শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
কাল যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন: মজলিস মহাসচিব ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল

আকাবিরের ওপর স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের ধারা ও কিছু কথা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জহির উদ্দিন বাবর ।।

এই মুহূর্তে আমার পড়ার টেবিলে সদ্য প্রকাশিত দুটি স্মারকগ্রন্থ শোভা পাচ্ছে। একটি আল্লামা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রহ.-এর ওপর। জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত গবেষক এই আলেম দুই বছর আগে ইন্তেকাল করেন। অপর স্মারকগ্রন্থটি মাওলানা মনজুরুল হক রহ.-এর ওপর। তিনি ময়মনসিংহ অঞ্চলে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন। ময়মনসিংহের প্রথম সারির বেশ কয়েকটি দীনি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে তাঁর হাতে। ইন্তেকালের প্রায় ২৮ বছর পর তাঁর স্বজনরা স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন।

দুটি স্মারকগ্রন্থই মাসখানেকের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে আবুল ফাতাহ ইয়াহইয়া রহ.-এর স্মারকগ্রন্থটি ৭১২ পৃষ্ঠার। এ যাবতকালে প্রকাশিত বড় স্মারকগ্রন্থগুলোর একটি। আর মনজুরুল হক রহ.-এর স্মারকটি ৩১২ পৃষ্ঠার। সাইজে বড় না হলেও গ্রন্থটি বেশ গোছালো এবং বিষয়সমৃদ্ধ। দুজন বিশিষ্ট আলেমের ওপর কাছাকাছি সময়ে প্রকাশিত দুটি স্মারকই আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাদের স্বজন, ভক্ত-অনুরাগী এবং স্মারকের সঙ্গে যুক্ত সবার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।

আমাদের দেশে বিশিষ্ট আলেম-মনীষীদের ওপর স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের ধারা খুব বেশি দিনের নয়। সম্ভবত সর্বপ্রথম মুজাহিদে আযম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.-এর ওপর স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয় মিরপুরের মাদরাসা দারুর রাশাদ থেকে। সেটা প্রায় ২০ বছর আগে। ছদর সাহেবের প্রতি একান্ত মুগ্ধ মাদরাসা দারুর রাশাদের প্রিন্সিপাল মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান তাঁর তত্ত্বাবধানে স্মারকগ্রন্থটি করেন।

এরপর বিষয়-বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ স্মারকগ্রন্থ হচ্ছে হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর ওপর প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থটি। হাফেজ্জী হুজুরের স্বজন ও ভক্ত-অনুরাগীদের তত্ত্বাবধানে পুরো কাজটি সম্পন্ন করেন আমাদের অগ্রজ ও প্রিয় ব্যক্তিত্ব মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। পরবর্তী সময়ে তিনি ময়মনসিংহের বড় হুজুর খ্যাত মাওলানা ফয়জুর রহমান রহ.-এর ওপর মাঝারি সাইজের একটি স্মারকগ্রন্থও সম্পাদনা করেন।

যতদূর মনে পড়ে এই ধারাবাহিকতায় আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. স্মারকগ্রন্থ, আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. স্মারকগ্রন্থ, মাওলানা আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী রহ. স্মারকগ্রন্থ, খতিব মাওলানা উবায়দুল হক রহ. স্মারকগ্রন্থ, আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ স্মারকগ্রন্থ, আরজাবাদের হাফেজ ফয়জুর রহমান স্মারকগ্রন্থ এবং বৃহত্তর মোমেনশাহী: উলামা ও আকাবিরসহ বেশ কয়েকটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

বেশ কিছু স্মারকগ্রন্থের কাজ পুরোদমে শুরু হয়ে আবার থেমেও যায়। যেমন বায়তুল মোকাররমের সাবেক পেশ ইমাম মাওলানা নুরউদ্দিন রহ., আরজাবাদ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী রহ., মাওলানা আখতার ফারুক রহ., মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ., মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ. প্রমুখের ওপর স্মারকগ্রন্থের কাজ হচ্ছে এমনটা শোনা গেলেও সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি।

সিলেটের হজরত মাওলানা নূরউদ্দীন গহরপুরী রহ.-এর ওপর বিশাল কলেবরের স্মারকগ্রন্থের কাজ শেষ হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই। আমার নিজেরও এর সঙ্গে যুক্ত থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। তবে স্মারকগ্রন্থটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি। আশা করি প্রকাশিত হবে শিগগির।

গত কয়েক বছরের মধ্যে চলে যাওয়া আলেমদের মধ্যে মাওলানা মহিউদ্দীন খান রহ., প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান রহ., মাওলানা কারী বেলায়েত হুসাইন রহ. প্রমুখের ওপর স্মারকগ্রন্থের কাজ চলছে বলে শোনা যাচ্ছে। প্রত্যাশা থাকবে, যথাসময়ে সেগুলো আলোর মুখ দেখবে।

