রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


প্রিয় তালিবানে ইলম! সুস্থতা ও অবসরের কদর করুন: মুফতি আবদুল মালেক

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি আবদুল মালেক।।

 

اَلْحَمْدُ لِلهِ وَسَلاَمٌ عَلى عِبَادِه الّذِيْنَ اصْطَفى، وَأَشْهَدُ أَنْ لَا إِلهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنّ مُحَمّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، أمّا بَعْدُ :

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই মহান হাদীস প্রায় সকল তালিবে ইলমের জানা, তিনি বলেন-

نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النّاسِ: الصِّحّةُ وَالْفَرَاغُ.

অর্থাৎ দুটি নিআমত এমন, যার বিষয়ে অনেক মানুষ ধোঁকায় থাকে; সুস্থতা ও অবসর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪১২

এমনিতে এই মহামূল্যবান নসীহতের মুখাতাব তো সকল মানুষই। তবে এই দুই নিআমত যাদের যত বেশি নসীব হয় এবং যাদের পক্ষে এই দুই নিআমতের কদর করা যত সহজ এবং যত অধিক জরুরি, তারা তো এই নসীহতের সর্বপ্রথম এবং সবচে গুরুত্বপূর্ণ মুখাতাব। কোনো সন্দেহ নেই, এ বিবেচনায় তালিবে ইলমের জামাতই এই নসীহতের কদর করার সবচেয়ে বেশি হকদার।

কিন্তু আফসোস! ফিকহ ও হাদীস উভয় শাস্ত্রের আলেম উজির ইয়াহইয়া ইবনে হুবায়রা যেমন বলেছিলেন আমাদের হালত দেখা যাচ্ছে তেমনি-

الوقت أنفسُ ما عُنِيتَ بحفظِه.

وأراه أسهلَ ما عليك يَضِيع.

অর্থাৎ তুমি যা কিছু সযতেœ সংরক্ষণ করবে তার মধ্যে সময়ই ছিল সবচেয়ে মূল্যবান; অথচ এটাই তোমার কাছে সবচেয়ে মূল্যহীনভাবে বিনষ্ট হয়ে যায়।

আমার প্রিয় তালিবানে ইলম!

দীর্ঘদিন থেকে আমরা সবাই এক রকমের বন্দিজীবন অতিবাহিত করছি। জানা নেই, এই ধারা আর কত দিন চলবে। দুআ করি, আল্লাহ তাআলা যেন এই ধারা আর অগ্রসর না করেন। দ্রæত শেষ করে দেন এবং আমাদেরকে স্বাভাবিক জীবন এবং আফিয়াতের যিন্দেগী দান করেন- আমীন। কিন্তু যতদিন এ ধারা চলবে ততদিন জরুরি হল, এই সাময়িক পরিস্থিতির জন্যও আমাদের সামনে একটি কর্মনীতি ও একটি নেযামুল আওকাত থাকবে, যাতে আমরা সুস্থতা ও অবসরের নিআমতের হক যথাযথ আদায় করতে পারি। আশা করি, প্রিয় তালিবানে ইলম নিজ নিজ জায়গায় এর ইহতিমাম করছেন। তবু মনে হল, কিছু বিষয় মুযাকারা করি, যাতে তা-

الدّالّ عَلَى الْخَيْرِ كَفَاعِلِهِ.

-এর দাবি মোতাবেক অথবা কমপক্ষে-

إذا تكرر تقرر في القلب.

-অনুযায়ী কিছু না কিছু সওয়াব হাসিলের মাধ্যম হয়ে যায়।

কী হবে কর্মপন্থা?

নেযামুল আওকাত তো প্রত্যেক তালিবে ইলম তার অবস্থা অনুযায়ী নিজেই তৈরি করবেন। আমি এখানে কর্মপন্থা সম্পর্কে আলোচনা করছি :

এক. ঈমান আমলের মেহনত

এর জন্য ইলমী মুতালাআরও প্রয়োজন; যার আলোচনা সামনে আসবে। এছাড়া বিশেষভাবে নি¤েœাক্ত বিষয়গুলোর ইহতিমাম অনেক জরুরি।

ক. কুরআন তিলাওয়াত

দৈনিক কিছু পরিমাণ হলেও তারতীলের সঙ্গে কুরআন তিলাওয়াত করবেন। আর যেসকল তালিবে ইলম অর্থ ও মর্ম বোঝেন তারা তাদাব্বুরেরও ইহতিমাম করবেন।

হাফেযগণের উচিত, তারা সুন্নত ও নফল নামাযে আলাদা কুরআন খতম করবেন। আল্লাহ্র নৈকট্য, আত্মশুদ্ধি, আমলের সংশোধন, উত্তম চরিত্র গ্রহণ এবং তাফাক্কুহ ফিদ্দীন অর্জনের ক্ষেত্রে তারতীল ও তাদাব্বুর সহকারে কুরআন তিলাওয়াতের কোনো বিকল্প নেই।

খ. দুআ ও যিকির

বিভিন্ন আমল বা বিভিন্ন অবস্থায় পঠিতব্য হাদীসে বর্ণিত দুআসমূহের প্রতি যতœবান হওয়া। এসব দুআ ইমাম নববী রাহ.-এর ‘আল আযকার’, ইমাম ইবনুল জাযারী রাহ-এর ‘আলহিসনুল হাসীন’, মুনাজাতে মাকবুলের পরিশিষ্ট, হিসনুল মুসলিম এবং ‘পুর নূর দুআয়ে’ এই কিতাবসমূহে আছে। এসব দুআ মুখস্থ করা এবং দেখে দেখে আমল করার অনেক সুবর্ণ সময় আমরা অতিবাহিত করছি।

এমনিভাবে الدعوات الجامعة কুরআনে কারীম ও হাদীস শরীফে বর্ণিত ব্যাপক অর্থবহ দুআ। এগুলোকে ‘মুনাজাতের দুআ’ নাম দেয়া যায়। এগুলো মুখস্থ করা, দিল হাযির রেখে মুনাজাতের নিয়তে দেখে দেখে পাঠ করা অনেক বড় কাজ। এর দ্বারা এ সময়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন- আল্লাহমুখী হওয়া, যা সবসময়েরই প্রয়োজন, তার কাজও হয়ে যাবে এবং এই নেক আমলের অভ্যাসও হয়ে যাবে।

