মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী।।
মেহমানদারি ইসলামের অন্যতম একটি বিধান। সকল নবীদের আদর্শ। এই গুণটির কারণে আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তৎকালীন সময়ে কাফের-মুশরিকদের কাছেও সমাদৃত ছিলেন। ইসলামে মেহমানদারিকে উত্তম গুণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নবীজি (সা.) মেহমানের সম্মান করতে তাকিদ দিয়েছেন। মেহমানকে সম্মান করা একজন মুসলমানের ঈমানি কর্তব্য। নবীজি (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ ও পরকালের প্রতি যে ঈমান রাখে সে যেন মেহমানের সমাদর করে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬১৩৬) অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘যে মেহমানদারি করে না তার মাঝে কোনো কল্যাণ নেই।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৭৪১৯) আরেক হাদিসে নবী করিম (সা.) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-কে লক্ষ্য করে বলেন, ... নিশ্চয়ই তোমার ওপর তোমার মেহমানের হক রয়েছে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬১৩৪)
হজরত আলী (রা.) বলেন, ‘ভাইদের ভালো খাবারে দাওয়াত দেওয়া আমার কাছে একটি কৃতদাস মুক্ত করার চেয়ে বেশি পছন্দনীয়।’ সাহাবায়ে কেরাম বলতেন, খাবারের দাওয়াত দেওয়া উত্তম চরিত্রের অংশ। সাহাবা, তাবেয়িন, তাবে তাবেয়িনসহ বড় বড় মনীষীদের মেহমানদারির এমন এমন আশ্চর্যজনক ঘটনা পাওয়া যায় যেগুলো পড়লে শরীরের লোমকূপ দাড়িঁয়ে যায়।
নবী হজরত ইবরাহিম (আ.)ও মেহমানদারির খুব গুরুত্ব দিতেন। হজরত আতিয়্যা আওফি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিম (আ.)-কে এ কারণে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন যে, তিনি মানুষকে খানা খাওয়াতেন, বেশি বেশি সালাম দিতেন আর মানুষ রাতে ঘুমিয়ে পড়লে তিনি নামাজ আদায় করতেন। (তাম্বিহুল গাফিলিন)
নবীজি (সা.)-এর কাছে মেহমান আসলে তিনি খুব আপ্যায়ন করতেন। খানা খাওয়ানোর সময় বারবার বলতেন, আরও খান, আরও খান। মেহমান খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে না করতে থাকলেও তিনি পীড়াপীড়ি করতেন। তিনি ছিলেন অতিথিপরায়ণতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অনেক সময় মেহমানদারি করতে গিয়ে তাকে এবং তার পরিবারকে অনাহারে থাকতে হতো। একবার বনু গিফার গোত্রের এক লোক রাসুল (সা.)-এর মেহমান হলেন। মহানবী (সা.) আগের দিন অভুক্ত ছিলেন। যেদিন মেহমান এলেন, সেদিন ঘরে ছাগলের দুধ ছাড়া আর কিছু ছিল না। নিজে অনাহারি হয়েও আমাদের রাসুল (সা.) সেই মেহমানকে ছাগলের দুধটুকু খাওয়ালেন। কিন্তু অতিথিকেও বুঝতে দিলেন না যে, তিনি ক্ষুধার্ত।
মেহমান আসলে খুশি হওয়া উচিত। অন্তরে সঙ্কির্ণতা না রাখা উচিত। মেহমান আল্লাহর রহমত ও বরকত নিয়ে আসে। আল্লাহ যাকে মেহমান হিসেবে পাঠান তার রিজিকও পাঠিয়ে দেন। তাদের ভাগ্যে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির আগেই এই রিজিক লিখে রেখেছেন। হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘যে ঘরে মেহমানের আগমন নেই; সে ঘরে ফেরেশতা আসে না।’
মেহমানদারি এমন গুণ যা মানুষের দোষ-ত্রæটির ওপর পর্দা ফেলে দেয়। মেজবান মেহমানের অন্তরে জায়গা করে নেয়। সব সময় সেই মেজবানের প্রশংসা করে। যখনই তার আলোচনা করা হয় তখন তার প্রশংসা ব্যতীত কথা শেষ হয় না।
মেহমানদারির ফজিলত : পবিত্র কোরআনে মেহমানদারি সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা নিজের ওপর অন্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। যদিও বা নিজেরা ক্ষুধার্ত থাকে। আর যারা স্বভাবজাত লোভ-লালসা এবং কামনা থেকে মুক্তি লাভ করে, তারাই সফলকাম।’ (সুরা হাশর : ৯) নবীজি (সা.) বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত খাবারের দস্তরখান মেহমানের সামনে বিছানো থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত ফেরেশতারা মেজবানের জন্য রহমতের দোয়া করতে থাকেন।’(আল মুজামুল আওসাত)
