সাথে নারীর পাক পবিত্রতা, নামাজ, রোজা, হজ, কুরআন তেলাওয়া ও সহবাসসহ অনেক শরয়ি মাসয়ালা মাসায়েল জড়িত। পিরিয়ডের সময় স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে। পিরিয়ড চলাকালীন শারীরিক সম্পর্ক হলে কোনো সমস্যা হয় কিনা?
জেনে রাখা ভালো, পিরিয়ড চলাকালীন শারীরিক সম্পর্ক হারাম। কুরআন সুন্নাহ ও মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্যে এ কাজটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দর্শনেও একবারেই অনুচিত। এই সময়ে শারীরিক সম্পর্ক নারীর জন্য নানাবিধ বিপদ ডেকে আনতে পারে।
গতকাল (২১-০২-২০২১) একটি টিভি চ্যানেলের পেইজে ‘পিরিয়ডের সময়ের শারীরিক সম্পর্ক উচিৎ না অনুচিত, নতুন গবেষণা’— শিরোনামে একটি লেখা দেখি। ভারতীয় গণমাধ্যম জি টুয়েন্টি ২৪ এর সূত্রে সে গবেষণায় দাবি করা হয়— ‘পিরিয়ডের সঙ্গে শারীরিকক সম্পর্কের কোনও শত্রুতা নেই। বরং পিরিয়ড চলাকালীন শারীরিক সম্পর্ক স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ ভালো। ঋতুমতী অবস্থায় যৌনতার দুর্দান্ত চারটি সুফল রয়েছে বলেও দাবি করা হয়। নানানভাবে বিষয়টির সুফল বর্ণনার চেষ্টা করা হয়।
আমি মূল সূত্র ভারতীয় গণমাধ্যম জি টুয়েন্টি ২৪ও দেখেছি কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সেখানে গবেষণাকারী কোন প্রতিষ্ঠান কিংবা সংস্থার নাম উল্লেখ নেই। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পিরিয়ডের সময় সহবাসে কোন সমস্যা আছে কি না? এ বিষয়ে অনেকে জানতে চেয়েছেন। এ ব্যাপারে আমাদের গর্বের ধর্ম ইসলামের ম্যাসেজ একদম সুস্পষ্ট, কল্যাণকর ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও সার্টিসফাইড।
ইসলামের দৃষ্টিতে পিরিয়ড চলাকালীন শারীরিক সম্পর্ক তথা স্ত্রীর সাথে সহবাস করা হারাম। কবিরা গুনাহ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘লোকে তোমাকে রক্তস্রাব সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে। বল, উহা অশুচি। সুতরাং তোমরা রক্তস্রাবকালে স্ত্রী সংগম বর্জন করবে এবং পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী সংগম করিবে না। অতপর তাহারা যখন উত্তম রূপে পরিশুদ্ধ হইবে, তখন তাহাদের নিকট ঠিক সেইভাবে গমন করিবে যেভাবে আল্লাহ তোমাদিগকে আদেশ দিয়েছেন। (সুরা বাকারা:২২২, ইফাবা)
সুতরাং স্বামীর জন্য জায়েয হবে না স্ত্রী সহবাস করা যতক্ষন না স্ত্রী হায়েয থেকে মুক্ত হয়ে গোসল করে পবিত্র হয়। হায়েয অবস্থায় স্ত্রী সহবাস যে একটি গর্হিত ও হারাম কাজ রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হাদিস থেকেও তার প্রমান পাওয়া যায়। