মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী।।
সমস্ত পৃথিবী সৃষ্টিকারী এবং প্রতিপালনকারী মহান আল্লাহ। খাবার-পরার এবং বাসস্থান হলো মানুষের মৌলিক প্রয়োজন। প্রয়োজন পুরা করার জন্য মানুষ বিভিন্ন উপায়ে অর্থ উপার্জন করে। তন্মধ্যে ব্যবসা হলো সবচেয়ে উত্তম এবং শ্রেষ্ঠ। রিজিক উপার্জনের জন্য নির্দিষ্ট কোনো পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য করেনি ইসলাম। তবে যে পেশাই অবলম্বন করা হোক তা যেন হালাল হয় সেটার ওপরই জোড় দিয়েছে ইসলাম। হালাল রিজিক উপার্জন করাকে ইসলাম ইবাদত হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ফরজ ইবাদতসমূহের (নামাজ, রোজা, জাকাত ইত্যাদি) পরে হালাল উপার্জন করাও একটি ফরজ এবং ইবাদতের গুরুত্ব রাখে।’ অন্য হাদিসে এসেছে, ‘কোনো মানুষ এর চেয়ে উত্তম উপার্জন খায়নি যা সে নিজ হাতে উপার্জন করে খায়। নবী দাউদ (আ.)ও নিজ হাতের উপার্জন খেতেন।’ (সহিহ বোখারি)
রিজিক অনুসন্ধানের উত্তম মাধ্যম ব্যবসা : রিজিক অনুসন্ধানের জন্য হুকুম করেছেন মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সা.)। উপার্জনের গুরুত্ব এবং ফজিলতের দ্বারাই অনুমিত হয় যে, প্রত্যেক নবীই কোনো না কোনো ব্যবসা করতেন। হজরত আদম (আ.) কৃষি কাজ করতেন। হজরত ইদরিস (আ.) সেলাই কাজ করতেন। হজরত দাউদ (আ.) লোহার বর্ম বানাতেন। আমাদের নবীজি (সা.)ও নিজে ব্যবসা করেছেন।
ব্যবসাকে উপার্জনের সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম আখ্যা দেওয়ার বড় কারণ এটাই যে, নবীজি (সা.) স্বয়ং নিজে ব্যবসা করেছেন। তিনি অন্য আরেকজনের সাথে মিলে শেয়ারে ব্যাপক পরিসরে ব্যবসা করেছেন। মোদারাবা তথা ব্যবসার মাল আদান-প্রদান করে লাভ নির্দিষ্ট হারে বণ্টন করে নেওয়া। এ ধরনের ব্যবসাও করেছেন।
নবুওয়াত লাভ করার পূর্বে নবীজি (সা.) মোদারাবার ভিত্তিতে ব্যবসা করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে সায়েব (রা.)-এর সাথে শেয়ারে ব্যবসা করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে সায়েবের (রা.) সঙ্গে ব্যবসা করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সায়েবে (রা.) বলেন, আমি জাহেলিয়াতের যুগে নবীজির ব্যবসার শেয়ার ছিলাম। আমি যখন মদিনায় গেলাম তখন নবীজি (সা.) বললেন, আমাকে চিন? বললাম, কেন চিনব না? আপনি তো আমার অনেক ভালো ব্যবসার পাটনার ছিলেন। না কোনো অঙ্গীকার ভঙ্গ করতেন, না কোনো কিছুতে ঝগড়া করতেন!’ (খাসায়েসে কুবরা, উসদুল গাবাহ)
উপার্জনের অনেক রকম পদ্ধতি আছে। বৈধ পন্থায় রিজিক অনুসন্ধান করাকে উত্তম বলেছেন মহান আল্লাহ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা জুমু‘আ : ১০)।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ফজিলত : সৎ ব্যবসায়ীর শান-মর্যাদা বর্ণনা করে হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সত্যবাদী আমানতদার ও বিশ্বাসী ব্যক্তি কিয়ামতের দিনে নবীগণ সিদ্দিকগণ এবং শহীদদের দলে থাকবেন।’ (তিরমিজি : ১২০৯)। রিজিকের ১০টি অংশ। তন্মধ্যে ৯টি অংশ ব্যবসা-বাণিজ্যে নিহিত। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘পেশাদার মুসলমানকে আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন।
রুটি-রুজির ব্যবস্থা করা মানুষের ওপর ফরজ। মুত্তাকি বান্দাদের নিকট হালাল রিজিক উপার্জন ঈমানের অংশ। জীবন-যাপনে সঙ্কীর্ণতা ইজ্জত-সম্মানের জন্য কলঙ্ক। ব্যবসা-বাণিজ্যে মুসলমানদের অবহেলা অত্যন্ত চিন্তার বিষয়।
হালাল ধনসম্পদ উত্তম জিনিস : নবী কারিম (সা.) হজরত আমর ইবনুল আস (রা.)-কে বলেছেন, আমি চাই তোমার উপযুক্ত ধনসম্পদ অর্জন হোক। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি ধনসম্পদের জন্য মুসলমান হইনি। আমি আমার দিলের টানে মুসলমান হয়েছি। নবীজি (সা.) বললেন, হালাল ধনসম্পদ অনেক উত্তম জিনিস।’ (মুসনাদে আহমদ)