এসকল দুআ আলহিসনুল হাসীনের পঞ্চম অধ্যায়ে, মোল্লা আলী কারী রাহ.-এর আলহিযবুল আযম কিতাবে এবং মুনাজাতে মাকবুলে আছে। মেশকাত শরীফ, মাআরিফুল হাদীস ইত্যাদি কিতাবেও একত্রে উল্লেখ আছে।

এছাড়াও বিভিন্ন তাসবীহ ও সকাল-সন্ধ্যার মাসনূন ওযীফা, বিশেষত দরূদ শরীফ, ইসতিগফার ও দুআয়ে ইউনুসের ইহতিমাম করা।

এ কাজ নিয়মতান্ত্রিক পড়াশোনার সময়ে তালিবুল ইলমদের জন্য অধিক পরিমাণে করা কঠিন। এই অবসরকে যদি এসকল

কাজে গুরুত্বের সাথে ব্যবহার করা হয় তাহলে ইনশাআল্লাহ কলবের ইনশিরাহ ও ইলম-আমলে বরকতের মত মহান নিআমতসমূহ হাসিল হতে থাকবে।

গ. নফল নামাযের ইহতিমাম

সবচে গুরুত্বপূর্ণ নফল হল তাহাজ্জুদের নামায। মাদরাসার নেযামুল আওকাত মেনে সকল তালিবুল ইলমের পক্ষে এর ইহতিমাম করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। এখন নেযামুল আওকাত এভাবে ঠিক করা যেতে পারে, যাতে সহজে তাহাজ্জুদের জন্য ওঠা যায় এবং দু-চার রাকাত হলেও পড়ে নিজের জন্য এবং পুরো মুসলিম উম্মাহ ও বিশ্ববাসীর জন্য দুআ করা যায়। এমনটি হলে তো অনেক বড় কিসমত। এটাও ভাবা উচিত যে, যখন মহান রবের পক্ষ থেকে দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে- ‘কে আছ প্রার্থনাকারী, আমার কাছে প্রার্থনা কর’- সেসময় উদাসীন হয়ে পড়ে থাকা কতটা অসঙ্গত?!

এই মৌসুমে রাত ছোট হওয়ায় যদি শেষরাতে ওঠা সম্ভব না হয় তাহলে বিতিরের আগে দু-চার রাকাত কিয়ামুল লাইলের নিয়তে অবশ্যই পড়ে নেয়া উচিত। হযরত হাকীমুল উম্মত থানবী রাহ.-সহ অনেক আকাবির দুর্বলদের জন্য এই মশওয়ারা দিয়েছেন। বিশেষ করে যেহেতু হাদীস শরীফে বিতিরের আগে দু-চার রাকাত নফল পড়ার তাকীদ আছে, সেজন্য এর ইহতিমাম অবশ্যই করা চাই।

তাহাজ্জুদ ছাড়া অন্যান্য নফল নামাযের অনেক ফযীলত ও ফায়েদা হাদীস শরীফে প্রমাণিত। যেমন ইশরাক, চাশত, আওয়াবীন, তাহিয়্যাতুল অযু, তাহিয়্যাতুল মাসজিদ, সালাতুল হাজত, সালাতুত তাওবা, সূর্য ঢলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চার রাকাত নফল নামায, ইসতিখারার নামায ও সাধারণ নফল নামায। ফরয নামাযের আগে-পরেও সুন্নতে মুআক্কাদা ছাড়া আরো কিছু নফল আছে। যেমন যোহর-পরবর্তী দু’রাকাত সুন্নতের পর অতিরিক্ত দু’রাকাত বা চার রাকাত, আসরের আগে চার বা দুই রাকাত এবং এশার আগে চার বা দুই রাকাত।

ঘ. ইত্তিবায়ে সুন্নতের ইহতিমাম

সব কাজে সুন্নতের খেয়াল রাখা আল্লাহ্র দরবারে আমল কবুল হতে সাহায্য করে। আমলের ওজন বাড়ায় এবং আমলের রূহানিয়াত ও নূরানিয়াত বৃদ্ধি করে। সবচেয়ে বড় বিষয় হল, এটি নবীজীর প্রতি মহব্বতের দাবি এবং তাঁর শাফাআত লাভের মাধ্যম। আর শেষ কথা হল, এটি ঈমান ও আমলের রূহ।

সুন্নত কেবল আমলের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়; সুন্নত তো জীবন পদ্ধতির নাম। মানবজীবনের নববী তরিকার নাম। ব্যস, করণীয় হল, উসওয়ায়ে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও উসওয়ায়ে সাহাবার সহীহ ইলম হাসিল করে সে অনুযায়ী নিজের জীবন গঠন করা।

দুই. আল্লাহমুখী হওয়া, কান্নাকাটি করা এবং খাঁটি তওবা করা

পুরো দুনিয়া একটা বিশেষ অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। এই অবস্থা কারো জন্য আযাব, কারো জন্য পরীক্ষা আবার কারো জন্য মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ। কিন্তু সবার জন্য- চাই সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম, নেককার হোক বা বদকার- সবার জন্য এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য সতর্ক সংকেত।

এই অবস্থা অমুসলিমদের জন্য ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত, পাপাচারীদের জন্য ঈমানী যিন্দেগী গ্রহণের দাওয়াত এবং নেক আমলের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন ঈমানদারদের জন্য তাকওয়ার যিন্দেগী গ্রহণের দাওয়াত।

এই পরিস্থতি আমাদের আমলের ও পুরো জীবনের হিসাব নিতে বাধ্য করছে অথচ আমরা গাফলতের চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে চাচ্ছি।

কুরআনে কারীমে-

لَعَلَّهُمْ یَتَضَرَّعُوْنَ، لَعَلَّهُمْ یَرُجعون.

