সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ঘুমের সমস্যা: প্রতিকার ও চিকিৎসা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ডা. মুহাম্মদ রিফাত আল মাজিদ।।

আজকাল ঘুমের সমস্যা সকল বয়সের মানুষের কমন সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বয়স্কদের এ সমস্যা প্রকট। ইদানিং তরুণদের মাঝেও এই সমস্যা চোখে পড়ার মত। লাইফ স্টাইল চেঞ্জ হয়ে যাওয়ার কারনে নতুন নতুন সমস্যা দেখা দিচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন প্রকার চিন্তা,টেনসন, মানসিক অস্থিতিশীলতা দিন দিন মানুষের বেড়েই চলছে।ঘুমা না আসাকে বলে ইনসমনিয়া।

একজন মানুষের যে কোন বয়সে এক সপ্তাহ ধরে যখন ঘুম আসে না বা ঘুম আসার পর সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না সেটা হল অ্যাকিউট ইনসমনিয়া আর যখন প্রায় তিন মাস ধরে এই অবস্থা চলে তখন সেটা ক্রনিক ইনসমনিয়া।

তাই সময় থাকতে সাবধান থাকতে হবে এবং দেখতে হবে অনিদ্রা রোগের কোনও লক্ষণ আপনার মধ্যে দেখা যাচ্ছে কিনা। যদি দেখা যায় তাহলে দেরি না করে অবিলম্বে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করুন। তার আগে দেখে নেওয়া যাক ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা রোগের লক্ষণ (Insomnia Symptoms) গুলো কী কী:

রাত্রে ঘুম আসছে না

হ্যাঁ, আপাত দৃষ্টিতে খুব সহজ মনে হলেও দীর্ঘ সময় ধরে রাতে ঘুম না আসা হল ইনসমনিয়া রোগের প্রথম ধাপ। রাত্রে ঘুম ভেঙে যাওয়া। ইনসমনিয়ার দ্বিতীয় লক্ষণ (Insomnia Symptoms) হল ঘুম এলেও সেটা দীর্ঘস্থায়ী না হওয়া। ধরে নেওয়া যাক, অনেক চেষ্টা করে কষ্ট করে আপনার চোখে ঘুম এল। কিন্তু দেখা গেল যে একটু পরেই সেটা ভেঙে যাচ্ছে। আর একবার ভেঙে গেলে আর ঘুম আসছে না। অনেকের ক্ষেত্রে এটা বারবার হয়। অর্থাৎ তাঁরা যতবার ঘুমনোর চেষ্টা করেন ততবার ঘুম ভেঙে যায়।

ভোর রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া

বেশ কিছুদিন ধরে দেখছেন যে আপনার ঘুম ভোর তিনটে বা চারটের সময় ভেঙে যাচ্ছে। এটা কিন্তু আস্তে আস্তে ইনসমনিয়ায় টার্ন নেবে।

ঘুমনোর পরেও ক্লান্ত অনুভব করা রাতে ভালো ঘুম না হলে সারাদিন ক্লান্তি বোধ অনুভব। অনেকেই মনে করেন যে অনিদ্রা রোগ বা ইনসমনিয়া মানেই হল রাতের পর জেগে থাকা (Symptoms of Insomnia)। বিষয়টি কিন্তু ঠিক তা নয়। অনেক সময় দেখা যায় রাত্রে ঘুমনোর পরেও সকালবেলা আপনার ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে বা বেশ ক্লান্ত লাগছে। ধরে নিতে হবে যে রাত্রে আপনার ঘুম গভীর হয়নি। এটা রোজ হলে বুঝে নিন যে ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত আপনি। সারা দিন ক্লান্তি ও ঘুম-ঘুম ভাবের অনুভূতি। দেখা গেছে যে প্রথম প্রথম যখন ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা রোগের প্রকোপ শুরু হয় তখন একজন ব্যক্তি প্রায় গোটা দিন ভীষণ ক্লান্ত বোধ করেন। তাঁকে দেখে মনে হয় যে তিনি এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বেন। তিনি নিজেও ঘুম-ঘুম ভাব অনুভূত করেন। এর মূল কারণ হচ্ছে তিনি এখন ইনসমনিয়ার প্রথম ধাপে আছেন।

অস্থিরতা, অবসাদ ও অ্যাংজাইটি
রাতের পর রাত যদি আপনার ঘুম না হয় তাহলে মানসিক অস্থিরতা, অবসাদ বা অ্যাংজাইটি দেখা দেওয়া খুবই স্বাভাবিক। তাছাড়া আপনি যদি সত্যিই চিকিৎসকের কাছে গিয়ে জানতে পারেন যে আপনি অ্যাকিউট বা ক্রনিক ইনসমনিয়ার রোগী হয়ে গেছেন, সেটাও মনের উপর খুব চাপ সৃষ্টি করে।

