শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
কাল যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন: মজলিস মহাসচিব ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল

শোকে কাতর ২০২০: যে আলেমদের হারালাম আমরা! (শেষ পর্ব)

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

২০২০ সালে যারা আমাদের ছেড়ে প্রভূর সান্নিধ্যে পাড়ি জমিয়েছেন তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ ধারাবাহিক তালিকা উল্লেখ করবো আমরা। মোট ৩২ জন আলেমের জীবনী তিনটি পর্বে উল্লেখ করা হচ্ছে ইনশাআল্লাহ। ধারাবাহিক তিন পর্বের গত ২৯ ডিসেম্বর ছিলো দ্বিতীয় পর্ব। আজ থাকছে শেষ পর্ব। এ তালিকার সিরিয়াল জৈষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়। বছরের শেষ দিক (ডিসেম্বর-জানুয়ারি ২০২০) থেকে হিসেব করে সাজানো হয়েছে নিম্মের আয়োজন-মোস্তফা ওয়াদুদ, নিউজরুম এডিটর।।


২০২০। আমুল হুজুন। শোকের বছর। বাংলার শীর্ষ আলেমদের হারানোর বছর। দেশের জনগণের শোকে কাতরের বছর। এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ আলেম হারানোর বেদনায় মর্মাহত। কোটি জনতার হৃদয়ের মানুষগুলো বিদায় নিয়েছে এ বছর।

যারা মানুষকে ডাকতো হকের পথে। শোনাতো কুরআনের বাণী। পৌঁছাতো রাসূলের কথা। যাদের হৃদয়গ্রাহী আলোচনা শুনে দীনের পথ লাভ করতো এদেশের কোটি কোটি মানুষ। হেদায়াতের আলোয় আলোকিত হতো মানুষের চিত্ত-মন-হৃদয় ও অন্তর। কিন্তু এখন থেকে তারা আর কোনোদিন মানুষকে নামাজের জন্য ডাকবেন না। শোনাবেন না হেদায়াতের বাণী। তাদের দরদমাখা নসিহত আর আমাদের কর্ণকুহরে বেজে উঠবে না।

এ বছর দেশের যত আলেমরা বিদায় নিয়েছেন। বাংলাদেশ জন্মের পর এক বছরে এতো আলেম কখনোই বিদায় নেয়নি। বছরের প্রথম থেকেই শুরু হয় আলেমদের মৃত্যু মিছিল। কিন্তু শেষ অবধি এ মিছিলের সারি এতো লম্বা হবে! তা হয়তো বছর শুরুর প্রারম্ভে কেউই ভাবেনি। আমরা হিসেব করে দেখেছি সারাদেশের উল্লেখযোগ্য প্রায় ৩২ জন বিখ্যাত আলেমেদীন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। পাড়ি দিয়েছেন আসল বাড়িতে। ‘মাউতুল আলিম মউতুল আলম’-একজন আলেমের মৃত্যু মানে একটি পৃথিবীর মৃত্যু। ২০২০ সালের ক্যালেন্ডারের লাল দাগ দেয়া তারিখগুলো আমাদেরকে আরবি বহুল শ্রুত এই প্রবাদ কথাটিই মনে করিয়ে দেয়।

গতপর্বের পর থেকে, ২১. শায়খুল হাদিস মাওলানা আবদুল মুমিত ঢেউপাশী রহ.

বৃহত্তর সিলেট বিভাগের শীর্ষ আলেম মাওলানা আবদুল মুমিত (৭২) ঢেউপাশী ২৮ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে সিলেট মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মাওলানা আবদুল মুমিত দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। তিনি সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের ঢেউপাশা গ্রামের নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য সিলেট নগরীর মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। প্রচারবিমুখ সাদাসিধে জীবনের অধিকারী এই আলেম হাদিসের দক্ষ শিক্ষক হিসেবে কওমি অঙ্গনের মাদরাসাগুলোতে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। বুধবার (২৯ এপ্রিল) দেশব্যাপী প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন বিবেচনায় পারিবারিকভাবে জানাজা শেষে নিজ গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

মাওলানা আবদুল মুমিত ঢেউপাশী ১৯৪৮ সালে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের ঢেউপাশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে বৃহত্তর সিলেটের শীর্ষ কওমি মাদরাসা গহরপুর থেকে দাওরায়ে হাদিস পাশ করেন। পারিবারিক জীবনে ৬ ভাই আর ২ বোনের মধ্যে মাওলানা আবদুল মুমিত ঢেউপাশী ছিলেন সবার বড়। তিনি ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক।

২২. আল্লামা জুবায়ের আহমদ আনসারী রহ.