বলে আমাদেরকে এসব অবস্থায় খালেস তওবা করতঃ আল্লাহ্র দিকে ফিরে আসার আদেশ করে এবং বিনয়-কাতর হয়ে আল্লাহ্র দরবারে দুআয় মগ্ন হওয়ার নির্দেশ করে।

এসময় নামের তওবা নয়, ‘তাওবাতান নাসূহা’ খাঁটি তওবার প্রয়োজন। এজন্য দৈনিক কমপক্ষে একটি সময়, তিলাওয়াত, যিকির বা নফলের পর পর বিনয়-কাতরতার সঙ্গে দুআ করতে থাকা।

অন্তর উপস্থিত রেখে, পরিপূর্ণ লজ্জিত হয়ে প্রথমে সংক্ষেপে তারপর নিজ হালত হিসেবে বিস্তারিতরূপে তওবা করা এবং ভবিষ্যতে নেক আমল ও তাকওয়ার সঙ্গে থাকব- এ মর্মে দৃঢ় সংকল্প করা। কোনো সন্দেহ নেই, গোনাহ থেকে বাঁচাই তাকওয়ার মূল বিষয়। হাদীস শরীফের এই বাণী কার অজানা-

اتّقِ المَحَارِمَ تَكُنْ أَعْبَدَ النّاسِ.

গোনাহ থেকে বাঁচ, তাহলে সবচে বড় আবেদ হতে পারবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩০৫; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৮০৯৫

তালিবে ইলমদের বিশেষভাবে চোখ, কান, মুখ ও হাতের গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। কারণ এগুলো সরাসরি ইলম হাসিলের মাধ্যম। ইলমে নাফে‘র জন্য এগুলো পাক-সাফ রাখা জরুরি। আর কলব যেহেতু ইলম ধারণের পাত্র তাই তার পবিত্রতার বিষয়েও যতœবান হতে হবে। لَا يَمَسُّهُ إِلَّا المُطَهَّرُونَ -এর উমূমের মধ্যে এই সবই অন্তর্ভুক্ত।

এই কাজ সহজ হওয়ার জন্য তলাবায়ে কেরাম হাকীমুল উম্মত রাহ.-এর তিনটি রিসালা মুতালাআ করতে পারেন- জাযাউল আ‘মাল, হায়াতুল মুসলিমীন এবং ফুরূউল ঈমান।

তিন. বাবা-মা’র খেদমত

আসাতেযায়ে কেরাম তো আমাদেরকে এ শের মুখস্থ করিয়ে দিয়েছেন-

خدمت مادر پدر کن صبح وشام

تا تو شوی در دو جہاں نیک کام

এই শেরও-

خدمت مادر پدر کن اختیار

تا تو شوی در دو جہاں بختیار

কিন্তু অধিকাংশ তালিবে ইলম মাদরাসা জীবনে মাদরাসাতেই অবস্থান করেন। ফলে বাবা-মা’র খেদমতের সুযোগ খুব কমই লাভ করেন। এজন্য এই সুযোগকে গনীমত ভেবে যথাসাধ্য তাঁদের খেদমত করা এবং একে নিজের সৌভাগ্য মনে করা।

তালিবে ইলমের জন্য বাবা-মা’র দুআ অনেক বড় পাথেয়। তাঁদের দুআ ও সন্তুষ্টি লাভের প্রচেষ্টা আখেরাতেরও অনেক বড় পাথেয়। আর তলবে ইলমের সফরেও তা অত্যন্ত জরুরি পাথেয়। তাই এটি হাসিলের প্রতি গুরুত্বারোপ করা উচিত।

মান-অভিমান করে, এরচে’ আগে বেড়ে জিদ করে তাদের পেরেশান করা তালিবে ইলমের শান নয়। আর তাঁদের দ্বীনী নসীহতের বিরোধিতা করে এবং নিজেরই অর্জিত ইলমের বিরোধিতা করে তাঁদেরকে কষ্ট দেওয়া- এটা তো কবীরা গুনাহ। এ থেকে বিরত থাকা ফরয।

চার. সকলের প্রতি সদাচার

এত দীর্ঘ সময় পরিবারের সকল সদস্যের সঙ্গে ঘরে অবস্থানের সুযোগ তলাবাদের আসেনি। লম্বা সময় একসাথে

থাকতে হলে পরস্পরের প্রতি খেয়াল বেশি রাখতে হয়। প্রত্যেকের স্বভাব-রুচি ভিন্ন হওয়ায় বিভিন্ন রকম অবস্থা সামনে আসতে থাকে। সঙ্গে যদি আর্থিক সংকট থাকে তাহলে তো পরিস্থিতি আরো পেরেশানির। এসব অবস্থায় পরস্পরের প্রতি সদাচার বজায় রাখা অনেক বেশি জরুরি।

হাদীস শরীফের শিক্ষানুযায়ী আত্মীয়তায় যে যত নিকটবর্তী সদাচারের সে তত বেশি হকদার। এজন্য বাবা-মা’র পর আমার ভাই-বোন আমার সদাচার লাভের অধিক হকদার। এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করলেন-

يَا رَسُولَ اللهِ مَنْ أَحَقّ النّاسِ بِحُسْنِ الصُّحْبَةِ؟ قَالَ: أُمّكَ، ثُمّ أُمّكَ، ثُمّ أُمّكَ، ثُمّ أَبُوكَ، ثُمّ أَدْنَاكَ أَدْنَاكَ.

আল্লাহ্র রাসূল! আমার সদাচার লাভের অধিক হকদার কে? নবীজী উত্তরে বললেন, তোমার মা, এরপর তোমার মা, অতঃপর তোমার মা। তারপর তোমার বাবা। এরপর পর্যায়ক্রমে তোমার নিকটাত্মীয়গণ। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৪৮

তালিবে ইলমের জন্য সদাচারের প্রতি গুরুত্বারোপ এজন্যও জরুরি যে, সে তো ইলমে ওহীর আমলী তরজুমান বা মুখপাত্র। তার আচরণ দেখে মানুষ দ্বীন, ইলমে দ্বীন এবং ইলমে ওহীর মর্যাদা ও প্রভাব বোঝার চেষ্টা করবে।

উত্তম আচরণ শুধু ঘরের লোকদের সঙ্গে নয়; বরং পুরো মহল্লার মানুষজন, নিকট-দূরের প্রতিবেশী, মসজিদের মুসল্লিবৃন্দ এবং সেসকল মানুষ, যারা الصَّاحِبِ بِالْجَنْۢبِ -এর অন্তর্ভুক্ত- কুরআনের নির্দেশনা মোতাবেক এইসকল মানুষ আমার উত্তম আচরণের হকদার। আর এর জন্য দরকার বুদ্ধিমত্তা, সহনশীলতা ও সবর।

উত্তম আচরণের সর্বনিম্নপর্যায়, যা ফরয, সেটা ওই বিষয়, যা নিম্নোক্ত হাদীসসমূহে বর্ণিত :

المُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ المُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ.