কাজে অমনোযোগী;
৫০% ইনসমনিয়ার রোগী কাজে হঠাৎ করে অমনোযোগী হয়ে ওঠেন। এঁরা এর আগে কেউই কোনও কাজ দেরি করে করা বা পরে করব বলে রেখে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন যে কর্মক্ষেত্রে বা বাড়ির কাজে অমনোযোগী হয়ে উঠলে খতিয়ে দেখতে হবে যে এঁদের রাত্রে ভাল করে ঘুম হচ্ছে কিনা (Symptoms of Insomnia) বা এঁরা আদৌ রাত্রে ঘুমচ্ছেন কিনা।

কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা বা ভুলে যাওয়া
আগের লক্ষণটির সঙ্গে এটি বিশেষভাবে জড়িত। রাতের পর রাত জেগে থাকার কারণে মনের উপর অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি হয়। অনেকেই এই চাপ নিতে পারেন না। যে কাজ এতদিন তাঁরা ফোকাস নিয়ে করে এসেছেন সেই কাজে তাঁরা মন বসাতে পারেন না।

কাজে ভুল করা এবং দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলা
কাজে মনোযোগ চলে যাওয়ার দরুণ এঁদের কাজে অনেক ত্রুটি দেখা দেয়। যে কাজ এতদিন তাঁরা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছেন সেই কাজে প্রচুর ভুল চোখে পড়ে। রাতের পর রাত ঘুম না আসায় এঁদের স্নায়ু খুব অস্থির থাকে (Symptoms of Insomnia)। আর সেইজন্য রাস্তা পার হওয়ার সময় বা ছুরি দিয়ে সব্জি কাটতে গিয়ে এঁরা ছোটখাট দুর্ঘটনার কবলে পড়ে যান।

ঘুম না আসা নিয়ে চিন্তা
যারা বুঝতে পারেন বা যাঁদের চিকিৎসক জানিয়ে দেন যে তাঁদের ইনসমনিয়া হয়েছে তাঁরা ঘুম না আসা নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত চিন্তা করতে থাকেন। এতে লাভের লাভ কিছু হয়না উল্টে ঘুম আসার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে আসে। ইনসমনিয়া শুরু হওয়ার গোড়ার দিকে আরও বেশি করে হয়।

ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা রোগ দূর করার ঘরোয়া উপায় (Home Remedies for Insomnia):

অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া ধরা পড়লে ভয় পেয়ে যাওয়ার কিছু নেই। বেশিরভাগ মানুষেরই শর্ট টার্ম ইনসমনিয়া হয় যেটা পরে সেরেও যায়। তাই ভয় না পেয়ে কয়েকটি সহজ ঘরোয়া উপায় (Natural Treatment of Insomnia) ট্রাই করে দেখতে পারেন। আমাদের জীবনযাত্রার জন্যও অনেক সময় ঘুম না আসার সমস্যা হয়, সেগুলো একটু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও ইনসমনিয়া সেরে যায়।

ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত খাবার খান
ম্যাগনেসিয়াম হল এমন একটি খনিজ যা পেশীকে শিথিল করতে এবং স্ট্রেস কম করতে সাহায্য করে। তাই যে সব খাবারে ম্যাগনেসিয়াম আছে সেগুলো খাওয়া শুরু করুন। ডার্ক চকোলেট, বাদাম, অ্যাভোকাডো এগুলতে ম্যাগনেসিয়াম আছে। রাত্রে এগুলো খেলে ভাল উপকার পাবেন।
ল্যাভেন্ডার অয়েলের ব্যবহার
ল্যাভেন্ডার অয়েল ব্যথা কমায়, ভাল ঘুম নিয়ে আসে ও আপনার মুড উন্নত করে। এটি অ্যান্টি ডিপ্রেশনের ওষুধ হিসেবেও কাজ করে। তাই শোয়ার আগে বালিশে এই অয়েল ছড়িয়ে দিন (অনিদ্রা দূর করার ঘরোয়া উপায়)। একটু আলাদা করে শুঁকে নিন বা এই তেল স্নানের জলে মিশিয়ে স্নান করুন।

মেলাটোনিনযুক্ত খাবার খান
মেলাটোনিন হল এমন একটু বস্তু যা ভাল ঘুম নিয়ে আসতে সাহায্য করে। শুধু ঘুম আসতে নয়, ঘুম যাতে দীর্ঘস্থায়ী আর ঘন হয় সেটাও করে এই মেলাটোনিন। টম্যাটো, বেদানা, শসা, ব্রোকোলি, সর্ষে, আখরোট ইত্যাদিতে মেলাটোনিন থাকে। এগুলো প্রতিদিনের ডায়েটে যোগ করুন (Natural Treatment of Insomnia), দেখবেন ঘুমের সমস্যা অনেকটাই কমে গেছে। সূর্যের আলোতেও কিন্তু মেলাটোনিন থাকে তাই সূর্যের আলোও গায়ে লাগাবেন।