১৭ এপ্রিল ইন্তেকাল করেছেন, বিশ্ব নন্দিত মুফাচ্ছিরে কুরআন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির, বি-বাড়ীয়ার বেড়তলা জামিয়া রাহমানিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল আল্লামা জুবায়ের আহমদ আনসারী।

তিনি ১৭ এপ্রিল মাগরিবের পূর্বে নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো আনুমানিক ৭০ বছর। মাওলানা জোবায়ের আহমদ আনসারী দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ ছিলেন। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি দেশ বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি দীর্ঘ সময় আমেরিকায় ছিলেন। তার বেশ কয়েকবার অপারেশন এবং কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিলো। সর্বশেষ গত কয়েক মাস ধরে তিনি নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন।

মাওলানা জোবায়ের আহমদ আনসারী বাংলদেশের একজন প্রখ্যাত ওয়ায়েজ। তিনি প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি দাওয়াতী ময়দানে কাজ করেছেন। দাওয়াতী কাজে সফর করেছেন ইউরোপ আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ।

২৩. মাওলানা আবদুর রহীম বুখারী রহ.

১৬ এপ্রিল ইন্তেকাল করেছেন মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুর রহীম বুখারী। তিনি জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার মুহতামিম আল্লামা মুফতি আব্দুল হালিম বোখারীর ছোট ভাই। আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ-এর পরিদর্শক ও চকরিয়া ইমাম বোখারী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। দার্শনিক রাজনীতিবিদ খতীবে আজম আল্লামা ছিদ্দিক আহমদ রহ. এর একান্ত শিষ্য, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির নেতা, পাণ্ডিত্যের অধিকারী আলেম ও সুবক্তা ছিলেন।

তিনি ১৬ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার দুপুর ২ টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।

২৪. মাওলানা মুজিবুর রহমান পেশওয়ারী রহ.

১৪ এপ্রিল মঙ্গলবার বিকাল ৪ টায় ইন্তেকাল করেছেন খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির, প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ মাওলানা সৈয়দ মুজিবুর রহমান পেশওয়ারী (মির্জাপুরের পীর সাহেব)।

মৃত্যুকালে মরহুমের বয়স হয়েছিলো ৭০ বছর। বার্ধক্যজনিত কারণে ও দীর্ঘদিন শারিরীক অসুস্থতায় ভুগে তিনি ইন্তেকাল করেছেন।

২৫. মুফতি ড. আবদুল্লাহ বিক্রমপুরী রহ.

৮ এপ্রিল বুধবার বাদ মাগরিব ইন্তিকাল করেছেন, ইসলামী অর্থনিতিবিদ, শায়খুল হাদিস, মুফতি ড. আবদুল্লাহ বিক্রমপুরী। তিনি কর্মজীবনে ঢাকা ইসলামপুর তাতিবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব ছিলেন। এছাড়াও তিনি ঐতিহ্যবাহী মোস্তফাগঞ্জ মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস ছিলেন। এবং তিনি জামালুল কুরআন মাদরাসা গেন্ডারিয়ায় বুখারীর দরস দিতেন । তিনি ছিলেন হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফির শীর্ষস্থানীয় খলিফাদের মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়াও তিনি সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান ও ট্রাস্ট ব্যাংক শরিয়াহ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন ।

৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে কুর্মিটোলা মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬০ বছর।

২৬. আল্লামা আব্দুল মোমিন রহ. (শায়খে ইমামবাড়ি)

৮ এপ্রিল বুধবার রাতে ইন্তেকাল করেছেন উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শায়খুল ইসলাম সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানি রহ.-এর খলিফা, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি ও জামেয়া দারুল কোরআন সিলেটের শায়খুল হাদিস, প্রখ্যাত বুযুর্গ পীরে কামেল আল্লামা শাহ আব্দুল মোমিন (শায়খে ইমামবাড়ি)।

৮ এপ্রিল রাত ১২ টা ৪৫ মিনিটে বার্ধক্যজনিত কারণে নিজ গৃহে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৯৯ বছর। মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন তিনি বিভিন্ন শারিরীক অসুস্থতায় ভুগেছেন।

২৭. শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল হাই রহ.

