খন্দকার মনসুর আহমদ
লেখক, গবেষক ও হাদিস বিশারদ
লাখো মানুষের হৃদয়ে ভালোবাসার তরঙ্গ তোলা একটি নাম আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী। তাঁর তিরোধোনে আমরা হারিয়েছি জাতির এক পরম মমতাবান মহান অভিভাবকে। তাঁর বিচিত্র কর্মচাঞ্চল্য, হৃদয়ছোঁয়া আখলাক এবং আলোকোজ্জ্বল অবদান ও গুণাবলি তাঁকে চির অমর করে রাখবে।
তিনি ছিলেন একাধারে দেশবরেণ্য আলিমে দীন, শাইখুল হাদীস, প্রাজ্ঞ ইসলামী রাজনীতিবিদ ও আধ্যাত্মিক জগতের শায়খে কামেল। পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব, নানাবিধ দীনি অবদান ও নীতিনিষ্ঠার কারণে দেশের আলেম সমাজ ও ধর্মপ্রাণ মানুষ তাকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসতেন। তাঁর সান্নিধ্যে কেউ অল্প সময়ের জন্য এলেও তাঁর ব্যক্তিত্ব ও উত্তম আখলাকের সম্মোহনে সে বিশেষভাবে সম্মোহিত হতো এবং তাঁর ভালোবাসা অন্তরে নিয়ে ফিরে যেতো। তাঁর শিষ্যত্ব লাভকারী আলেম ও তালিবে ইলমগণতো তাঁর জন্য ছিলো নিবেদিতপ্রাণ। সে কারণে তাঁর অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার পরবর্তী দিনগুলোতে হাজার হাজার আলেম ও তালিবে ইলম দিন-রাত এমনকি তাহাজ্জুদের সময়েও আল্লাহর দরবারে একান্ত রোনাজারিতে মশগুল ছিলেন। কোরআন খতম ও খতমে বুখারিসহ নানাবিধ আমলের মাধ্যমে তারা তাদের প্রিয় হজরতকে ফিরে পাওয়ার জন্য মহান রবের নিকট করুণ মিনতি জানিয়ে আসছিলেন।
তিনি ছিলেন আখলাকে নববীর সাধক। আকাবির আসলাফের আদর্শের নমুনা। দারুল উলুম দেওবন্দের মানস সন্তান। হৃদয় ছিলো সমুদ্রের মত উদার। সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও নীতিপরায়ণতা ছিলো তার চরিত্রের অলঙ্কার। সে কারণে দেশের সচেতন ঈমানদার জনসাধারণও তাঁর প্রতি বিশেষ আস্থা ও ভালোবাসা পোষণ করতেন। মহান আল্লাহ তাকে সাধারণ বিশিষ্ট সবার মাঝেই বেশ গ্রহণযোগ্যতা দান করেছিলেন।
দুই.
এই মহান মনীষী ১৯৪৫ সালের ১০ই জানুয়ারি রোজ শুক্রবার কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ থানার চড্ডা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও মনযোগী ছাত্র। নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করে এবং লেখাপড়ার বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে বাবার আন্তরিক ইচ্ছার ফলে তিনি বিশ্ববিখ্যাত দীনি শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলূম দেওবন্দ গমন করেন। দেওবন্দে ভর্তির সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ায় তিনি সাহারানপুর জেলার একটি মাদরাসায় ভর্তি হয়ে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পড়া সমাপ্ত করে পরের বছর দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হন। মেধা ও অধ্যবসায়ের ফলে তখনই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তিনি তাকমিল শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন এবং সেকালের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা সাইয়েদ ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদীর কাছে বুখারী শরীফ পড়েন। হজরতের স্নেহভাজন হিসাবে তিনি সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেন। তাকমিল শ্রেণি সমাপ্ত করার পর তিনি বিভিন্ন বিষয়ে আরো তিন বছর তাখাস্সুস তথা বিশেষজ্ঞতা অর্জনে ব্যাপৃত থাকেন। তার শিক্ষকগণের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন, মাওলানা সাইয়েদ ফখরুদ্দীন আহমদ মুরাদাবাদী রহ., কারী তাইয়িব রহ., ওয়াহিদুজ্জামান কিরানবী রহ., শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রহ., মুফতী মাহমুদ হাসান গাঙ্গূহী রহ., মাওলানা শরিফুল হাসান, মাওলানা নাসির খান, মাওলানা আব্দুল আহাদ, মাওলানা আঞ্জার শাহ, মাওলানা হোসাইন বিহারী, মাওলানা নাঈম সাহেব, মাওলানা সালিম কাসেমী, মাওলানা সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ.।
তিন.