গত ১০/১৫ বছরে চলে যাওয়া আলেম-মনীষীর সংখ্যা অনেক। জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক প্রভাব রাখতেন এমন বেশ কয়েকজন আলেম এই সময়ের মধ্যে চলে গেছেন। তাদেরকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় করে রাখার মতো আরও অনেক কাজ করার দরকার ছিল। ন্যূনতম তাদের জীবন ও কর্মের ওপর একটি স্মারকগ্রন্থ অন্তত হতে পারতো। অনেকের ওপর ছোটখাট হয়েছেও। তবে তাদের ব্যক্তিত্বের বিশালতার অনুপাতে হয়নি।

বিশেষ করে শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ., চরমোনাইর পীর মাওলানা ফজলুল করিম রহ., মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ., মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ. তাদের ওপর অনেক বেশি কাজ হওয়া দরকার। প্রত্যেকের ওপর অন্তত একটি প্রামাণ্য স্মারকগ্রন্থ করতে না পারা নিঃসন্দেহে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা। এর দায় কমবেশি আমাদের সবার ওপরই বর্তায়।

শুধু মৃতদের ওপর কেন, স্মারকগ্রন্থ জীবিত মনীষীর ওপরও হতে পারে। বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ওপর স্মারকগ্রন্থ হচ্ছেও। কিন্তু আলেমদের মধ্যে এই প্রবণতা কম। আমাদের প্রিয়ভাজন এহসান সিরাজ ও সালাহউদ্দিন জাহাঙ্গীররা ‘জীবন্তিকা’ নামে জীবিত মনীষীদের ওপর এ ধরনের কাজ শুরুও করেছিলেন।

তাদের প্রথম উদ্যোগটি ছিল মাওলানা মহিউদ্দীন খান রহ.-এর ওপর। তবে নানা সীমাবদ্ধতায় তারা মাওলানা খানের জীবদ্দশায় এটি প্রকাশ করতে পারেননি। যদিও তাঁর ইন্তেকালের পর প্রকাশিত হয়েছে। আল্লামা আহমদ শফী দা.বা.সহ শীর্ষ আলেমদের নিয়ে তাদের এ ধরনের উদ্যোগের কথা জানি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এই মহৎ কাজে যতটা সহযোগিতা পাওয়ার কথা তারা তা পাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্টদের উচিত তাদের যথাসম্ভব সহযোগিতা করা।

স্মারকগ্রন্থ করার বিষয়টি আসলে সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করে না। ইতোমধ্যে যাদের ওপর স্মারকগ্রন্থ বের হয়েছে তাদের স্বজন, ভক্ত-অনুরাগীরা যে খুব বেশি সামর্থ্যবান তা কিন্তু নয়। মূলত এটা নির্ভর করে মানসিকতা এবং প্রয়োজন বোধ করার ওপর। সাহস করে উদ্যোগ নিলে কাজ বাস্তবায়ন হয়ে যায় সেটার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত কয়েকটি স্মারকগ্রন্থ।

মাওলানা আবুল ফাতাহ ইয়াহইয়া রহ.-এর স্বজন, ভক্ত-অনুরাগীরা নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কর্মের ব্যাপ্তি ও পরিচিতির দিক থেকে তাঁর চেয়ে অনেক বড় বড় আলেমরাও চলে গেছেন গত কয়েক বছরে। যাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী, ছাত্র, মুরিদ ও ভক্ত-অনুরাগী রয়েছেন দেশ-বিদেশে। চাইলে এ ধরনের স্মারকগ্রন্থ তারা প্রতি মাসেই একটা করতে পারেন। কিন্তু এখনও করেননি। মূলত তারা এর প্রয়োজনটা সেভাবে বোধ করেন না। আর প্রয়োজন বোধ করলেও নানা কারণে তাদের দ্বারা সেটা হয়ে উঠছে না।

দুই.

আকাবিরকে স্মরণীয় করে রাখতে আমরা খুব বেশি উদ্যোগী নই কখনোই। অথচ আকাবিরের স্মৃতি হেফাজত, তাদের জীবন ও কর্মকে আলোচনায় এনে জীবন্ত করে রাখার ইতিবাচক, প্রশংসনীয় ও যথার্থ এই প্রয়াস ব্যাপকভাবে কার্যকর রয়েছে পাশের দেশ ভারত ও পাকিস্তানে। সেখানকার কোনো আলেম, বুজুর্গ, বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব ইন্তেকালের কয়েক দিনের মধ্যেই ডাউস সাইজের স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ পেয়ে যায়। জীবিত থাকতে তিনি যত আলোচিত ও চর্চিত হন তার চেয়ে বেশি চর্চায় আসেন ইন্তেকালের পর।