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল সা. আমাদের কারো পিরিয়ড অবস্থায় আমাদেরকে স্যালোয়ার পড়ার নির্দেশ দিতেন এরপর আমাদের গায়ে লেগে শুতেন। তোমরা সতর্ক থাকো কেননা কে তোমাদের মধ্যে রাসুলের মতো নিবৃত্ত করতে সক্ষম? (সহিহ বুখারি: ৩০২) রাসুল সা. বলেছেন- ‘যে ব্যাক্তি হায়েয অবস্থায় সহবাস করে বা পিছনের রাস্তা দিয়ে স্ত্রীর সাথে মিলন করে কিংবা কোন গণকের কাছে গমন করে, তবে সে আমার নিকট যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অস্বীকার করল। (তিরমিযী) ভুলে কেউ এ কাজ করলে কোন গুনাহ হবে না তবে তওবা ইসতেগফার করতে হবে আর ইচ্ছাকৃত করলে এক দিনার পরিমান সদকা করা মুস্তাহাব। (ফতোয়া শামি১/৪৯৫ জাকারিয়া, ফতোয়া হিন্দিয়া:১/৩৯) এমনকি স্ত্রীর সন্তুষ্টিতে যদি স্বামী স্ত্রীর সাথে পিরিয়ড অবস্থায় সহবাস করে তাহলে স্ত্রীও গুনাহগার হবে। (মাহমুদিয়া:৮/২২৫) আল-মাজমূ শারহুল মুহায্যাব ২য় খন্ডের ৩৭ নং পৃষ্ঠায় ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, পিরিয়ড চলাকালে যে ব্যক্তি স্ত্রী সঙ্গমে লিপ্ত হবে তার কবীরা গুনাহ হবে।
আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে, পিরিয়ড অবস্থায় স্ত্রী সহবাস হারাম হওয়ার ব্যাপারে সমস্ত মুসলমান একমত। এখানে কারো কোন দ্বিমত নেই। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলা এবং পরকালের প্রতি ঈমান রাখে তার জন্য এমন একটি অসৎ কাজকে বৈধ মনে করা কোনভাবেই উচিৎ নয়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও পিরিয়ড অবস্থায় স্ত্রী সহবাস খুবই ঝুকিপূর্ণ। সেন্ট্রাল হাসপাতাল লিমিটেড এর গাইনি কনসালট্যান্ট ডা. বেদৌরা শারমিন তার একটি আর্টিক্যালে বলেন, পিরিয়ড চলাকালীন শারীরিক সম্পর্কে ইনফেকশন হতে পারে। শরীর থেকে প্রভাবিত রক্ত পেটের অন্য কোনো অংশে ঢুকে যেতে পারে।
পেটের অন্য অংশ ঢোকার পর রক্ত জমাট বেঁধে হতে পারে বিপত্তি। এ ছাড়া মাসিকের সময় জরায়ু ও যোনির অ¤øভাব থাকে না। তাই এটি খুব সহজেই রোগজীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। শারীরিক মিলনের পরবর্তী সময়ে প্রচÐ ব্যথা হতে পারে। জরায়ুমুখ ঘুরে যেতে পারে, যা পরবর্তী সময় মারাত্মক কুফল বয়ে আনতে পারে। (যুগান্তর ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭) তাছাড়া স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রায় সব ম্যাগাজিন, আর্টিকেলে বিষয়টিকে ক্ষতিকার বলে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সমস্ত ডাক্তারদের মতও একই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পিরিয়ডের সময় শরীর থেকে যে রক্ত প্রবাহিত হয় তার মধ্যে প্রচুর ব্যাকটেরিয়া থাকে যা পুরুষদের সিফিলিস, গোনোরিয়াসহ নানা রোগের কারণ হতে পারে। এবং পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে নরমাল ডিফেন্স মেকানিজম নষ্ট হয়ে যায়। মহিলাদের প্রজনন অঙ্গের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায় তাই এ অবস্থায় তার সাথে সহবাস করা, তার উপর অমানবিক জুলুম বৈ কি?
অনেকেই পিরিয়ডের সময় সহবাসকে বিকৃত যৌনাচারের দৃষ্টিতে দেখেন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ছাড়াও এ হীন কর্মটি রুচি ও শুচিতার পরিপন্থি। মানবীয়বোধ ও সুস্থরুচিতে যা কোন ভাবেই যায় না। একটি ‘উড়ন্ত’ গবেষণা কিংবা নোংরার ফানুসে হারিয়ে যেন না যায় আমাদের বোধ।
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া কারিমিয়া, রামপুরা, ঢাকা।