শরীফ মুহাম্মদ ।।
সম্প্রতি বিশিষ্ট লেখক শরীফ মুহাম্মদের একটি দীর্ঘ আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নেন জহির উদ্দিন বাবর। সেই সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের তৃতীয় সংখ্যায়। আওয়ার ইসলামে পুরো সাক্ষাৎকারটি পর্যায়ক্রমে গদ্য আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো দ্বাদশ পর্ব
আমার ওপর লেখার প্রভাব দুই ধারার মানুষেরই আছে। যারা আমাদের কাছে বরেণ্য ইসলামি লেখক তাদের প্রভাবও আছে, আর যাদেরকে আদর্শের বিচারে একদম পছন্দ করি না, কিন্তু তাদের লেখার গদ্য সুন্দর, তাদের প্রভাবও আছে। লেখালেখির ক্ষেত্রে হজরত মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ সাহেবের একটা প্রভাব আছে। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর সরল আরবি গদ্য ও জটিল উর্দু গদ্যের একটা প্রভাব আছে আমার ওপর।
আসলে লেখালেখির মূল জায়গাটায়, গদ্যের যে জায়গাটি সেখানে ব্যাপকভাবে আমি প্রভাবিত সাম্প্রতিক বিভিন্ন লেখকের গদ্যে। যারা আসলে আমাদের ধারার না। প্রথম আলোর অনেক গদ্য আমাকে টানে। সৈয়দ আবুল মকসুদের কলাম আমি মনোযোগ দিয়ে পড়ি। আনিসুল হকের গদ্য, আবার সৈয়দ মুজতবা আলী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের গদ্যের আলাদা আলাদা মজা। পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন, ঈদ সংখ্যায় লেখেন এমন অনেক গদ্যশিল্পীর গদ্য দ্বারা আমি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। দেশ ও আনন্দবাজারের নব্বই ও শূন্য দশকের বহু শারদীয় সংখ্যা আমার সংগ্রহে ছিল।
পশ্চিমবঙ্গের ইসলামি ধারার লেখক আবদুল আজিজ আল আমান সাহেবের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল এবং কৃতজ্ঞ। আল্লাহ তাঁকে জান্নাত নসিব করুন। আবদুল আজিজ আল আমান, কবি ফররুখ আহমদ এবং আল মাহমুদ এই তিনজন আমাদের মনের ওপর, কাজের ওপর অসাধারণ প্রভাব ফেলেছেন। শফিউদ্দিন সরদারের কথাও আমি এই জায়গায় বলব, তিনিও অনেক প্রভাব ফেলেছেন।
আবদুল আজিজ আল আমানের প্রভাবটা আমার শুরুর দিকের লেখালেখিতে ব্যাপকভাবে পড়েছে। শুরুর দিকে মানে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে সেই কাব্যময় গদ্যটা অনুসরণ কম করেছি। ঝরঝরে যে গদ্য চলে আসে সেটা আবদুল আজিজ আল আমান সাহেবের গদ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। আবার অন্য অনেকের ভেতরেও আমি কাব্যময় গদ্যের একটা অন্য রূপ দেখেছি।
আবদুল আজিজ আল আমান সাহেবের জাদুটা ছিল অন্য জায়গায়। এতো চমৎকার উপমা-উৎপেক্ষা তিনি ব্যবহার করতেন, আমাকে কেউ যখন জিজ্ঞেস করে তখন বলি আমি ‘সবুজ গম্বুজের ছায়া’ তাঁর গদ্য অনুসরণ করেই লিখেছি। কেউ যখন জিজ্ঞেস করে, আপনি এরকম বই আর লেখেন না কেন? আমি এটার উত্তর দিই, এরকম বই বেশি লেখা উচিত না। কারণ এটা সাধারণ গদ্য না। খুবই জটিল গদ্য। এটা নিরীক্ষামূলক গদ্য। জেনারেল গদ্যে এই নিরীক্ষামূলক গদ্যধারা বেশি হওয়া উচিত বলে মনে হয না। এজন্য এ ধরনের বই আমি পরে আর লিখিনি। এমন না যে এখন লিখতে চাইলেও পারব না।
রসিকতা করে বলছি, আমাকে যদি কেউ পরীক্ষা নিতে চায় আপনি আরেকটা গল্প বা গল্পের বই ওই সবুজ গম্বুজের ছায়ার মতো করে লিখুন তাহলে আমি লিখতে পারব বলেই আশা করি। কিন্তু আমার কাছে কেন যেন মনে হয় এখনকার গদ্যের ভাষাটা ঠিক এ রকম না। এখনকার গদ্যের ভাষাটি হলো খুব ঝরঝরে। প্রাঞ্জলতার মধ্যে ছোট ছোট করে কথাটা বলে ফেলা। ওইটা ছিল একটা বিশেষ কাজ। আবেগময় নিরীক্ষাধর্মিতা।
তারপরেও মনের অবচেতন থেকে আবদুল আজিজ আল আমান সাহেবের প্রভাব হয়তো আমার ওপর পড়েছে। আমার আরেকটা জিনিস হয়, আমি মাঝে মাঝে কবিতা পড়ি খুব মনোযোগ দিয়ে। আধুনিক কবিতা। গদ্যে কবিতার ব্যবহার, কাব্যভঙ্গির ব্যবহার বা কবিতায় যে বাক্যগুলো ব্যবহার হয় এটা গদ্যকে উন্নত করে।
