বিশেষ প্রতিবেদক: শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. এর ইন্তেকালে শূন্য হয়েছে কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি পদটি। এছাড়া বর্তমান মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস পদত্যাগ করবেন বলে জানিয়েছেন। তার আরেকটি পদ সিনিয়র সহ-সভাপতি ধরে রাখবেন কি না তা এখনো নিশ্চিত নয়। এই পদটিও ছেড়ে দিলে একসঙ্গে জাতীয় প্রতিষ্ঠান বেফাকের তিনটি শীর্ষ পদ শূন্য হচ্ছে। আগামী শনিবারের মজলিসে আমেলার বৈঠকে পূরণ করা হবে পদগুলো।
ইতোমধ্যে মজলিসে আমেলার মিটিংকে ঘিরে শুরু হয়েছে নানা তৎপরতা। জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পদে কারা আসছেন সেটা নিয়ে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। ভেতরে ভেতরে বিভিন্ন ব্যক্তি ও বলয়ের তৎপরতাও চলছে পদগুলো ঘিরে।
বেফাকের আগামী নেতৃত্ব কারা দেবেন সেটা জানতে অপেক্ষা করতে হবে শনিবার পর্যন্ত। তবে দায়িত্বে যারাই আসুক নতুন নেতৃত্বকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। বেফাকের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা, প্রতিষ্ঠানটির প্রতি ছাত্র সমাজ, আলেম সমাজ ও সাধারণ মানুষের আস্থা ধরে রাখা, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করা এসব বিষয় তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
গত কয়েক বছর ধরেই বেফাকের অভ্যন্তরে অস্থিরতা চলছে। কয়েক মাস আগে কিছু ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর বেফাকে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়টি সবার সামনে চলে আসে। অনেকে প্রকাশ্যে মুখ খুলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় বেফাক নেতৃত্বকে। প্রধান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা আবু ইউসুফসহ তিনজনকে বহিষ্কার করা হয়।
তবে এতেও থামেনি সমালোচনা। মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুসের পদত্যাগের দাবি জোরালো হতে থাকে বিভিন্ন মহল থেকে। শেষ পর্যন্ত হাটহাজারীতে অনুষ্ঠিত বেফাকের খাস কমিটির বৈঠকে এসব বিষয় তদন্তে একটি কমিটি করা হয়। তবে এই কমিটির বিষয়টি অন্ধকারে তলিয়ে যায়। এর কোনো ফলাফল দৃশ্যমান হয়নি। এর মধ্যেই সভাপতির ইন্তেকালে নতুন হিসাব-নিকাশ সামনে আসে বেফাকের।
বেফাকের পরীক্ষাসংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে অনেক দিন ধরেই। গত বছর মিশকাত জামাতের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। এছাড়া পরীক্ষা প্রক্রিয়ায় জড়িত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীলরা অসততার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের সন্তান ও স্বজনরা যখন তাক লাগানো ফলাফল করেন তখন অভিযোগ আরও জোরালোভাবে সামনে আসে। পরীক্ষা ছাড়াও প্রকাশনা বিভাগসহ বেফাকের বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
নতুন যারা নেতৃত্ব আসবেন তাদেরকে প্রথমেই এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। জাতীয়ভাবে আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক এই প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। তাদের জন্য এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। এই চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হতে না পারলে নতুন নেতৃত্বও প্রশ্নের মুখে পড়বে।
বেফাকের আমেলার সদস্য ১৫৭ জন। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন ইন্তেকাল করেছেন। সব মিলিয়ে শতাধিক সদস্য ৩ অক্টোবরের বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারাই মূলত বেফাকের অন্তর্বর্তীকালীন নতুন নেতৃত্ব বাছাই করবেন। আগামী কাউন্সিল পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন নতুন দায়িত্বশীলেরা।
পাকিস্তান আমলেই বেফাক প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আলোচনায় আসে। মুজাহিদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ., মাওলানা আতহার আলী রহ.সহ তৎকালীন শীর্ষ আলেমরা এ ধরনের একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। যদিও নানা কারণে তখন তা বাস্তবায়ন হয়নি। অবশেষে ১৯৭৮ সালে তৎকালীন বিশিষ্ট আলেমদের তত্ত্বাবধানে বেফাক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শুরু থেকে দেশের মূলধারার শীর্ষ আলেমদের নেতৃত্ব পেয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।
দেশের সিংহভাগ কওমি মাদরাসা এই বোর্ডের অধীনে। ২০১৭ সালে গঠিত সম্মিলিত বোর্ড আল-হাইয়্যাতুল উলয়ায় মূল নেতৃত্ব দিয়ে থাকে বেফাক। পদাধিকার বলে বেফাকের যিনি সভাপতি হবেন তিনি হাইয়্যার চেয়ারম্যান এবং বেফাকের যিনি সিনিয়র সহসভাপতি হবেন তিনি হাইয়্যার কো-চেয়ারম্যান হবেন। এজন্য বেফাকের নতুন নেতৃত্ব বাছাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে হাইয়াতুল উলয়ারও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নির্ধারণ হবে। ফলে আগামী শনিবারের মজলিসে আমেলার বৈঠকটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে এবং পুরো দেশের আলেম-উলামার দৃষ্টি সেদিকে।
এমডিব্লউ/