২০২০ সালের ২৮ মার্চ সিলেটের বরেণ্য আলেম ও বাংলাদেশের প্রবীণ আলেমদের মধ্যে অন্যতম শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল হাই ইন্তেকাল করেন। নিজ বাড়ির পাশেই মারকাজু তালীমিন্নিসা বংশিবপাশা, আজমিরীগঞ্জ, হবিগঞ্জ নামে একটি মহিলা দ্বীনী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। একই সাথে তিনি সিলেটের একাধিক মাদরাসার শায়খুল হাদীস ছিলেন।

২৮ মার্চ ১২ টা ৩০ মিনিটে এই বর্ষিয়াণ আলেম নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৯৮ বছর। তিনি পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে সন্তান সহ অসংখ্য আত্মীয় স্বজন গুনাগ্রাহী ও ছাত্র রেখে যান।

২৮. মাওলানা মোজাম্মেল হক রহ.
তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বি ও কাকরাইল মারকাজের প্রবীণ শূরা সদস্য মাওলানা মোজাম্মেল হক (৯৫) গত ৮ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।

২৯. আজহার আলী আনোয়ার শাহ রহ.

আযহার আলী ১৯৪৭ সালের ২ জানুয়ারি কিশােরগঞ্জের শহীদি মসজিদ সংলগ্ন পৈতৃক বাসায় জন্মগ্রহণ করেন । তার পিতার নাম আতহার আলি, তিনি নেজামে ইসলামী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও পূর্ব বাংলা আইনসভার সদস্য ছিলেন।

তিনি স্বীয় পিতার কাছে শিক্ষাজীবনের সূচনা করেন। পিতার খলিফা নিছার আলীর কাছে ধর্মীয় এবং মাস্টার আব্দুর রশীদের কাছে সাধারণ বিষয়ের প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৬১ সালে তার পিতার প্রতিষ্ঠিত আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ায় হাফেজ নূরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে কুরআনের হেফজ শেষ করেন।

একই প্রতিষ্ঠানে ১৯৬৪ সালে আব্দুল হক কাসেমির তত্ত্বাবধানে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তারপর পিতার নির্দেশে তিনি পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান। সেখানের বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত লেখাপড়া করেন । ১৯৬৭ সালে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া পাকিস্তানের অধীনে কেন্দ্রীয় দাওরায়ে হাদীস ( মাস্টার্স ) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে : মুহাম্মদ ইউসুফ বান্নুরি, ওয়ালী হাসান টুকী, মুহাম্মদ ইদরিস মিরাঠী, আব্দুল্লাহ দরখাস্তী সহ প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ।

এছাড়া ১৯৬৬ সালে মিশর থেকে পাকিস্তানে আগত আতা সােলাইমান রিযক্ব‌ আল মিশরী ও ইবরাহীম আব্দুল্লাহর কাছে তিনি কুরআনের ক্বেরাতের উপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর ১৯৬৮ সালে তিনি আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ায় শিক্ষক হিসেবে যােগদান করেন । স্বাধীনতা পরবর্তী দুর্যোগকালে মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি কিছুদিন ব্যবসা করেন। ১৯৭৫ — ৭৬ সালে জামিয়া ইসলামিয়া মােমেনশাহীতে শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন । ১৯৭৭ সালে পুনরায় আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ায় যোগদান করেন। ১৯৭৯ সালে অত্র জামিয়ার সহকারী পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৮৩ সালে পরিচালক পদে উন্নীত হয়ে মৃত্যু অবধি এই দায়িত্বে ছিলেন।

এর পাশাপাশি তিনি শহীদি মসজিদের মুতাওয়াল্লী , ইমাম ও খতীবের দায়িত্ব পালন করেন । তিনি নুরুল উলুম কুলিয়ার চর মাদ্রাসা ও জামিয়া ইসলামিয়া গাইলকাটা মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন । সেই সাথে তিনি পটিয়া মাদ্রাসা , ভাস্করখিল মাদ্রাসা , আব্দুলাহপুর মাদ্রাসা , বারইগ্রাম মাদ্রাসা , ইসলামপুর মাদ্রাসাসহ বহু মাদ্রাসার মজলিশে শুরার সদস্য ছিলেন।

তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহ-সভাপতি , আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের সদস্য , তানযীমুল মাদারিস (আঞ্চলিক কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বাের্ড ) বৃহত্তর মােমেনশাহীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি , কিশােরগঞ্জ ইমাম ও উলামা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি , দাওয়াতুল হক কিশােরগঞ্জ ও দাওয়াতুল কোরআন সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি আশরাফ আলী থানভীর খলীফা আবরারুল হক মক্কীর নিকট বায়আত গ্রহণ করেন । ২০০৪ সালে তার কাছ থেকে খেলাফত লাভ করেন। এছাড়াও তিনি যাদের কাছে খেলাফত পেয়েছেন : জাফর আহমদ উসমানীর খলীফা খাজা শামছুল হক, কিশোরগঞ্জ। আতহার আলির খলীফা আব্দুল মান্নান, সিলেট। আব্দুল ওয়াহহাবের খলীফা ফয়জুর রহমান, মােমেনশাহী। আসআদ মাদানীর খলীফা এহসানুল হক সন্দ্বীপি, চট্টগ্রাম।

তার প্রকাশিত গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে : তথাকথিত আহলে হাদীস ফিতনার জবাব, কিছু বিক্ষিপ্ত কথা, খুতবাতে শায়খ আনোয়ার শাহ, সমকালীন সমস্যাবলির শরয়ী সমাধান, স্মৃতির আয়নায় প্রিয় মুখ।

তিনি ১৯৭৬ ও ২০০০ সালে দুইবার হজ পালন করেন। ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়া , ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরে শিক্ষা সফর করেন । ১৯৮৭ সালে ইরাকের তৎকালীন ধর্মমন্ত্রীর দাওয়াতে তিনি ইরাক সফর করেছিলেন । ১৯৯৪ সালে আবরারুল হক মক্কীর সান্নিধ্যে লাভের জন্য ভারত সফর করেছিলেন। ২০০০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ২০০৩ সালে শাহ হাকীম আখতারের ছেলে মাযহারের দাওয়াতে তিনি পাকিস্তান সফর করেছিলেন।

তিনি ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি বার্ধক্যজনিত কারণে ইবনে সিনা হাসপাতাল, ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে তার জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাযায় ইমামতি করেন তার ছোট ছেলে আনজার শাহ তানিম। তার জানাযায় প্রায় ৫ লক্ষ লোক অংশগ্রহণ করে। জানাযা শেষে শোলাকিয়াস্থ বাগে জান্নাত কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

৩০. মাওলানা মোহাম্মদ আবু তাহের রহ.

চট্টগ্রাম দারুল মাআরিফের মুহাদ্দিস মাওলানা মোহাম্মদ আবু তাহের ২০ মে ইন্তেকাল করেন। প্রচারবিমুখ এই আলেম অত্যন্ত পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। ১৯৬০ সালের ১ জানুয়ারি মহেশখালীর অন্তর্গত কালাগাজির পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পাঁচ ভাইবোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।

১৯৮০ সালে পটিয়া মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। চার ছেলে ও দুই কন্যার জনক মাওলানা মোহাম্মদ আবু তাহের কক্সবাজার খুরুশকুল মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে ৮ বছর শিক্ষকতা শেষে ১৯৮৮ সালে আল্লামা সুলতান যওক নদভীর আহবানে সাড়া দিয়ে দারুল মাআরিফে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এখানে ৩২ বছর শিক্ষকতা করেন। লেখক ও কবি হিসেবে তার বেশ সুনাম রয়েছে। তাকে জামেয়া দারুল মাআরিফের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

৩১. আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী রহ. (১৯৩৮-২০২০)

শায়খুল হাদিস হযরত মাওলানা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী ১৩৫৯ হিজরি মোতাবেক ১৯৩৮ সালে হবিগঞ্জের কাঠাখালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শায়খ আব্দুন নূর রহ. (মৃত্যু ১ আগস্ট ১৯৯৯ সাল), মাতা মরহুম শামসুন নেসা রাহ.। তাঁর নানা হযরত মাওলানা আসাদুল্লাহ রাহ. ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রথম সারির এক মুজাহিদ ছিলেন।