দীর্ঘ সাতাশ বছরের ছাত্র জীবন পার করে তিনি তাঁর উস্তাদ মাওলানা আব্দুল আহাদের পরামর্শে মুজাফ্ফর নগরে অবস্থিত মুরাদিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। এটি দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতুবী রহ. এর প্রতিষ্ঠিত একটি মাদরাসা। সেখানে এক বছর শিক্ষকতা করার পর তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে শরিয়তপুর জেলার নন্দনসার মুহিউস্সুন্নাহ মাদরাসার শায়খুল হাদীস এবং মুহতামিম পদে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর ১৯৭৮ সালে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ফরিদাবাদ জামিয়ায় যোগদান করে চার বছর অত্যন্ত সুখ্যাতির সাথে শিক্ষকতা করেন। এ সময় তিনি তার ছাত্র গড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্ব ও যোগ্যতার প্রমাণ রাখেন। তারপর ১৯৮২ সালে ঐতিহ্যবাহী জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে মুহাদ্দিস পদে যোগদান করেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিরমিজি শরীফের অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেন। এসময়ে তাঁর পাঠদানের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। মালিবাগ জামিয়ায় ৬ বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৮৮ সাল থেকে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত দুটি জামিয়ার শায়খুল হাদীস ও মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। এর একটি হলো জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা আর অপরটি হলো টঙ্গির ধউর এলাকায় অবস্থিত জামিয়া সুবহানিয়া মাহমুদ নগর। ১৯৮৮ সাল থেকে তিনি বুখারীর দরসদান শুরু করেন এবং ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত সেই দায়িত্বে বহাল থাকেন। বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাঁর নিকট হাদিসের দরস গ্রহণকারী শিষ্যগণ ছড়িয়ে আছেন। সুদান, কাতার, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ড ও থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর শিষ্যগণ বিভিন্ন দীনি খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
চার.
আল্লামা নুর হোসাইন কাসেমী রহ. কৈশোর থেকেই ইলম ও ইবাদতের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি ১৯৭৩ সালে ভারতের মুরাদিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতাকালে শায়খুল হাদিস জাকারিয়া রহ. এর কাছে বায়আত হন এবং বিভিন্ন সময় রমযান মাসে তার সঙ্গে ইতিকাফ করার সৌভাগ্য লাভ করেন। এরপর মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গূহী রহ. এর কাছে বায়আত হন। ১৯৯৫ সালে মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গূহী রহ. বাংলাদেশে আগমন করেন এবং মালিবাগ জামিয়ায় ইতিকাফ করেন। ঐ সালেই তিনি হজরত মাহমুদ হাসান গাঙ্গূহী রহ. এর খেলাফত লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি খানকায়ে মাহমুদিয়ার আমির নিযুক্ত হন।
পাঁচ.
দেশের প্রতিটি সংকটকালে তিনি তার সুচিন্তিত রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও মতামতের মাধ্যমে ইসলামী রাজনীতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার প্রয়াস পান এবং তাতে গতি সঞ্চার করেন। তিনি ১৯৭৫ সাল থেকেই জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯০ সালে জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে চলে আসেন। তারপর তিনি ২০১৫ইং সালে এই দলের মহাসচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত কাদিয়ানী বিরোধী খতমে নবুয়াত আন্দোলনে তিনি জোরালো ভূমিকা পালন করেন। তিনি এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে বর্তমান সময়ের সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও ঢাকা মহানগরীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কিছুকাল পূর্বে আল্লামা আহমদ শফি রহ. এর ইন্তেকালের পর তিনি এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় মহাসচিবের পদে সমাসীন হন। তার সুচিন্তিত রাজনৈতিক মতামত এবং পরিচ্ছন্ন চিন্তা-চেতনা ইসলামী রাজনীতিতে বিশেষ গতি ও সমৃদ্ধি আনয়ন করে।
ছয়.
