উবায়দুল্লাহ তাসনিম।।
চোখে দেখা যায় না,ছোঁয়া যায় না, অনুবীক্ষণ যন্ত্রেও ঝাপসা লাগে এ ছোট্ট ভাইরাসটি পৃথিবীকে থমকে দিচ্ছে। চলৎশক্তিহীন মানুষ। নিস্তরঙ্গ জীবন!
জনজীবনে নেই কোলাহল আর ব্যস্ততা। সবাই নির্জীবের মতো। ঘরবন্দি জীবন-যাপন করছে মানুষ।
করোনার সামনে মানুষ আজ অসহায়। বিজ্ঞান তার চিরাচরিত নিয়মে অসহায়ত্বের চৌহদ্দিতে আটকে আছে। করুণ চোখে তাকিয়ে খুঁজছে সমাধানের পথ। কিন্তু না, পারছে না। তার খোঁড়াপনা দেখে প্রকৃতির সে কী বিদ্রুপের হাসি!
স্বার্থের কুঠুরীতে আবদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী মুরব্বীরা হতাশ। সমাধানের নেই কোন পথ। মানুষ মেরে সম্পদ চুষে খাবার সেই যে রাক্ষুসেপনা, এতে শান্ত পৃথিবীর মাটি থরথর কাঁপত। আজ তাদের নির্জীব ঘুমে মাজলুমানের আত্মার খুশিতে ব্যাঙ্গাত্মক খিলখিল হাসি!
ক্লান্ত দুপুরে ইট-ক্রংকিটের বিষণ্ণ শহরে বেরিয়েছিলাম। থমকে গেছে জনজীবন। হই-হুল্লোর আর প্রাণবন্ত শহরের সজীবতা নেই। মৃত্যুপুরীর কাছাকাছি। ঝিম দুপুরে চঞ্চলময় শহরটা ঘুমুচ্ছে যেনো।
কামাল চাচার ফুলের দোকান বন্ধ। দু'একটা প্রাণহীন শুকনো ফুল দুলছে পাশটায়।অনেক দিন ধরে বিক্রি হতে না পারায় সজীব ফুলটা আজ আত্মহুতি দিয়েছে। ফুলের গগণবিদারী অার্তনাদ শুনে আমারও কান্না আসে। সহমর্মিতা রক্ষার তাগিদে আমি নববধূর মতো মুখ গুঁজে এখটুখানি কেঁদে নেই। তবুও যদি ব্যাথার সামান্য উপশম হয়!
পথের ধারে শুকনো কতোগুলো ডাস্টবিন। কতোদিন হলো, উচ্ছিষ্ট খাবার বহন করছে না তারা। খাবারের উদ্দেশ্যে হন্য হয়ে ছুটে আসা কত্তোগুলো কুকুর খাবার কুঁড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টায়, প্রচন্ড খিদে পুড়ে করুণ জিহব্বা বের করে হাঁপিয়ে যাচ্ছে।
রাস্তার অদূরে সারি সারি একগুচ্ছ গাছ। সাধু-সন্নাসীর ভাব নিয়ে সবাই একমনে দাঁড়িয়ে। রিক্ত শাখায় নতুন কিশলয়ের উঁকিঝুকি। ডালের কোন কোনটা কচকচে সবুজ পাতায় ছেয়ে গেছে। বুঝা যাচ্ছে, সবাই ওরা অক্সিজেন নির্মানে ব্যস্ত। অথচ, অথচ মানুষগুলো!
অক্সিজেনে বেঁচে থাকার মানুষগুলো গাছগুলোর অবারিত, অকৃপন পরিবেশিত অক্সিজেনের উপঢৌকন কি নিচ্ছে?
ওসব মানুষ তো আজ মৃত্যুর নীল থাবার ভয়ে গৃহবন্দি যাপন করছে! করোনার ভয়ে কুঁকড়ে থাকছে একেকজন। এই বুঝি, করোনা আক্রমণ করে বসে!
নীলাভ আকাশের নীলে ছেয়ে যাওয়া বিষাদে যেনো নীল রঙ খানিকটা ধূসর বর্ণ পড়েছে। তবে অসীম নীলাভ আকাশটাও কি অসহায় মানবজাতির সহমর্মী হয়ে যন্ত্রণাকাতর?
আকাশের অধিপতি অনেকদিন থেকেই সতর্ক করে আসছিলেন। হত্যা, খুন, ধর্ষণ, আত্মসাৎ, সামাজ্যবাদ বিস্তারের কু-লিপ্সাসহ রাশি রাশি পাপে ডুবে থাকা মানবমন্ডলীকে নির্জলা- বিশুদ্ধ জীবনের কথা কয়ে আসছিলেন। ক'জন শুনেছিল তার কথা?