পিতা-মাতার কাছেই শায়খুল হাদিস হবিগঞ্জী রাহ.’র পড়াশোনার হাতেখড়ি। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন তাঁর পিতার কাছে, কাটাখালী মাদরাসায়। এটি তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা। এরপর তিনি হবিগঞ্জের অদূরে রায়ধর গ্রামে ‘জামেয়া সাদিয়ায়’ ভর্তি হন। সেখানে তিনি তাঁর মামা হযরত মাওলানা মুখলিসুর রাহমান রাহ.’র কাছে আরবিব্যাকরণ ও আরবিভাষা রপ্ত করেন। তাঁর মামা ছিলেন শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানি রাহ.’র ছাত্র। প্রাথমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে তিনি জামিয়া আহলিয়্যা মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে চলে যান। সেখানে ফিক্হ, উসূলে ফিক্হ, তাফসির, উসূলে তাফসির, হাদিস, উসূলে হাদিস, মানতিক-ফালসাফাসহ ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শাখার জ্ঞান অর্জন করেন। এখানে তিনি মুফতি ফায়যুল্লাহ রাহ.’র বিশেষ সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন। তিনি হাটহাজারী মাদরাসা থেকে ১৯৬০-৬১ সালে ‘দাওরায়ে হাদিস’ সম্পন্ন করেন।

দাওরায়ে হাদিস শেষ করে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে ‘জামেয়া আশরাফিয়া লাহোর’ এ দ্বিতীয়বার দাওরায়ে হাদিসে ভর্তি হন। সেটা ১৯৬১-৬২ সালের কথা। এরপর তিনি কানপুর চলে যান। সেখানে হাফিযুল হাদিস আব্দুল্লাহ দরখাস্তি রাহ. (মৃত্যু : ১৪১৫ হিজরি)’র কাছে তাফসিরের বিশেষ পাঠ গ্রহণ করেন। এরপর ‘জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া করাচি’ মাদরাসায় শায়খুল হাদিস ইউসূফ বাননূরী রাহ.-’র সান্নিধ্যে যান। সেখানে তাঁর কাছে তিনি তিনটি কিতাবের বিশেষ দারস গ্রহণ করেন। সেগুলো হচ্ছে, সাহিহুল বুখারি, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ও তাফসিরুল কুরআন।

পাকিস্তান থেকে তিনি ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দে পাড়ি জমান। ভারত-পাকিস্তান ভাগের জেরে দারুল উলূম দেওবন্দে তখন পাকিস্তানি ছাত্র ভর্তি বন্ধ ছিলো। শায়খুল হাদিস হবিগঞ্জী দা.বা. দেওবন্দে যখন পৌঁছেছেন, তখন ভতির্র সময়ও শেষ। এই দুই কারণে তিনি নিয়মিত ছাত্র হিসেবে ভর্তি হতে পারেননি। তবে তৎকালীন মুহতামিম ক্বারি তায়্যিব রাহ.’র অনুমতিতে দারুল উলুম দেওবন্দে ‘খুসূসি দারস’ (বিশেষ পাঠ্য) গ্রহণ করেন। ওইসময় তিনি জামে তিরমিযি পড়েন শায়খ ইবরাহিম বলিয়াভি রাহ.’র কাছে। তাফসিরে বায়যাবি পড়েন হযরত মাওলানা ফখরুল হাসান রাহ.’র কাছে। হযরত মাওলানা ক্বারি তায়্যিব রাহ.’র কাছ থেকে নেন হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার খুসূসি দারসও।

সহিহ বুখারির সাথে শায়খুল হাদিস হবিগঞ্জী রাহ.’র এক নিবিড় সর্ম্পক গড়ে উঠে। তিনি এ কিতাবটি পাঁচজন শায়খুল হাদিসের কাছে পড়েছেন। তাঁদের কাছ থেকে বুখারির দারস প্রদানের অনুমতিও পেয়েছেন।

প্রথমবার পূর্ণরূপে পড়েছেন হাটহাজারী মাদরাসায় শায়খ আব্দুল কাইয়্যূম রাহ.’র কাছে। দ্বিতীয়বার পড়েছেন মুফতিয়ে আযম শায়খ ফায়যুল্লাহ রাহ.’র বাড়িতে। তৃতীয়বার পড়েছেন লাহোরে মাওলানা শায়খ ইদরিস কান্ধলভি রাহ.’র কাছে। চতুর্থবার পড়েছেন শায়খ ইউসুফ বানুরি রাহ.’র কাছে। পঞ্চমবার পড়েছেন দারুল উরুম দেওবন্দে শায়খ ফখরুদ্দিন আহমদ মুরাদাবাদি রাহ.’র কাছে। সাহারানপুরে শায়খুল হাদিস যাকারিয়া রাহ.’র কাছেও বুখারির একাংশ পড়েছেন। এভাবে ‘খুসূসি দারস’ শেষে ১৯৬৩ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।

