মুহাম্মদ বিন ওয়াহিদ ।।
এবার করোনা পরিস্থিতির কারণে চলমান লকডাউনে মানুষ খুন বেশি হচ্ছে। ঠুনকো অজুহাতে একে অন্যের গায়ে ধারালো দাঁ-ছুরি তুলছে। এগুলোর পেছনে প্রকাশ্য যতোগুলো কারণ আছে, তার চেয়ে বেশি আছে অপ্রকাশ্য। ফলতঃ দিন যতো যাচ্ছে মানুষ ততোই হিংস্র হচ্ছে। শুধু পত্রপত্রিকায়ই নয়, নিজের আশপাশেও এমন বিভৎস ঘটনাগুলো দেখে শিউরে উঠছি বারবার।
বাপ ছেলেকে, ছেলে বাপকে, চাচা ভাতিজাকে, ভাতিজা চাচাকে, এমনকি মহিলারাও পিছিয়ে নেই এক্ষেত্রে। মানুষ যেন দিনদিন ভয়ংকর রক্ত পিপাসু হয়ে উঠছে। যেন তার খাবার নয়, চাই মনুষ্য রক্ত! তার ক্ষুধার্ত পেট শান্ত করার জন্য চাই জীবন্ত মানুষের ক্ষতবিক্ষত দেহ। কে জানে, হয়তো বৈশ্বিক মহামারি করোনা এভাবেই পৃথিবীকে বদলে দিবে!
করোনারমত ভয়ংকর একটি মারণ থাবার আবশ্যিক যে একটি দাবি ছিল নিজেদের বদলে ফেলার, তা হচ্ছে না। অবশ্য নিজেদেরকে মানুষ ঠিকই বদলাচ্ছে, কিন্তু ভালো মানুষে না; নিজের মনুষ্যত্বের জায়গায় পাকাপাকিভাবে গেঁথে নিচ্ছে হিংস্রতা ও পশুত্ব। সামাজিক দূরত্বের বুলি আমাদের অবচেতন মনে ভুলিয়ে দিচ্ছে আত্মীয়তার গভীর বন্ধনকেও। এটাই চির সত্য ও বাস্তবতা।
আজকে ফেসবুকে একজন চিকিৎসকের আহাজারি শুনলাম। তার প্রতি খুব দুঃখ হল। তিনি নিজেকে জনমানুষের একজন সেবক রূপে গড়ে তোলায় আক্ষেপ করছেন। তিনি বলছেন, আমি একজন ডাক্তার; কিন্তু আজ নিজেকে ডাক্তার ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে। নিজেকে একজন পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে।
আমি নিজের পরিবারের সুস্থতার কথা চিন্তা না করে, নিজের স্ত্রী, সন্তান ও বাবা-মায়ের কথা না ভেবে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ঝাপিয়ে পড়লাম, নিজের জীবনকে বাজি রাখলাম, আর আজ আমার মধ্যে করোনার কেবল উপসর্গ দেখা দেওয়ায় জঙ্গলে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে আমাকে।
যেই হাসপাতালে আমার জীবন সঁপে দিলাম,সেখানে আমার জায়গা হয়নি। আমি যেই বাসায় ভাড়া থাকতাম, সেখান থেকে আমাকে পরিবার সুদ্ধ তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যেই গ্রামে আমার বাড়ি, সেখানেও আমাকে উঠতে দেওয়া হয়নি। আমার জীবন কাদের জন্য আমি উৎসর্গ করেছিলাম? কাদের সুস্থতার কথা আমি আমার পরিবারের চেয়ে বেশি চিন্তা করেছিলাম? এভাবেই আক্ষেপ করছিলেন সেই ডাক্তার।
শুধু কি তাই, করোনা আমাদের মায়ের সম্পর্ককেও ভুলিয়ে দিয়েছে। করোনা আক্রান্ত সন্দেহে কতো মাকে জঙ্গলে ফেলে এসেছে হতো ভাগা ছেলে, তার হিসাব কিন্তু সংবাদকর্মীদের কাছেও নেই!
করোনা পরিস্থিতির কারণে চলমান লকডাউনে হাজার হাজার মানুষ চাকরি হারা হয়েছে। যারা দিনমজুর, তাদের জীবিকা নির্বাহ বন্ধ হয়েগেছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হল। সময়মত তা আমাদের "জনপ্রতিনিধি" দের কাছেও হস্তান্তর করা হল, কিন্তু করোনা গোটা পৃথিবীকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হলেও এই তথাকথিত "জনপ্রতিনিধি"দের প্রভাবিত করতে পারেনি। তারা নিজেদেরকে রক্ষক না ভেবে ভক্ষক ভাবতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
এই গরীব-অসহায়দের জায়গায় নিজেকে একবার ভেবে দেখেছেন? তারা সবাই কিন্তু রিকশাচালক, দিনমজুর বা ভিক্ষুক নয়, তাদের একটি সম্মানজনক পরিচয় আছে। তারা নিজের পরিবারের কাছে একজন স্বামী, একজন বাবা, একজন বড় ভাই! দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে না পেরে নিজের পরিবারের কাছে সে কতোটা অসহায় হচ্ছে ভাবতে পারেন?
এই অনুভূতি আমাদের হর্তাকর্তাদের স্পর্শ করবে না। এখন তো আরও নয়। আমরা সবাই-ই কিন্তু যার যার জায়গা থেকে ভীষণভাবে বদলে যাচ্ছি!
এটা মোটেও কাম্য নয়। করোনা আমাদের বৈষম্যের শিক্ষা দিতে আসে নাই। একটু মানবিক ও সামাজিক হওয়ার শিক্ষা দিতে এসেছে।
মনে রাখা দরকার, করোনা থেকে আপনি একা যদি বাঁচতে চান, কিছুতেই বাঁচতে পারবেন না। আর যদি ভাবেন, আমি সবাইকে নিয়ে বাঁচবো, তাহলেই সম্ভব করোনাত্তোর একটি সুস্থ, সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলা!
নয়তো অন্য আর দশজনেরমত অতি নিকৃষ্ট, নিগৃহীত অবস্থায় আপনারও মৃত্যু হতে বাধ্য।
-এটি