রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


প্রকৃত তালিবে ইলমের গুণাবলী: মুফতি মনসূরুল হক

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কাউসার লাবীব: সাইয়েদুনা হযরত ইবরাহীম খলীল আ. মানবজাতীর কল্যাণার্থে মহান আল্লাহ তা‘আলার দরবারে হযরত ইসমাইল আ. এর বংশে বিশেষ গুণাবলী সম্পন্ন একজন রাসূল প্রেরণের আবেদন জানিয়েছিলেন। কুরআনের ভাষা:

{رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ} [البقرة : ١٢٩]

অর্থ: হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তাদের মধ্যে (হযরত ইসমাইল আ. এর খান্দানে) এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি তাদেরই মধ্য হতে হবেন এবং যিনি (১) তাদের সামনে আপনার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবেন। (২) তাদেরকে কিতাবও (৩) হিকমত শিক্ষা দিবেন এবং (৪) তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন। (সূরা বাকারা-১২৯)

মহান আল্লাহ তা‘আলা হযরত ইবরাহীম আ. এর এই আবেদন কবুল করে সাইয়েদুনা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আখেরী নবী ও সর্বশেষ রাসূল হিসেবে দুনিয়াতে প্রেরণ করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

{لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ} [آل عمران : ١٦٤

অর্থ : আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের প্রতি অতি বড় অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মাঝে তাদেরই মধ্যে হতে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি (১) তাদের সামনে আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করেন (২) তাদের পরিশুদ্ধ করেন এবং (৩) তাদেরকে কিতাব ও (৪) হিকমত শিক্ষা দেন। (সূরা আলে ইমরান-১৬৪)

লক্ষ্য করুন, হযরত ইবরাহীম আ. আল্লাহ তা‘আলার কাছে যে চার গুণ বিশিষ্ট রাসূলের আবেদন করেছিলেন, হুবহু সেই চার গুণ বিশিষ্ট রাসূলেরই সুসংবাদ এই আয়াতে দেয়া হল। তবে এখানে গুণাবলীর ধারাবাহিকতায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। আবেদনের ক্ষেত্রে পরিশুদ্ধ করণের গুণটিকে বলা হয়েছে চার নাম্বারে আর সুসংবাদের ক্ষেত্রে সেটিকে আনা হয়েছে দুই নাম্বারে। আহলে দিল উলামায়ে কেরাম এর দু’টি হিকমত বর্ণনা করেছেন, (১) আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব সঠিকভাবে তুলে ধরতে এটা করা হয়েছে। (২) একথা বুঝানোর জন্য যে, নববী যিম্মাদারীর ধারাক্রম অনুযায়ী এটি চতুর্থ স্থানে হলেও কার্য ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব সবার উপরে। বরং এটি দীনী সকল কাজের দিল এবং পূর্ব শর্ত। এটা ছাড়া দীনের খেদমত অর্থহীন। বরং ক্ষেত্র বিশেষে নিজের জন্য ও দীনের জন্য ক্ষতির কারণও বটে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সকল নবী রাসূলের আ. দীন কায়েমের তরীকা ছিল এক ও অভিন্ন। সেটা হল দীনের জরুরী পাঁচটি বিষয় (ঈমানিয়্যাত, ইবাদাত, মু‘আমালাত, মু‘আশারাত ও তাযকিয়া) বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে উল্লেখিত চার তরীকায় মেহনত করা। মেহনতের এ বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারীমের চার স্থানে বর্ণনা করেছেন। যথা সূরা বাকারা, আয়াত নং ১২৯, সূরা বাকারা, আয়াত নং ১৫১, সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ১৬৪, সূরা জুমু‘আ, আয়াত নং-২।