১৯৬৪ সালে কুমিল্লার দারুল উলুম বরুড়া মাদরাসায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবনের শুরু। ৬৪ সাল থেকে ৬৬ সাল পর্যন্ত তিন বছর এ মাদরাসায় হাদিস, তাফসিরসহ বিভিন্ন কিতাবের দারস দেন।

১৯৬৬ সালের শেষ দিকে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মুহতামিম হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব রাহ.’র নির্দেশে ময়মনসিংহের আশরাফুল উলুম বালিয়া মাদরাসায় শায়খুল হাদিস হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিন বছর বালিয়া মাদরাসায় হাদিসের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯-৭১ সালের ১৬ ডিসম্বরের পূর্ব পর্যন্ত ময়মনসিংহের জামিয়া ইসলামিয়ায় দারসে হাদিসের খেদমত আঞ্জাম দেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হবিগঞ্জে আসেন। এলাকাবাসীর অনুরোধে ও হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ.’র নির্দেশে হবিগঞ্জের জামিয়া আরাবিয়া উমেদনগর মাদরাসায় যোগদান করেন। ইন্তেকাল অবধি এ মাদরাসাতেই মুহতামিম ও শায়খুল হাদিসের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন।

মহান আল্লাহ তায়ালা হযরতকে বুখারির দারসের জন্য কবুল করে নিয়েছেন। আশরাফুল উলুম বালিয়া মাদরাসা থেকে শুরু করে সুদীর্ঘ প্রায় ৫৩ বছর থেকে সহিহ বুখারির দারস দিয়েছেন। ১৪৪০ হিজরির ২৮ রমজান থেকে তিনি জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গার শায়খুল হাদিস হিসেবে নিয়োগ পান। ১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার তিনি জামেয়ায় প্রথম দরস প্রদান করেন।

শায়খুল হাদিস হবিগঞ্জী রাহ. জীবনের দীর্ঘ সময় বিভিন্ন মনীষার সান্নিধ্যে থেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিজেকে উচ্চতর আসনে উন্নীত করেন। আধ্যাত্মিক সাধনায় প্রথমে তিনি মুফতিয়ে আযম শায়খ ফায়যুল্লাহ রাহ.-’র কাছে বায়আত হন। তাঁর ইন্তেকালের পর শায়খুল ইসলাম মাদানি রাহ.’র কয়েকজন খলিফার সাথে পরামর্শ, ইস্তেখারা ও দিলের রুজহানের কারণে হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ.’র কাছে বাইয়াত হন। শায়খুল হাদিস হবিগঞ্জী তাসাউফের উপর দীর্ঘদিন রিয়াযত ও মুজাহাদা করেন। এরপর এক সময় হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ. তাঁকে ইজাযত প্রদান করেন।

শুধু দারস-তাদরিস ও তাযকিয়ায়ে নাফসই নয়, শায়খুল হাদিস হবিগঞ্জী রাহ. রাজনীতির ময়দানেও সমান অবদান রেখেছেন। আমৃত্যু তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও হবিগঞ্জ জেলার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসলামি আন্দোলনের এক অগ্রণী নেতৃপুরুষ হিসেবে তিনি সারা দেশে নন্দিত ও সমাদৃত ছিলেন। ইসলাম ও মুসলিম জাতির স্বার্থে তাঁর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা সুবিদিত।