অপেক্ষাকৃত অপ্রসিদ্ধ ও অকেন্দ্রীয় ব্যক্তিরও অজানা এমন কিছু দিক উঠে আসে যা তার অনুসারীদের আপ্লুত করে, জীবনপথের পাথেয় যোগায়। সেখানকার মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক সাময়িকীগুলোও স্বতন্ত্রভাবে স্মরণ সংখ্যা বের করে। তাদের পত্রিকার কোনো কোনো স্মরণসংখ্যাও আমাদের দেশের স্মারকগ্রন্থগুলো থেকে অনেক বেশি প্রামাণ্য, তথ্যবহুল ও সমৃদ্ধ। আমাদের দেশে সে কালচারটা এখনও গড়ে ওঠেনি।

ভারত-পাকিস্তানের বুজুর্গদের আমরা অসম্ভব রকম ভক্তি করি, তাদের প্রতি সর্বতোভাবে নিবেদিত হই, কিন্তু তাদের কর্মপন্থা গ্রহণের তাগিদ অনুভব করি না। তাদের দৃষ্টির সূক্ষতা, চিন্তার উদারতা, সময়চেতনা আমাদের মধ্যে ছাপ ফেলে না। আমাদের বুজুর্গানে দীন ও উলামায়ে কেরামের মধ্যে লেখালেখির অভ্যাসটা এমনিতেই কম। আর যারা লিখতে জানেন তারাও নিজের জীবনকথা সংরক্ষণ করার প্রয়োজন অনুভব করেন না, স্মৃতিকথা লেখেন না।

শায়খুল হাদিস জাকারিয়া রহ. রচিত স্মৃতি ও আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘আপবিতি’ পড়ে উজ্জীবিত ও মুগ্ধ হননি এমন আলেম-বুজুর্গ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাদের মুখে মুখে এই কালজয়ী গ্রন্থটির প্রশংসা শোনা যায়। কিন্তু তাদের নিজেদেরও যে বিচিত্রধর্মী সমৃদ্ধ একটি জীবন আছে, তারাও যে স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে এমন কিতাব রচনা করতে পারেন সে অনুভূতিটুকু কারও মধ্যে তেমন কার্যকর দেখি না।

কেউ তার নিজের জীবনকে যেভাবে উপলব্ধি করেন তার বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা তিনি নিজে ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের আকাবিরের স্মৃতি সংরক্ষণ না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো উপাত্ত-উপকরণের স্বল্পতা। তারা নিজেরা জীবদ্দশায় যেমন নিজেদের জীবনকথা লেখার তাগিদ অনুভব করেন না, তেমনি তাদের উত্তরসূরিরাও এ ক্ষেত্রে তেমন মনোযোগী হন না। এভাবেই অবজ্ঞা-অবহেলায় আকাবিরের জীবন, কর্ম ও সাধনা তলিয়ে যাচ্ছে কালের অতল গর্ভে।

নতুন প্রজন্মের কাছে চলে যাওয়া মনীষীদের তুলে ধরার ক্ষেত্রে এখনই আন্তরিক না হলে প্রাচীন প্রদীপতুল্য মুরব্বিরা হারিয়ে যাবেন বিস্মৃতির গভীরে। আমাদের স্বার্থেই এই প্রদীপগুলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে। ধর্মীয়, সামাজিক ও জাতীয়ভাবে অবদান রেখেছেন এমন মনীষীদের জীবন ও কর্ম পাঠ্যভুক্ত করার বিষয়টি খুব কঠিন কিছু না।

অন্তত কওমি মাদরাসাগুলোর যে কয়টি বোর্ড রয়েছে তাদের সিলেবাসে আমাদের দেশের চলে যাওয়া শীর্ষ আলেমদের জীবন ও কর্মের সংক্ষিপ্ত বিবরণ থাকতে পারে। শুধু পাঠ্যই নয়, বিশিষ্ট আলেমদের জীবন ও চিন্তাধারার ওপর পাঠচক্রও হতে পারে। থাকতে পারে তাদের প্রত্যেকের নামে পৃথক পৃথক পাঠাগার। তাদের জীবনীগ্রন্থ ও রচনার ওপর দেশব্যাপী বইপড়া প্রতিযোগিতাও হতে পারে।

এককথায় তাদের জীবনচর্চার ধারা যত সজীব করা যায় ততই ভালো। তাদের অবদান ও কীর্তি যত ছড়িয়ে দেয়া যায় ততই মঙ্গল। আর এটা আকাবিরের কোনো স্বার্থে নয়, আমাদের নিজেদেরই স্বার্থে, আগামী প্রজন্মের পথচলাকে আরও সাবলীল ও গতিময় করতে।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