ঘুমের নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিন
বিশেষ কোনও দিন ছাড়া বাকি সময়টা ঘুমের একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিন (অনিদ্রা দূর করার ঘরোয়া উপায়)। শরীরকে সেই সময়ের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে দিন। আজ ন'টার সময়, কাল এগারোটার সময় এভাবে একেক দিন একেক সময়ে শুতে যাবেন না। নির্দিষ্ট সময় ঘুমনোর অভ্যেস করলে ঘুম না আসার সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আসবে।
বেডরুমের চালচিত্র ফেলুন
ঘুমের সঙ্গে কিন্তু মানসিক শান্তির একটা যোগ আছে। যেখানে আপনি ঘুমচ্ছেন, সেই ঘর যদি নোংরা হয় বা অগোছালো হয় তাহলে ঘুম না আসাটা স্বাভাবিক। তাই বেডরুম সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখুন। এতে কিন্তু যথেষ্ট কাজ দেবে।

ইনসমনিয়া দূর করার আরও কিছু কার্যকরী উপায় (10 Tips To Treat Insomnia Naturally) রাত্রে ভালো ঘুমাতে এক গ্লাস গরম দুধ পান করুন।
আমাদের লাইফস্টাইলের সঙ্গে কিন্তু ঘুম না আসার গভীর সম্পর্ক আছে। তাছাড়া গর্ভাবস্থায় অনেক ওষুধ মহিলাদের খেতে হয়। তাই সেই সময় তাঁরা অনেকেই অনিদ্রায় ভোগেন। এমনকী মেনোপজ হওয়ার কিছুদিন আগে এবং পরেও অনিদ্রা হয়। সেইজন্য আপনাদের কিছু গাইডলাইন (Home Remedies Of Insomnia) দিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে আপনারা সেগুলো অনুযায়ী চলতে পারেন।

রাত্রে বেশি চা বা কফি পান করবেন না। ট্যানিন ও ক্যাফিন স্নায়ু উত্তেজিত রাখে। রাত্রে গ্যাজেট থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। ঘুমনোর সময়ের অন্তত এক ঘণ্টা আগে মোবাইল, ল্যাপটপ ও টিভি বন্ধ করে দিন। যারা গর্ভবতী তাঁরা ঘুমোতে যাওয়ার আগে এক গ্লাস গরম দুধ পান করুন। দুপুরে বা দিনের অন্যান্য সময়ে ছোট ছোট ঘুম বা ন্যাপ নেওয়া বন্ধ করুন।

শুতে যাওয়ার আগে এক কাপ ক্যামোমাইল টি পান করুন (Home Remedies Of Insomnia)। ক্যামোমাইল ভাল ঘুম নিয়ে আসে। ঘুমনোর সময় রাত্রে কড়া আলো জ্বালিয়ে রাখবেন না। এতে চোখের কোষ উত্তেজিত থাকে। ঘুমনোর আগে বই পড়া ও সুদিং মিউজিক শোনার অভ্যেস গড়ে তুলুন। বেশি ঝাল মশলা দেওয়ার খাবার খাওয়া বন্ধ করুন (অনিদ্রা দূর করার ঘরোয়া উপায়)। জাঙ্ক খাবার এড়িয়ে চলুন। মদ্যপান ও ধূমপান নিয়ন্ত্রণে রাখুন। এগুলো কিন্তু ঘুম না আসার মূল কারণ। যে সব খাবারে হাই প্রোটিন আছে বা সুগার আছে, সেই জাতীয় খাবার খেলে রাত্রে ঘুম আসতে অসুবিধে হয়। মিষ্টি খাবার, হাই প্রোটিন খাবার রাত্রে না খাওয়াই ভাল।

কলা খেলে ঘুম ভাল হয়।কলায় আছে ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়াম যা পেশীকে শিথিল করে দেয়। তাছাড়া এতে কার্বোহাইড্রেট থাকে যা এমনিতেই মানুষকে আচ্ছন্ন করে দেয়।

খুব কম বা বলা চলে এক লাখে এক জনের এমন হতে পারে। তবে তার আগে অনেকগুলো স্তর আছে। অনিদ্রা হলেই যে মৃত্যু হবে তা নয়। অনিদ্রা হলে ওজন কমে যায়, প্যানিক অ্যাটাক হয়, স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায় তারপর মৃত্যু হতে পারে। হিসেব মতো আমাদের ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। কিন্তু যাঁদের অনিদ্রা রোগ আছে তাঁরা দুই থেকে তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমোন না। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

লেখক: সেন্টার ফর সাইকোট্রমাটোলজি এন্ড রিসার্চ

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