পথের ধারে হাসপাতালের সামনটায় দেখলাম মানুষের উপছে পড়া ভীড়! ভিন্ন আকৃতির, ভিন্ন বর্ণের,ভিন্ন বয়েসের; কিন্তু একটি বিন্দুতে এসে সবাই এক। সেটা হলো, সবাই মাস্ক নিয়ে চেহারা লুকোচ্ছে যেনো। আজকের দিনে মানুষের শ্বাস টানতে যাওয়া ভয়ানক অপরাধ। ওই যে শ্বাসের ভেতর অস্পৃশ্য করোনা ঘাপটি মেরে বসে অাছে!
প্রায় সন্ধ্যেবেলা যখন বাসাতে ফিরছিলাম, আমি এক মৃত্যুপুরীর ঝাপসা ছবি দেখি। আদু মিয়ার দোকানে রমজান ছাড়াও গমগমা ভীড় লেগে থাকে। রমজানে ভীড়ের মাত্রাটা বেড়ে কয়েকগুণে পৌঁছায়। না, ওই চঞ্চল দোকানটা আজ ঘুমিয়ে পড়ার অবস্থা। একফোঁটা মানুষও নেই দোকানের করিডোরে!
ট্যঙ্গামতো একটা ছেলে রাস্তার ধারে বাহারি ইফতারের থালা নিয়ে বসতো। মধ্যাহ্নের রাগী সূর্যটার তেজ নিস্তেজ হয়ে পড়ন্ত বিকেলে যখন লাল টুকটুকে হয়ে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়তো, তখন তো মিন্টু মিয়া হোটেলে ইফতার বিকিকিনিতে বুঁদ হয়ে থাকতো। রকমারি ইফতার
কেনায় কেমন হুড়োহুড়ি লেগে যেতো। দোকানটা আজ অবরুদ্ধ। প্রকান্ড টাইপ ক'টা তালা ঝুলে আছে রমজানের মুখরিত খাবার দোকানটায়।
রমজানের রাতের পরিবেশটাই অন্যরকম। শান্ত সমুদ্রের কোল ঘেসে পুষ্পকলির উপর হেঁটে আসা ঝিরিঝিরি পবিত্র বাতাসের মতনও না, আরো বেশি। দূরের মিনারা থেকে যখন 'আল্লাহু আকবার' ধ্বনিতে গুঞ্জরিত হয় চারপাশ, আল্লাহর প্রেমে মত্ত একঝাঁক মানুষ ছুটে চলে তারাবিহের সালাতে। কিন্তু আজ রাতে দেখলাম তার ব্যত্যয় ঘটেছে। কেমন ছন্দপতনের সুর! অন্য আর দশটা রমজানের মতো আজকের রাতে আমেজ নেই। মানুষজনের পবিত্র উপস্থিতি খুব বেশি একটা নেই। ক'জন মুসল্লি-ভেতর থেকে ভেজানো দরজা-মসজিদে নামায পড়ছে!
অনিশ্চিত অবসরে বসে আছে মানুষ।শিক্ষার্থী, চাকুরিজীবি, সবাই। সরকারী ছুটির তালিকা দেখার অপ্রয়োজনীয়তায় বাসার সাটা দেয়ালটার ক্যালেন্ডারে ধূলোর আস্তরণ পড়ে গেছে।
হঠাৎ ইষৎ দৃষ্টি পড়ল আমার স্কুল ব্যাগটার উপর। নিথর পড়ে আছে ব্যগটি, মাস পেরিয়ে গেলেও স্কুলে যাবার প্রয়োজন পড়েনি, তাই।
আমি মৃত্যুর ঘোরে হাসপাতালের নির্জন বারান্দায় নিথর চেয়ে থেকে দেখি, চারশাশে কেউ নেই। চেনাজানা কেউ একজন পাশের জায়গাটা দিয়ে বিদ্যুত বেগে -এখানে কিছুই নেই- এমন নির্বিকার ভাব নিয়ে আমার দেখা চোখের দূরত্ব পরিমাণ জায়গা পাড়ি দেয়। মানুষগুলো কতো নিষ্ঠুর! কতো স্বার্থপর! অথচ তাদের তরেই তো একদিন জীবনের মায়াটা পর্যন্ত ছেড়ে দিতে চাইছিলাম!
অনেক্ষণ পর কয়েকজন আদুরে সন্তান আগুনে পড়ে গেলে যেমন দৌড়ে ছুটে আসে মা, ঠিক ওরকম তারা আমার কাছটায় এগিয়ে এলো৷ খবু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম, এসব ফিরিশতা সদৃশ্য মানুষ অন্য কেউ না, যারা সেবার নাম চষে বেড়ান, তারাও না; কিছু মাদ্রাসার হুজুর! করোনার পৃথিবী কতই না ভয়ঙ্কর!
লেখক: শিক্ষার্থী
-এটি