শায়খুল হাদিস হবিগঞ্জী রাহ. ময়মনসিংহের বিখ্যাত আলিম হযরত মাওলানা আরিফ রব্বানি রাহ. {মৃত্যু-১৯৯৭সাল}’র ৪র্থ কন্যা আইনুন নাহার লুৎফার সাথে ১৯৬৭ সালে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। শায়খের ৬ ছেলে ও ৪ মেয়ে। এক ছেলে শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। বাকি সবাই যোগ্য আলিম ও আলিমা হয়ে দ্বীনের বহুমুখী খিদমাত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে:
১. تحذير الإخوان عن صحبة الأمارد والصبيان (ছোট বাচ্চাদের সাথে মিলামিশা করা থেকে সতর্কিকরণ): পুস্তিকার উপর মুফতি ফয়জুল্লাহ ও শাইখ কুরবান আলীর অভিমত লেখা আছে। মূল গ্রন্থটি উর্দূতে লেখা।
২. جواهر الأدب في لسان العرب : এটি আরবী ভাষায় কাছাকাছি বিভিন্ন শব্দের আভিধানিক পার্থক্যের উপর লিখিত গ্রন্থ। গ্রন্থটি প্রায় আড়াইশ পৃষ্ঠার। মাওলানা তাহমিদুল মাওলার টীকা ও সম্পাদনায় গ্রন্থটি ছেপেছে মাকতাবাতুল আযহার।
৩. হয়রত লোকমান আ. এর সতর্কবাণী।
৪. হাফিযুল হাদীস আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রহ.এর জীবনী।
৫. দরসে হুজ্জাতুল্লাহ : হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা কিতাবের দরসের সংকলন। (অপ্রকাশিত)
৬. মনীষীদের স্মৃতিচারণ।
৭. تحرير الأسانيد: এটি হবিগঞ্জীর বিভিন্ন হাদীসের গ্রন্থের সনদ ও ইজাযতের উপর লিখিত। গ্রন্থটি সংকলন করেছেন মাওলানা তাহমিদুল মাওলা। (অপ্রকাশিত)

শ্বাসকষ্টজনিত কারণে তিনি ৫ জানুয়ারী ২০২০ মৃত্যুবরণ করেন। একদিন পর উমেদনগর মাদ্রাসায় তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযায় ইমামতি করেন তার বড় ছেলে মাসরুরুল হক। তার জানাযায় কয়েক লক্ষ মানুষ অংশগ্রহণ করে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।

৩২. আল্লামা আশরাফ আলী রহ. (১৯৪০-২০১৯)

১৯৪০ সালের ১ মার্চ কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। তার পিতার নাম আলহাজ্ব মাওলানা মুফিজুদ্দীন রহ.।

শিক্ষার সূচনা পারিবারিক পরিবেশে। প্রাথমিক শিক্ষা পারিবারিকভাবে শেষ করে এলাকার প্রাচীন শিক্ষালয় মাযহারুল উরুম যশপুরে ভর্তি হন। এখানে ৫ বছর লেখা পড়া করে চলে যান কুমিল্লা শহরের ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা কাসেমুল উলুমে। সেখানে ২ বছর লেখা পড়া করেন। এরপর ঢাকার অন্যতম বিদ্যাপিঠ হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম বড় কাটারায় ভর্তি হন। এখানেই দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন। উচ্চস্তর হাদীস গবেষনণা এবং ইলমে কুরআনের উপর অধিকতর ব্যুৎপত্তি অর্জনের লক্ষ্যে সেকালের শ্রেষ্ঠতম হাদীস বিশারদ আল্লামা রাসূল খান রহ. এবং আল্লামা ইদ্রীস কান্ধলভী রহ. এর দরসগাহ জামিআ আশরাফিয়া লাহোর পাকিস্তানে চলে যান। সেখানে ধারাবাহিক দুই বছর অধ্যাপনা করেন।

কিশোরগঞ্জের জামিআ এমদাদিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্ম জীবন শুরু করেন। সেখানে তিনি মুসলিম শরীফের প্রথম খন্ডের দরস দেন। এখানে তিনি ৯ বছর শিক্ষকতা করেন। এরপর চলে আসেন ঢাকার ফরিদাবাদ মাদরাসায়। এখানে তিনি ৮ বছর শায়খে সানী ও নাযেমে তালিমাতের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বড় কাটারা মাদরাসায়ও শিক্ষকতা করেন এবং তিরমিজী শরীফের দারস প্রদান করেন। আল্লামা আশরাফ আলী তার মায়ের কথায় কুমিল্লা জামিআ কাসেমুল উলুমে চলে আসেন। সেই থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জামিআর শায়খুল হাদীস ও সদরুল মুদাররিসীনের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সাল থেকে তিনি ঢাকার মালিবাগ মাদরাসায় হাদীসের দারস দিয়েছেন এবং মুহতামি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা মতিঝিল এজিবি কলোনীর খতীব ছিলেন দীর্ঘ কয়েক বছর। নিজ এলাকায় জামআি এমদাদিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়া ঢাকা, জামিআ ইসলামিয়া আরাবিয়া লালমাটিয়া, দারুল উলুম মিরপুর-৬, জামিয়া ইসলামিয়া বায়তুল ফালাহ ঢাকা, বনানী টি এন্ড টি মাদরাসা ও মিরপুর দারুস সালামসহ দেশের বিভিন্ন মাদরাসায় তিনি বোখারী শরীফের দারস দান করেন। পাশাপাশি তিনি অনেক মাদরাসার মজলিসে শূরার সভাপতি ও সদস্য হিসেবে বহু খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) এর সিনিয়র সহ-সভাপতি, আল হাইয়াতুল উলয়া এর কো চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।