মুসলিম সে, যার জিহŸা ও হাতের অনিষ্ট থেকে সকল মুসলিম নিরাপদ থাকে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১০

لَا يَدْخُلُ الْجَنّةَ مَنْ لَا يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَائِقَهُ.

ঐ লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অনাচার থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৬

পাঁচ. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ

হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-

طَهِّرُوا أَفْنِيَتَكُمْ، فَإِنّ الْيَهُودَ لَا تُطَهِّرُ أَفْنِيَتَهَا.

قال الهيثمي في مجمع الزوائد (২৮৬/১) : رَوَاهُ الطّبَرَانِيّ فِي الْأَوْسَطِ، وَرِجَالُهُ رِجَالُ الصّحِيحِ خَلَا شَيْخِ الطّبَرَانِيِّ.

قال الراقم : وشيخ الطبراني وثقه بعضهم وتكلم فيه بعضهم. والإسناد حسن إن شاء الله تعالى، كما قاله غير واحد من المشتغلين بعلم الحديث من المعاصرين. وأصل الحديث في جامع الترمذي، ولكن بإسناد ضعيف جدا.

তোমরা তোমাদের আঙিনা পবিত্র রাখ। কেননা, ইহুদীরা তাদের আঙিনা পবিত্র রাখে না। -আলমু‘জামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৪০৫৭

সম্প্রতি ১৪-১১-১৪৪১ হি. তারিখে এক বুযুর্গের একটি লেখা পেয়েছি।

লেখাটির শিরোনাম-

ظاهری وباطنی صفائی كی اہميت

সেখানে তিনি হাদীসটির তরজমা উল্লেখ করে লেখেন-

ওই সময়ের ইহুদীরা ঘরের আবর্জনা বাইরে নিক্ষেপ করে নিশ্চিন্ত হয়ে যেত। এতে রাস্তায় ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকত এবং প্রতিবেশীদের কষ্ট হত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ থেকে নিষেধ করেন এবং মুসলমানদের আদেশ করেন, তারা যেন ঘরের আঙিনা পরিষ্কার রাখে এবং আবর্জনা এমন স্থানে ফেলে, যাতে নিজেদের বা প্রতিবেশীদের কারো কষ্ট না হয় এবং গলি-মহল্লা দূষিত না হয়।

হযরত মাওলানা মাসীহুল্লাহ খান শেরওয়ানী (জালালাবাদী) রাহ. এই হাদীসের ব্যাখ্যায় একবার বলেন, আমাদেরকে ঘরের আঙিনাও পাক-পবিত্র রাখার আদেশ করা হয়েছে। এ থেকে বুঝে নাও- ঘর পাক-সাফ রাখা কতটা জরুরি। আর ঘর যখন পাক-সাফ রাখা জরুরি তখন নিজের কাপড়-চোপড় ও দেহ পাক-সাফ রাখা কত গুরুত্বপূর্ণ!

এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

الطّهُورُ شَطْرُ الْإِيمَانِ.

পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৩

যদি দেহের পরিচ্ছন্নতার এই হুকুম হয় তাহলে অন্তরের পরিচ্ছন্নতার কী হুকুম হবে? কারণ, অন্তর হল ঈমান এবং আল্লাহ তাআলার মহব্বতের আবাসস্থল। এজন্য অন্তরের পরিচ্ছন্নতার প্রতি সবচে বেশি যতœবান হওয়া উচিত। তবে অন্তরের সঙ্গে দেহ, বস্ত্র, ঘর ও আঙিনাও পবিত্র রাখা জরুরি।

اللّهُمّ اجْعَلْنا مِنَ التّوّابِينَ وَاجْعَلْنا مِنَ الْمُتَطَهِّرِينَ.

-বান্দা মাহমুদ আশরাফ উসমানী গাফারাল্লাহু লাহু

১৪-১১-১৪৪১ হি.

০৬-০৭-২০২০ ঈ.

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-

إِنّكُمْ قَادِمُونَ عَلَى إِخْوَانِكُمْ، فَأَصْلِحُوا رِحَالَكُمْ، وَأَصْلِحُوا لِبَاسَكُمْ، حَتّى تَكُونُوا كَأَنّكُمْ شَامَةٌ فِي النّاسِ.

তোমরা তোমাদের ভাইদের মাঝে উপস্থিত হতে যাচ্ছ। তাই নিজেদের বাহন ও আসবাবপত্র ঠিকঠাক ও পরিপাটি করে নাও এবং সুন্দর ও উত্তম বেশ-ভূষা ধারণ কর; যেন মানুষদের মাঝে তোমাদেরকে তিলকের মত মনে হয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪০৮৯

বোঝা গেল, নিজেদের মাঝে থাকাবস্থায়ও পোষাক-পরিচ্ছদ পরিচ্ছন্ন এবং আসবাবপত্র পরিপাটি রাখা উচিত।

একথাও স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, মিসওয়াকের ইহতিমাম পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মুখ খুললেই দাঁতের দৃশ্য সামনে আসে। দাঁত পরিষ্কার হওয়া এবং মুখ দুর্গন্ধমুক্ত হওয়া এটা শুধু ব্যক্তিগত বিষয় নয়; আপনি যখনই আরেকজনের সংস্রবে থাকবেন সবার মাঝে এর প্রভাব পড়বে। ভাল হলে ভাল, মন্দ হলে মন্দ। আর যখন একা থাকেন তখনো ‘কিরামান কাতিবীন’ তো আপনার সাথেই আছেন।

পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে শেষ আরয এই যে, তলাবাগণ তাদের কাপড় মা’কে ধোয়ার সুযোগ দেবেন না, নিজেই ধুয়ে ফেলবেন এবং মায়ের কাপড়ও ধুয়ে দেবেন। তিনি পরিবারের ছোটদের কাপড় ধুলে তাতেও আপনি তাঁকে সহযোগিতা করবেন।