ব্যবসার উদ্দেশ্য ব্যাপক : ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য শুধু মুনাফা অর্জন নয় বরং এর দ্বারা মানুষের সাথে পরিচিতি বাড়বে। তখন তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা। আন্তরিকতা দেখানো এবং হাস্যোজ্জ্বলভাবে কথা বলা উচিত। যাতে অন্যদের অন্তরে আপনার ইজ্জত-সম্মান এবং ভালোবাসাও ঠিক থাকে। তারা আপনার কোনো কথা সহজে মান্য করে। তাহলে ইসলামের সৌন্দর্য অন্যদের কাছে তুলে ধরা সহজ হবে। ঈমানদারীর সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করার মধ্যে আল্লাহপাক অগণিত রিজিক দানের ওয়াদা করেছেন।
ব্যবসা পছন্দ আল্লাহপাকের : হালাল রিজিক উপার্জনের জন্য যে পন্থাই অবলম্বন করা হোক, এটা পছন্দ করেন মহান রাব্বুল আলামিন। যে ব্যক্তি নিজের পরিবার-পরিজনের পেট চালানোর জন্য কষ্ট করে সে যেন আল্লাহর রাস্তায় আছে। আর যে ব্যক্তি নিজের বৃদ্ধ পিতা-মাতার পেট চালানোর জন্য কষ্ট করে এবং মানুষের কাছে যাতে হাত পাততে না হয় সেজন্য হালাল উপার্জন করে সেও আল্লাহর রাস্তায় আছে।’ (তাবরানি; আততারগিব ওয়াত তারহিব)
আখেরাতের জন্যও সম্পদ থাকা জরুরি: আখেরাতের জীবন সুন্দর হওয়ার জন্যও ধনসম্পদ থাকা জরুরি। যাতে আল্লাহর সৃষ্টিজীব এবং নিজের অধীনদের ওপর মন খুলে খরচ করা যায়। বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে সবচে বেশি মানুষ অকর্মণ্য। মুসলমানদের জন্য উচিত ব্যবসা-বাণিজ্যে আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসা। কেননা ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। এতে এগিয়ে আসলে অকর্মণতাও দূর হবে। জীবনেও ফিরে আসবে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য।
ব্যবসা-বাণিজ্যে ধোঁকা-প্রতারণা থেকে বেঁচে থাকা : ব্যবসা, কারিগরি এবং পেশা অবলম্বনের অনেক ফজিলত রয়েছে। কিন্তু এসব ফজিলত ঐ ব্যবসায়ীর জন্য যিনি ইসলামী নীতিমালা এবং নবীজির (সা.) নির্দেশিত পদ্ধতি অনুযায়ী ব্যবসা করবে। ধোঁকাবাজ মুসলমান হতে পারে না। ধোঁকা দেওয়া, মিথ্যা বলা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। প্রকৃতপক্ষে ধোঁকাদাতা খোদ নিজেকেই ধোঁকা দেয়। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ধোঁকা দেয় ও প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (সহিহ বোখারি ও সহিহ মুসলিম)। সবচে বড় কথা হলো, এতে আল্লাহর রহমত এবং বরকত হয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘হালাল যদিও কম হয়, কিন্তু এতে বরকত আছে।’
পণ্য বিক্রি করার জন্য মিথ্যা না বলা: সুরা আলে ইমরানের ৬১ নং আয়াতে বলা হয়েছে, মিথ্যার ওপর অভিশাপ দিয়েছেন মহান আল্লাহ। নবীজি (সা.) বলেছেন, ব্যবসায়ী গোনাহগার এবং অসভ্য। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! ব্যবসা-বাণিজ্যকে কি আল্লাহ হালাল করেননি? নবীজি (সা.) উত্তরে বললেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ণ বৈধ। কিন্তু অধিকাংশ ব্যবসায়ী মিথ্যা কসম করে। নিজের পণ্যের ব্যাপারে মিথ্যা মিথ্যা বিবরণ দেয়। এভাবে অধিকাংশ মানুষ গুনাহগার হয়ে যায়। আল্লাহর পানাহ! আল্লাহর পানাহ! (মুসনাদে আহমদ)। আজকাল মুসলমান ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক পিছিয়ে। যারাও বা ব্যবসা করছেন তারাও ইসলামের নির্দেশনা এবং নবীজির (সা.) আদর্শের মূলনীতি জানেন পর্যন্ত না। জানলেও আমলে নেন না। মুসলমানদের উচিত নবীজির (সা.) ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত নির্দেশনা অধ্যয়ন করা। ইসলামের নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলা। তাহলে ইনশাআল্লাহ সফলতা আমাদের পদচুম্বন করবে।
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ
-এটি