হজরত আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর মাঝে বহুবিধ গুণ ও যোগ্যতার সমাবেশ ঘটেছিল। বর্তমান সময়ে তার মত ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাঁর একটি বিশেষ গুণ ছিলো ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত। যে কোন কাজের পেছনে তার একমাত্র উদ্দেশ্য থাকতো মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। ব্যক্তি-স্বার্থ বলতে কোন কিছু তার চিন্তায় ছিলো না। সে কারণে আত্ম-প্রচারের কোন মন-মানসিকতাও তাঁর ছিলো না। সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের সকল কর্মেও মানুষ তার এই ইখলাস অনুভব করতে পারতো। তিনি সর্বসত্তায় ছিলেন একজন মুখলিস আল্লাহ সন্ধানী সাধক পুরুষ।
তাঁর জীবনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিলো ত্যাগ ও মুজাহাদা। অত্যন্ত ত্যাগ ও মুজাহাদার জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। একদিকে দরসে বুখারীর মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। অপরদিকে নির্ধারিত আ’মাল, ওযায়েফ ও ইবাদত বন্দেগী ঠিক রেখেছেন আবার সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন দীনি কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য সফর করেছেন। ইসলামী রাজনীতি ও নানা রকম বাতিল ফেরকার বিরুদ্ধেও নানারূপ তৎপরতা চালিয়েছেন। এভাবে অক্লান্ত ত্যাগের সোনালি ইতিহাস রচনা করে তিনি জীবন পার করেছেন।
তাঁর আরও যে গুণটি সমকালীন উলামায়ে কেরামের মাঝে খুব স্বীকৃত তা হলো- তিনি ছিলেন ছাত্র গড়ার কারিগর। সুযোগ্য ও আদর্শ ছাত্র গড়া এবং সুদক্ষ আলেম তৈরির ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। অমনোযোগী ও হতাশাগ্রস্ত ছাত্রদের তিনি আদর ও ভালোবাসা দিয়ে কৌশলে পড়াশোনায় মনোযোগী করে তোলতেন। আর মেধাবীদের বিশেষ উৎসাহ ও নৈকট্য দিয়ে তাদের মেধা-মননকে বিকশিত করার ব্যবস্থা করতেন পরম দক্ষতার সাথে।
তার একজন বিশিষ্ট শিষ্য গবেষক আলেমে দীন মরহুম মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে একশত সতেরজন শিক্ষকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমি।’ আল্লামা কাসেমী বিশেষ যত্ম দিয়ে ছাত্র গড়তেন বিধায় তার গড়া ছাত্রদের পাঠদান-পদ্ধতিও খুব হৃদয়গ্রাহী হয়ে থাকে এবং তারা ছাত্রদের বিশেষ আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হন। সারা দেশে তার গড়া এমন হাজার হাজার আলেম ইলমে দীনের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও সমাজের নানা স্তরে তার হাতে গড়া সুযোগ্য ব্যক্তিরা দীনি খেদমতে অবদান রেখে চলেছেন। তার গড়া ছাত্রদের মাঝে বিশিষ্ট কয়েকজন হলেন- মরহুম মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রহ., মরহুম মাওলানা ইসহাক ফরীদী রহ., আল্লামা হেমায়েতুদ্দীন আহমদ, ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ, মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, মাও. আব্দুল গাফফার, মাওলানা নাজমুল হাসান, মাওলানা মকবুল হোসাইন, মাওলানা ইকবাল হোসাইন, মুফতী মুহিউদ্দীন মাসুম প্রমুখ।
সাত.
আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. কখনও অন্যায়ের সাথে আপোস করেননি। আজীবন তিনি তার নীতি ও হক আদর্শের উপর অবিচল থেকে ঈমান ও তাওহীদি জনতার পক্ষে তার অবস্থান সুদৃঢ় রেখে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। টঙ্গির ধউর এলাকায় তার প্রতিষ্ঠিত জামিয়া সুবহানিয়ার গোরস্তানে তাকে সমাহিত করা হয়। মহান আল্লাহ তাঁকে বেহেশতের উঁচ্চ মাকামে সমাসীন করুন। আমীন।
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া বাইতুস সালাম উত্তরা, ঢাকা।
এমডব্লিউ/