ঘরের বাসন-কোসন, হাড়ি-পাতিলও নিজেই পরিষ্কার করবেন। ঘরের ভেতরে-বাইরে ঝাড়– দেওয়া এসব আপনি নিজের দায়িত্বে নিয়ে নেবেন।

ছয়. ঘরের কাজে সহযোগিতা

শুধু পরিচ্ছন্নতা নয় বরং অন্যান্য কাজেও শরীক থাকার চেষ্টা করবেন। ছোট ছোট কাজ তো একাই সেরে ফেলবেন। বাইরের কাজে বাবা ও ভাইদের সঙ্গে শরীক থাকবেন আর ভেতরের কাজে মা ও বোনদের সহযোগিতা করবেন। ঘরে কর্মঠ ও উদ্যমী থাকবেন। অলসতাকে কাছে ঘেঁষতে দেবেন না।

সাত. خير الناس أنفعهم للناس

এটি হাদীস শরীফের বাণী। আমাদের এই অবসর ব্যয়ের একটি উত্তম ক্ষেত্র ওইসকল কাজ, যাতে মানুষের উপকার হয়। যেমন মানুষের সাহায্যে যতটুকু সম্ভব শারীরিক শ্রম ব্যয় করা, আর্থিক সাহায্য করা- সেটা যত অল্পই হোক।

মোটকথা, খেদমতে খালকের যত প্রকার সবই এর অন্তর্ভুক্ত।

অনুরূপভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মসজিদের মুসল্লী, প্রতিবেশী ও ঘরের লোকদের কুরআনে কারীম শিক্ষা দেওয়া ও দ্বীনের কথা শোনানো- এগুলো আরো গুরুত্বপূর্ণ।

আট. استغن عما في أيدي الناس يحبك الناس

এটিও হাদীসে নববীর বাণী। তাই তালিবে ইলমের শান এই হওয়া উচিত যে, সে যথাসাধ্য মানুষের উপকার করবে; কিন্তু নিজের মেযাজ এই হবে যে, সে خير الغنى غنى النفس -এর শিক্ষার উপর আমল করবে। ইসতিগনার মাঝে জাযিবিয়্যাত আছে, যা ইলমের ধারক-বাহকদের জন্যে অনেক জরুরি। এই গুণ নিজের মাঝে তৈরি ও বদ্ধমূল করতে তলবে ইলমীর সময় থেকেই এর প্রতি যতœবান হতে হবে এবং সে অনুযায়ী আমল করতে হবে।

নয়. ইলমী মেহনত

স্বাভাবিক অবস্থায় এটি তালিবে ইলমের সবচে বড় ব্যস্ততা। এ পরিস্থিতিতেও জরুরি হল তালিবে ইলম নিজেকে ইলমী মেহনতের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখবেন।

এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম কর্তব্য হল, নিজের আসাতিযায়ে কেরামের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। নিকটে থাকলে অনুমতি নিয়ে কখনো কখনো তাঁর কাছে উপস্থিত হবেন। দূরে থাকলে মুনাসিব সময়ে ঘরের জাওয়াল দিয়ে ফোন করে যোগাযোগ করবেন।

আসাতিযার মাশওয়ারা মোতাবেক ইলমী বিষয়ে মেহনত করার এবং সময় ব্যয় করার অনেক কাজ আছে। যেমন :

ক. হিফযুন নুসূস

এটাও অবসরের সময় ব্যয় করার উত্তম ক্ষেত্র। এ বিষয়ে বান্দা ‘ছোটদের হাদীসের আলো’ কিতাবের ভ‚মিকায় বিস্তারিত লিখেছি। সেটি ‘তালিবানে ইলম : পথ ও পাথেয়’তেও ছাপা হয়েছে। আশা করি বন্ধুগণ সেই মাকালাটি অধ্যয়ন করবেন।

হাফেযদের জন্য হিফয পাকা করা, গাইরে হাফেযদের জন্য ফযীলতের সূরা ও আয়াতসমূহ এবং মাসনূন কেরাতের সূরাগুলো মুখস্থ করা, বিভিন্ন দুআ-যিকির মুখস্থ করা, হাদীস-আসারের কোনো নির্বাচিত সংকলন মুখস্থ করা, মুখতালাফ ফীহ মাসায়েল ও বিরোধপূর্ণ বিষয়াবলির দলীল মুখস্থ করা...। মোটকথা যার পক্ষে যেটা সম্ভব, যতটুকু সম্ভব সেটাতে সময় ব্যয় করা।

খ. ই‘আদা

যা কিছু দরসে পড়েছেন তন্মধ্যে নির্বাচিত কিছু কিতাব বা বিষয় পুনরায় পড়া যেতে পারে। কিংবা পরামর্শ অনুযায়ী পঠিত কিতাবসমূহের কাছাকাছি কোনো মুফীদ কিতাব মুতালাআ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ যারা তরজমাতু মাআনিল কুরআনিল কারীম-এর কোনো অংশ পড়েছেন তারা হযরত মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ দামাত বারাকাতুহুম-এর কিতাব الطريق إلى القرآن الكريم -এর চার খÐই মুতালাআ করতে পারেন।

গ. ই‘দাদ

সামনে যা পড়া হবে তার জন্য প্রস্তুতিমূলক পড়াশোনাও অনেক বিস্তৃত। প্রত্যেক কিতাবের পরিচয়, সেগুলোর ভ‚মিকা-পরিশিষ্ট মুতালাআ, কোনো কোনো সহজ কিতাবের অগ্রিম মুতালাআ, কিংবা পরামর্শ অনুযায়ী এমন কিতাবের মুতালাআ, যার দ্বারা বর্তমান শিক্ষাবর্ষের দরসী কিতাবসমূহ থেকে ইসতিফাদা সহজ হয়ে যাবে। উদাহরণস্বরূপ যারা জালালাইন শরীফ পড়বেন তারা এ সময় হযরত মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ দামাত বারাকাতুহুমের الطريق إلى تفسير القرآن الكريم মুতালাআ করতে পারেন। এই কিতাব অনেক সাবলীল ও সহজ। এর মাধ্যমে ইনশাআল্লাহ কুরআনে কারীমের অর্থ-মর্ম বোঝার মিষ্টতা অনুভব হবে। এরপর জালালাইন পড়ার আনন্দ ইনশাআল্লাহ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আর সে কিতাবের যেসব স্থানে তৃষ্ণা অনুভব হবে তা নিবারণের মাধ্যম যেহেতু আগ থেকেই জানা আছে, সেজন্য বেশি পেরেশানিও হবে না। (যদিও কিতাবের বর্তমান সংস্করণ মূলত প্রস্তুতিমূলক প্রকাশনা এবং মুসান্নিফের বক্তব্য অনুযায়ী এখনো তাতে প্রায় সত্তর ভাগ কাজ বাকি।)