মেহমানদারির উদ্দেশ্য শুধু পেট ভরে খাওয়ানো নয়; বরং পরষ্পর মানবিকতা, হৃদ্যতা ও ভালোবাসা সৃষ্টি করা উদ্দেশ্য। মেহমানদারির দ্বিতীয় আরেকটি উপকারিতা ইসলামী সভ্যতা শেখার সুবর্ণ সুযোগ। কারণ এতে মেজবান ও মেহমান উভয়জনের সাথে সম্পৃক্ত বিষয় বিদ্যমান। মেহমানদারির শিষ্টাচারের প্রতি যতœবান হলে মেহমানদারিটা মেজবানের ওপর ভারি কিংবা কষ্টকর মনে হবে না। সুরা আহজাবেও এ ধরনের কিছু শিষ্টাচার শেখানো হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! নবীর ঘরে (অনুমতি ছাড়া) প্রবেশ কর না। অবশ্য তোমাদেরকে আহার্যের জন্য আসার অনুমতি দেওয়া হলে ভিন্ন কথা। তখন এভাবে আসবে যে, তোমরা তা প্রস্তুত হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকবে না। কিন্তু যখন তোমাদেরকে দাওয়াত করা হয় তখন যাবে। তারপর যখন তোমাদের খাওয়া হয়ে যাবে তখন আপন-আপন পথ ধরবে; কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়বে না।’ (সুরা আহজাব : ৫৩)
কয় দিন মেহমানদারি করতে হবে : এ ব্যাপারে নবীজি (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ ও পরকালের প্রতি যে ঈমান রাখে সে যেন মেহমানের সমাদর করে এবং তার হক আদায় করে। নবী (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, মেহমানের হক কী? তিনি বললেন, এক দিন এক রাত, সর্বোচ্চ মেহমানদারি তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত, এর অতিরিক্ত হলো সদকা।’ (বুখারি) মুসলিম শরিফের একটি বর্ণনায় এসেছে, ‘কোনো মুসলমানের জন্য বৈধ হবে না যে, সে তার ভাইয়ের কাছে এত বেশি অবস্থান করা যে, তাকে গুনাহগার বানিয়ে ফেলে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! তাকে গুনাহগার কিভাবে বানিয়ে ফেলে। নবীজি (সা.) বলেন, তার নিকট অবস্থান করতে থাকল আর তার কাছে কিছুই থাকল না যা দ্বারা তাদের মেহমানদারি করবে।’ এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, মেহমানের হক তিনটি। ১. এক দিন এক রাত মেহমানদারি করা ওয়াজিব। ২. দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন মুস্তাহাব।
৩. তৃতীয় দিনের পর মেহমানদারি করা সদকা বা অনুগ্রহ। আল মুগনিল লাবিব গ্রন্থে আছে যে, এ হকগুলো মুসাফির এবং দূর-দূরান্ত থেকে আগত মেহমানের জন্য প্রযোজ্য। নিজের এলাকার মেহমানের মেহমানদারি করা মেজবানের ইচ্ছাধীন। চাইলে তার জন্য মেহমানদারির ব্যবস্থা করা যেতে পারে, আবার চাইলে মেহমানদারি না করারও সুযোগ আছে।
খাবারের সময়কে লক্ষ করে কোনো বন্ধু কিংবা কারও বাসা-বাড়িতে যাওয়া অভদ্রতা। কারও ঘরে খাবারের সময় পর্যন্ত বসে থাকাও অভদ্রতা। এতে করে ঘরের মালিককে পেরেশান হতে হয়। মেহমানের উপস্থিতিতে তাদের খাওয়া-দাওয়ার পরিবেশ থাকে না। আবার সবার পক্ষে যতজন লোকই বাসায় আসুক তাদেরকে আপ্যায়ন করার সামর্থও থাকে না। আল্লাহ তায়ালা এ ধরনের অনর্থক অভ্যাস থেকে নিষেধ করেছেন।
দাওয়াত ছাড়া মেহমান না হওয়া: হজরত আবু মাসউদ বাদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে খাবারের দাওয়াত দিল। নবীজি (সা.)সহ সেখানে পাঁচজন লোক ছিল। যখন তারা রওয়ানা হলেন তখন আরও একজন লোক তাদের পিছু হলো। রাসুল (সা.) মেজবানের দরজায় গিয়েই তাকে বললেন, এই ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে চলে এসেছে। তুমি চাইলে তাকে অনুমতি দিতে পার, চাইলে সে চলে যেতে পারে। মেজবান বলল, না, আমি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারি না হে আল্লাহর রাসুল! বরং আমি তাকে অনুমতি দিচ্ছি।’ (বুখারি ও মুসলিম) আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে মেহমানের সম্মান করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ।
-এটি