সুতরাং এখন যারা নাযেবে রাসূল হয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওয়ারিছ হিসেবে দীন কায়েমের মেহনত করতে চায় তাদেরকে জরুরী ভিত্তিতে পাঁচটি বিষয়ে যত্নবান হতে হবে। (১) ঈমান সহীহ ও শিরক মুক্ত হতে হবে। (২) ইবাদতসমূহ নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাত অনুযায়ী করতে হবে। (৩) রিযিক হালাল রাখতে হবে। (৪) সতর্কতার সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে বান্দার হক আদায় করতে হবে। (৫) আত্মশুদ্ধি (অন্তরের দশটি রোগের চিকিৎসা) করে সকল গুনাহ বর্জন করতে হবে এবং দশটি ভাল গুণ অর্জন করতে হবে। (বাকারা-১৭৭)

আর এগুলো আল্লাহর যমিনে বাস্তবায়ন করার জন্য চার লাইনে মেহনত করতে হবে।

এক . يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِঅর্থাৎ তাদের সামনে কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করবে। এর প্রস্তুতির জন্য তিনটি কাজ করতে হবে।

(ক) কুরআন তেলাওয়াত সহীহ শুদ্ধ করতে হবে।

(খ) মু‘আল্লিম ট্রেনিং নিতে হবে, যাতে অল্প সময়ে অন্যকে কুরআন শিখানো যায়।

(গ) দাওয়াত ও তাবলীগে সময় দিয়ে দাওয়াত দেওয়ার তরীকা শিখতে হবে। যাতে দাওয়াতের মাধ্যমে জনসাধারণকে একত্রিত করে কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করে শুনানো যায়।

দুই. – وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ অর্থ: তাদেরকে কিতাব তথা কুরআনের আহকাম শিক্ষা দিবে। এর জন্য তিনটি কাজ করতে হবে।

(ক) মুতালা‘আ (দরস পূর্ব অধ্যয়ন) করতে হবে।

(খ) নিয়মিত দরসে উপস্থিত থেকে উস্তাদ এর কথাগুলি আয়ত্ব করতে হবে।

(গ) তাকরার (পুনঃ পাঠ) করে তা ইয়াদ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

তিন. – وَالْحِكْمَةَ অর্থাৎ হিকমত (নবীজীর সুন্নাত ও আদর্শ) শিক্ষা দিতে হবে। এর জন্যও তিনটি কাজ করতে হবে।

(ক) সকল কাজের সুন্নাত তথা নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তরীকা মুখস্থ করতে হবে। উল্লেখ্য, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তরীকা কথাটি ব্যাপক। এর মধ্যে ফরয, ওয়াজিব, ফিকহী সুন্নাত, মুস্তাহাব সবই দাখিল।

(খ) আমলী মশকের (ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ) মাধ্যমে তা সঠিকভাবে নিজের মধ্যে আমলে আনতে হবে।

(গ) পুরোপুরি আমলে আছে কি না মুরুব্বীদের পক্ষ থেকে তার নেগরানী হতে হবে।

চার. وَيُزَكِّيهِ অর্থাৎ, আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে হবে। এর জন্যও তিনটি কাজ করতে হবে।

(ক) কোন হক্কানী শাইখের সঙ্গে ইসলাহী সম্পর্ক গড়তে হবে।

(খ) শাইখকে নিজের অন্তরের ভাল মন্দ অবস্থা জানিয়ে ব্যবস্থাপনা নিতে হবে।

(গ) সে অনুযায়ী মেহনত মুজাহাদা করে তঁকে অবস্থা জানাতে হবে।

ইনশাআল্লাহ! উপরোল্লেখিত নিয়ম পদ্ধতি অনুযায়ী মেহনত করতে থাকলে নায়েবে রাসূলের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন সহজ হবে, সমাজে দীনী পরিবেশ কায়েম হবে, কুফর-শিরক বিদ‘আত ও আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানী বন্ধ হবে এবং দুনিয়াতে মুসলমানদের ইয্‌যত, শান্তি ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।

সূ্ত্র- দারসে মানসুর


সম্পর্কিত খবর