ঘ. ইসতি‘দাদ মজবুত করা

আল্লাহ তাআলা মাফ করুন এবং আমাদের অবস্থার প্রতি রহম করুন। আজকাল তলাবায়ে কেরামের মাঝে ইসতি‘দাদের দুর্বলতার অভিযোগ ব্যাপক হচ্ছে। এর সমাধানের জন্য জানা নেই, তারা কোথায় কোথায় ঘুরতে থাকেন। অথচ তাদের আসল কাজ হল, সব মান-অভিমান ছেড়ে আল্লাহ্র উপর ভরসা করে الطريق إلى العربية (তিন খণ্ড) ও التمرين الكتابي এই দুই কিতাব নিয়ম মোতাবেক আত্মস্থ করা। এরপর الطريق إلى القرآن الكريم -এর খণ্ডসমূহও পড়ে নেওয়া। তাহলে ইনশাআল্লাহ তার মাকসাদ হাসিল হয়ে যাবে।

নিয়ম মোতাবেক এজন্য বলেছি যে, যে কোনো কিতাবের দরস হাসিলের ক্ষেত্রে পাঠদান পদ্ধতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এসব কিতাবের দরসের ক্ষেত্রে পাঠদান পদ্ধতি একদম রূহের পর্যায়ের। এজন্য সম্ভব হলে এসব কিতাব এমন উসতায থেকে পড়া, যিনি মুসান্নিফের তত্ত¡বধানে এসব কিতাবের তাদরীসের তামরীন করেছেন। মাদরাসাতুল মাদীনায় তাদরীসের তামরীনের নেযাম আছে। সেখানকার উসূল মেনে পূর্ণ এক বছর অবস্থান করে সেখানকার নির্দেশিত তারতীবে এই কিতাবের ই‘আদা ও পাঠদান পদ্ধতির আমলী মশক করার সুযোগ রয়েছে।

যাইহোক, যে তালিবে ইলমের এ ধরনের কোনো দুর্বলতা আছে, সে তার আসাতিযার সঙ্গে মশোয়ারা করে এই সুযোগকে ইসতি‘দাদ পাকা করার পেছনে ব্যয় করবেন। ইসতি‘দাদ পাকা করার এক মারহালা হল, ইলমী কিতাবসমূহের অর্থ-মর্ম যথাযথ বোঝা। হেদায়া আখিরাইন, ফতহুল কাদীর, তাফসীরে ইবনে কাসীর, তাফসীরে কুরতুবী, রূহুল মাআনী, ফায়যুল বারী, উমদাতুল কারী, ফাতহুল বারী, মাআরিফুস সুনান এসব কিতাব পড়ে বুঝবে, মুশকিল জায়গাগুলোতে কেন ইশকাল হচ্ছে তা অনুধাবন করবে। কোনো ভুল অর্থ যেহেনে আসলে তা গ্রহণ করবে না; অর্থাৎ ভুল বুঝে ‘ইনশিরাহ’ হয়ে যাওয়ার রোগ না থাকা। ইসতি‘দাদের এই মারহালার মেহনত তো মুখতাসারুল মাআনী-শরহে বেকায়ার জামাত থেকে শুরু হওয়া উচিত। আর এই মারহালার মেহনত তো আগের মারহালার মেহনত ছাড়া সম্ভব নয়।

মোটকথা, উভয় প্রকারের ইসতি‘দাদের জন্য যদি যথাযথ মেহনত হয় তাহলে দিরাসাতে উলইয়ার আসল ফায়দা কিছু না কিছু প্রকাশিত হবে। কমপক্ষে এতটুকু তো হবে যে, দিরাসাতে উলইয়ার দাখেলা ইমতিহানে মুমতাহিনের কিছু আনন্দ লাভের সুযোগ হবে।

ঙ. ইযাফী মুতালাআ

ইযাফী মুতালাআ যতটা গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি তারচে’ অনেক বেশি নাজুক। আলকাউসারের শিক্ষার্থীদের পাতায় একাধিকবার এ বিষয়ে লিখতে চেয়েছি। কিন্তু এখনো হিম্মত হয়নি। আসল কথা হল, ছাত্রদের ইযাফী মুতালাআ নিজের মর্জিমত হলে তা ক্ষতিকর। ইযাফী মুতালাআ উসতাযগণের মশওয়ারা মোতাবেক হওয়া চাই। তাঁদের জানা থাকতে হবে- আমরা কী পড়ছি, কী পড়েছি আর কী পড়িনি।

এখন শুধু এতটুকু বলা যে, ইযাফী মুতালাআও অবসর ব্যয়ের একটি উত্তম ক্ষেত্র। শর্ত হল, সীমার ভেতরে থেকে ‘পাকীযা মুতালাআ’ হতে হবে এবং উসতাযের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে। তবে একটি সাধারণ কথা হল, অনেক মুসান্নিফ এমন, যাদের আকীদা ও ফিকির সহীহ হওয়ার বিষয়টি সর্বসম্মত এবং তাদের কিতাব সহজ ও জরুরিও বটে। এ ধরনের মুসান্নিফদের কিতাব- যে তালিবে ইলমের জন্য যেটা উপযোগী- সেটা মুতালাআ করতে কোনো সমস্যা নেই। যেমন- হাকীমুল উম্মত রাহ.-এর সহজ কিতাবসমূহ, মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ., মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ বানূরী রাহ., মাওলানা মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী রাহ., মাওলানা আবুল হাসান আলী নদবী রাহ., মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানভী রাহ., মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নোমানী রাহ., শায়েখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ. ও মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম প্রমুখের কিতাবসমূহ।