কাসেমুল উলুম মাদরাসায় পড়াকালীন সময়ে তিনি আল্লামা আতহার আলী রহ. ডাকে সাড়া দিয়ে নেজামে ইসলাম পার্টির কর্মী হিসেবে কাজ করেন। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি নেজাম ইসলাম পার্টির কিশোরগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি নেজামে ইসলাম পার্টিকে সুসংগঠিত করেন ও কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর সম্মিলিত জোটেও যোগদান করেন। সুলুক ও তরিকতের দিকে অধিক ঝুকে পড়ায় তিনি বেশ কিছু সময় রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। পরবর্তীতে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. তাকে খেলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরীক হওয়ার দাওয়াত দিলে তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসে যোগদান করেন এবং এক সময়ে নায়েবে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের অভিভাবক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে ছিলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন।

তিনি বেশ কিছু বই লিখে ও অনুবাদ করে লেখনীর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তার লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কওমী মাদরাসা কি ও কেন, শহীদে কারবালা, গুনাহ থেকে বাঁচার উপায়, শাহ ওয়ালী উল্লাহ রহ. এর চল্লিশ হাদীস ইত্যাদি।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি তাসাউফ চর্চায় আত্মনিমগ্ন। অধ্যয়নকালীন সময়ে আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বিশিষ্ট খলিফা আল্লামা রাসূল খান রহ. এর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেন। দেশে চলে আসার পর পাকিস্তান আমলেই তিনি খেলাফত পান। রাসূল খানের ইন্তেকালের পর তিনি আল্লামা শাহ হাকীম আখতার রহ. এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন এবং খেলাফত পান। সর্বশেষ আল্লামা শাহ আহমদ শফী দামাতবারকাতুহুম তাকে খেলাফত দেন। তিনি মানুষের আত্মসংশোধনের জন্য অসংখ্য মানুষকে বায়াত করেন এবং বেশ কয়েকজনকে খেলাফত দান করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শায়খুল হাদীস মাওলানা মামুনুল হক, প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুস সামাদ।

২০১৯ সালে ৩১ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাত ১.৪০ মিনিটে এ মহান বুযুগ ঢাকা আজগর আলী হাসপাতালে ইহকাল ত্যাগ করে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। নিজ গ্রাম কুমিল্লা সদর দক্ষিণ অলিবাজার মাদরাসা মাঠে লাখো মানুষের অংশ গ্রহণে জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি করেন হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ.। পারিবারিক কবরস্থানে পিতার পাশেই সমাহিত করা হয়।

আলবিদা

এই চলে যাওয়ার ধারা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। একজন আলেম চলে যাওয়া মানে মাথার ওপর থেকে একখণ্ড শীতল মেঘ সরে যাওয়া। একটি ঝলমলে প্রদীপ নিভে যাওয়া। এক এক করে বাংলাদেশ হারাচ্ছে তার ধর্মীয় অভিভাবক। আলো ও ছায়ার বটবৃক্ষ। শূন্যতা গ্রাস করছে, হাহাকার বাড়ছে। উল্লেখিত আলেম ছাড়া আরও অনেক আলেম, মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিনকে আমরা হারিয়েছি।

আমাদেরই প্রয়োজনে-কল্যানে তাদের বেঁচে থাকাটা খুব দরকার। দোয়ায় প্রার্থনায় তাদের বেঁচে থাকার মিনতি হয়ে উঠুক আমাদের কান্না, আমাদের অশ্রু। যারা চলে গেছে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে, তাদের মাগফেরাতের জন্য আমাদের হাত উঠুক মহামহিমের দরবারে। তার দরবার হতে, কেউ ফেরে না খালি হাতে।

এমডব্লিউ/ 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