দাওরা সমাপনকারী তালিবে ইলমদের জন্য মৌসুমী মুতালাআ, ইলম তাজা রাখার মুতালাআ, তাকমীলে ইলমের মুতালাআ, নিজের ও মুসলমানদের ঈমান হেফাযতে সহযোগী মুতালাআ, ما لايسع عالما جهله পর্যায়ের বিষয়সমূহের মুতালাআ। এছাড়া আরো কত প্রকারের মুতালাআ আছে সেগুলো তারা ভালো জানেন।

দশ. বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মেহনত

এটাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এখন তো আলহামদু লিল্লাহ এই মেহনত সহজ হয়ে গিয়েছে। কারণ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বুনিয়াদী মেহনতের জন্য আমাদের তলাবাদের অন্যদের মুখাপেক্ষী হওয়ার প্রয়োজন নেই। আলহামদু লিল্লাহ হযরত মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ দামাত বারাকাতুহুমের মেহনতে ‘মিসবাহী সাহিত্য’-এর এত বড় সম্ভার তৈরি হয়ে গেছে যে, এখন কেউ অনুবাদের অনুশীলন করতে চাইলে, প্রবন্ধ লেখার অনুশীলন করতে চাইলে -প্রবন্ধেরও তো বিষয়, পাঠক, শৈলী ও ভঙ্গির বিবেচনায় অনেক প্রকার- যে যে বিষয়ে অনুশীলন করতে চায়, মিসবাহী সাহিত্যে তার অধিকাংশের নমুনা বিদ্যমান। এমনকি এ থেকে উপকৃত হওয়ার পন্থাও উল্লেখিত আছে। শিশু সিরিজ থেকে নিয়ে পুষ্পের বড় বড় দুই ভলিয়ম, তারপর তৃতীয় প্রকাশনার তিনটি বিশেষ সংখ্যা ও কয়েকটি সাধারণ সংখ্যা, কয়েকটি সফরনামা, বিভিন্ন কিতাবের বে-নজির সাহিত্যপূর্ণ অনুবাদ, এসো কলম মেরামত করি, আরো অনেক কিছু মাশাআল্লাহ।

আমরা দারুল কলমের প্রতি শোকরগোযার- এগুলো প্রকাশের জন্য। সাবআ সানাবিলের প্রতি কৃতজ্ঞ- এগুলো বিতরণের জন্য এবং মিসবাহী সাহিত্যের যিনি প্রতিষ্ঠাতা বিশেষভাবে তাঁর শোকরগোযার, যিনি নিজের স্বাস্থ্য কুরবান করে দিন-রাত এক করে এই সম্ভার শুধু এবং শুধু আল্লাহ্র সন্তুষ্টির নিমিত্তে গড়ে তুলেছেন- পরবর্তীদের হক আদায়ের জন্য, যা দীর্ঘকাল যাবৎ পূর্ববর্তীদের যিম্মায় ঋণ ছিল।

আমরা মহান রবের শোকর আদায় করছি, তাঁর হামদ পাঠ করছি, যিনি হযরতকে এই মহান খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার তাওফীক দিয়েছেন। ভাবলে হয়রান হয়ে যেতে হয়- الطريق إلى العربية থেকে الطريق إلى تفسير القرآن الكريم পর্যন্ত নেসাবের এতসব কিতাব রচনার পাশাপাশি মিসবাহী সাহিত্যের এই বিশাল ভাণ্ডার তিনি কীভাবে গড়ে তুললেন! ওইদিকে স্বতন্ত্রভাবে প্রস্তুত করেছেন মকতবের নেসাবের কিতাবগুলো। সেই সঙ্গে মাদানী নেসাবের আসল হাকীকত ও রূহ, যে সম্পর্কে আমরা বাইরের মানুষেরা বেখবর, তার বিশ্লেষণ ও বাস্তব প্রয়োগের সাধ্যমত চেষ্টা, বিভিন্ন দরস, ঘরের-বাইরের ব্যবস্থাপনাগত বিষয়সমূহের তদারকি, আসাতিযা ও নেগরানদের নেগরানি, খেদমতে খালকের বিভিন্ন রকমের কার্যক্রম। এগুলোর প্রত্যেকটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ের দাবি রাখে; অথচ সঙ্গে আছে বিভিন্ন রকমের অসুস্থতা! ভাবতে অবাক লাগে, এত ব্যস্ততা ও সীমাবদ্ধতার মাঝে কয়েক লাজনার কাজ তিনি একা এবং আগাগোড়াই একা কীভাবে আনজাম দেন! আবার কাজগুলোর মধ্যে বেশ কিছু রয়েছে একদম তাজদীদি ও ইনকিলাবি ধরনের। কবি ইবনুর রূমী রাহ. সত্যিই বলেছেন-

لولا عجائبُ صُنعِ اللهِ ما نَبَتَت

تلك الفضائلُ في لحم ولا عَصَب

আমার ধারণা, যদি হযরত ছদর ছাহেব রাহ. এ দৃশ্য দেখতেন, তাঁর চক্ষু শীতল হয়ে যেত। হয়ত বলতেন, আল্লাহ তাআলা আমার স্বপ্ন আমার এক রূহানী সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করেছেন। আর শায়েখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ. যদি এ দৃশ্য দেখতেন তাহলে হয়ত قيمة الزمن عند العلماء ও صفحات من صبر العلماء-এ তাঁর এসব বিষয়ে লিখতেন। এটা আমার অনুভ‚তি। গায়েবের ইলম তো শুধু আল্লাহ্র নিকট।

এসকল অবদানের পিছনে কিছু যাহেরী কারণ আছে আর কিছু বাতেনী। সবচে বড় যাহেরী কারণ হল, সময়ের সঞ্চয় এবং তাবসেরার পরিবর্তে কাজে মনোনিবেশ। আর সবচে বড় বাতেনী কারণ হল, বাবা-মা’র দুআ, বিশেষত মায়ের দুআ, হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর দুআ এবং আসাতিযায়ে কিরাম বিশেষত হযরত পাহাড়পুরী রাহ.-এর দুআ ও তাওয়াজ্জুহ। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বাতেনী কারণ হল, পূর্ববর্তীদের মেহনতের কদর করা, তাঁদের শোকর করা এবং তাঁদের খেদমতের সঙ্গে নিজেকে জুড়ে রাখা।

এসময় এসব বিষয় উল্লেখের উদ্দেশ্য হল, যদি আমাদের প্রিয় তালিবে ইলমরা এখন বাংলা শেখার জন্য কোনো অমুসলিম, মুলহিদ ও বে-দ্বীনের কোনো বই পড়ে তাহলে এর চেয়ে বড় অকৃতজ্ঞতা আর কী!

প্রিয় তালিবানে ইলম! আপনি প্রথমে এই স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন সাহিত্য সম্ভার থেকে উপকৃত হোন এবং ভিত্তি গড়ে তুলুন। এরপর যখন আপনার বয়স হবে, ভাষা ও বিষয় উভয় ক্ষেত্রে ভালো-মন্দ পার্থক্য করার সময় হবে তখন তো আপনার সামনে পুরো দুনিয়া। কিন্তু এখন আপনি নিজের ভিত্তি দুর্বল ও সন্দেহযুক্ত করবেন না- এটা আপনার দায়িত্ব। আর এর জন্য আল্লাহ তাআলা আপনার সামনে প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ফলে আপনার আর কোনো ওজর নেই।

এগার. সব আহŸান কানে তুলবনে না

প্রিয় তালিবানে ইলমের প্রতি আমার শেষ আবেদন হল, আপনারা সব ডাক কানে তুলবেন না। মাদরাসা যখন খোলা থাকে তখনও আর এই অবসরকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে- এই আশঙ্কা তো আরো বেশি- আপনি অনেককে দেখবেন (আল্লাহ না করুন, আমি দুআ করি, আল্লাহ তাআলা আপনাকে এই পরীক্ষা থেকে দূরে রাখুন) তারা আপনার কাছে বিভিন্ন রকমের দাওয়াত নিয়ে আসছে। এমন হলে তা আপনার জন্য অনেক বড় পরীক্ষা। এটা কোনোভাবেই ঠিক নয় যে, আপনি সব আওয়াযেই কান ওঠাবেন এবং সব আহŸানে সাড়া দেবেন।

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এখন এদেশের কোনো কোনো কওমী মাদরাসায় ঈসায়ী, মুলহিদ ও কাদিয়ানীদের দাওয়াতও পৌঁছে গেছে। আর অত্যন্ত আফসোসের কথা, কওমী মাদরাসায় কয়েক জামাত পড়েছে কিংবা দাওরা পর্যন্ত পড়ে ফেলেছে এমন কিছু লোকও এ ধরনের বাতিল দাওয়াতের শিকার হয়ে পড়েছে। আর বিচ্ছিন্ন ও বিচ্যুত দাওয়াত গ্রহণ করে বিপথে চলে গেছে এর নজির তো অনেক।

আমার নিবেদন হল, আপনি সন্দেহের উদ্রেক করে- এমন দাওয়াতও কবুল করবেন না। হতে পারে তার পেছনে কোনো বিচ্ছিন্নতা বা বিচ্যুতি প্রচ্ছন্ন আছে। সন্দেহযুক্ত দাওয়াতের একটা বড় আলামত হল, এর শুরু হবে আপনার আকাবির, মুরব্বীগণ ও আসাতিযার প্রতি অজ্ঞতা, নির্বুদ্ধিতা ও শিথিলতার দোষ আরোপ করে কিংবা কমপক্ষে তাঁদের প্রতি আপনাকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলার চেষ্টা করে।

আপনি প্রথমে ইলমে ‘রুসূখ’ হাসিল করুন। ইলমী বিষয়ে আহলে ইলমের সঙ্গে পরামর্শ ও পর্যালোচনার যোগ্যতা অর্জন করুন। এরপর সেসব দাওয়াতের ভালো-মন্দ যাচাই করুন। এখন যদি আপনি কোনো সন্দেহযুক্ত দাওয়াতের লোকমা বনে যান, তা আপনার জন্য অনেক বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।

কোনো দাওয়াত সন্দেহযুক্ত হওয়ার আরেকটা আলামত হল, তার বাহকেরা এমন মানুষদের মাঝে দাওয়াত প্রচারে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, যারা যাচাই করতে অক্ষম।

এমনও হতে পারে, কেউ আপনাকে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে বলল। আপনি তার থেকে মাফ চেয়ে নিন। তলবে ইলমীর যামানায় রাজনৈতিক কর্মকাÐে (সঠিক, নাকি ভুল- পরের কথা) সম্পৃক্ত হওয়া এবং এ ধরনের কোনো কিছুতে যুক্ত হওয়া আত্মঘাতী। আমাদের সকল আকাবির এ বিষয়ে একমত যে, তলবে ইলমীর যামানায় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া ভুল।

এক্ষেত্রে তলাবায়ে কেরামের প্রতি আমার দরখাস্ত, তারা বরাহে করম বান্দার “তলাবায়ে কেরাম, একটু ভাবুন, ‘আমীরে আম’-এর চেয়ে ‘আমীরে খাস’ অগ্রগণ্য। ‘ইলমী মাশগালাই’-ই তালিবে ইলমের আসল মাশগালা” মাকালাটি পড়বেন। এটি ‘পুষ্প দ্বিতীয় প্রকাশনা সংখ্যা, ১-২০’-এর একদম শেষে (পৃষ্ঠা ৬৯৮-৭০০) ছাপা হয়েছে।

আমার প্রিয় তালিবানে ইলম!

বহুদিন পর আপনাদের মজলিসে হাজির হয়েছি। মজলিস কিছুটা লম্বা হয়ে গেল। কিন্তু মৌলিক কথা কেবল এগারটি। ব্যস, আল্লাহ তাআলা কবুল করুন। এর মধ্যে যা কিছু সহীহ তার ফায়েদা আমাদের সবাইকে দান করুন। আমীন। সূত্র- মাসিক আলকাউসার।

هذا، وصلى الله تعالى وبارك وسلم على سيدنا ومولانا محمد، خاتم النبيين، وعلى آله وصحبه أجمعين، والحمد لله رب العالمين.

سُبْحَانَكَ اللّهُمّ وَبِحَمْدِكَ، أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلهَ إِلّا أَنْتَ، أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ.

-কাউসার লাবীব


সম্পর্কিত খবর