আপনি আল মাহমুদের কবিতা যদি মনোযোগ দিয়ে পড়েন, নির্মলেন্দু গুণের কবিতা মনোযোগ দিয়ে পড়েন, আবুল হাসানের কবিতা, সৈয়দ শামছুল হকের কবিতা, সাইয়্যিদ আতিকুল্লাহর কবিতা; এদের কবিতা পড়লে কবিতায় যে শব্দের ব্যবহারগুলো হয়, বাক্যের ব্যবহারগুলো হয়, যদি কারও মুন্সিয়ানা থাকে, সুন্দরভাবে সেসবের ঝলক সে গদ্যে এনে ফিট করতে পারে অথবা ওখান থেকে শিখে নিজের মতো করে একটা শব্দ বা শব্দবন্ধ বানাতে পারে তাহলে আমার কাছে মনে হয় সে গদ্যে ছন্দও আসে, অনুপ্রাসও আসে, গদ্যের মধ্যে একটা ভিন্নরকম দ্যোতনাও তৈরি হয়।
অনেক লেখকই আমার প্রিয়। অনেক সময় হয়, একটা বই পড়ে মুগ্ধ হয়ে বসে থাকি। আর কিছুই করি না। অনেক সময় পত্রিকায় একটা লেখা পড়ে আমি মুগ্ধ ও স্থির হয়ে যাই। এরপরও যদি ধারাবাহিকভাবে বলতে থাকি বিভিন্ন সময় বাংলা ভাষায় প্রিয় লেখকদের মধ্যে বিভিন্ন সময় যারা প্রিয়দের তালিকায় এসেছেন, আমার উস্তাদ মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ সাহেব, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেব, এরপরে এসে মাওলানা আবুল ফাতাহ ইয়াহইয়া, আবুল বাশার সাহেব, হেমায়েত উদ্দিন সাহেব, অন্য ধারার মানুষদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ থেকে নিয়ে অনেকেই আছেন।
লেখার প্রিয় অন্য অর্থে, তার লেখার ভঙ্গিটা আমার ভালো লাগে, এই অর্থে হুমায়ুন আজাদের কথাও বলতে পারেন; কখনও কখনও সৈয়দ শামছুল হক, আহমদ ছফা এবং অবশ্যই আল মাহমুদ। আল মাহমুদের গল্প, কলাম, স্মৃতিগদ্য মনোযোগ লাগিয়ে পড়ার বিষয়। অভিব্যক্তি ও শব্দের খেলা দেখবেন। কলামের দিক থেকে মাহমুদুর রহমানের কলাম, মোবায়দুর রহমান, আনিসুল হক, সৈয়দ আবুল মকসুদ, গৌতম দাস, সঞ্জিব চৌধুরী এরকম অনেকের কলাম এবং লেখা আমার কাছে ভালো লাগে।
রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ এখনও মুগ্ধ হয়ে পড়ি। মনে হয় যেন দাগ দিয়ে দিয়ে পড়ি। শরৎচন্দ্রের প্রচুর বই পড়েছি। কলকাতার লেখকদের লেখা একটা সময় অনেক পড়েছি। এখনও যখন দেশ বা আনন্দবাজারের কোনো সংখ্যা আমি পাই মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। ম্যাসেজটার সঙ্গে অনেক সময় আমার দ্বিমত থাকে, কিন্তু তাদের উপস্থাপন ভঙ্গি, তাদের বাক্য-কলাকৌশল, এগুলো থেকে অনেক কিছুই বোঝার চেষ্টা করি।
এখন পর্যন্ত আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২০টি পার হবে। নিজের সব বই-ই তো ভালো লাগে, মায়ায় জড়ানো সৃজন। তবু আমি কয়েকটা নাম বলব, সবুজ গম্বুজের ছায়া, রঙিন মখমল দিন, ইতিহাসের লাল আস্তিন, শুধু তোমাদের জন্য, ফিলহাল সিরিজ, সাহাবায়ে কেরামের গল্প।
বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকদের আচরণের কথা বললে আমি সামগ্রিকভাবে বলব, ভালো পেয়েছি। একদম শুরু থেকে বললে বলতে হবে কোনো কোনো প্রকাশকের কাছ থেকে অপমানিতও হয়েছি। আবেগ ও অভিমানে কাতর হয়েছি। কিন্তু এখন এসে মনে হয়, তারাও তো মানুষ, আমি এগুলো মনে রাখতে চাই না।
আমি এখন এটাই বলব, বিশেষ করে গত পাঁচ-সাত বছর ধরে যারা আমার বইপত্র বের করছেন, আমি খুব সীমিত সামর্থ্যের মানুষ, সে হিসেবে তারা আমাকে যথেষ্ট সম্মানিত করেছেন, যথেষ্ট সম্মান দিয়েছেন। আমি চাই প্রকাশকদের এমন আচরণ অন্য লেখকরাও পাক, আরো ভালো পাক। তাদের আচরণ আরও উন্নত হোক। তাদের সামর্থ্যও বেড়ে যাক। তারা লেখকদের আরও অধিকতর সম্মানিত করুক, সেই দোয়া করি।
লেখালেখি দ্বারা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার অর্থ যদি হয় নিয়মিত কিছু পেতে থাকা বা বিশাল কিছু পেয়ে যাওয়া তাহলে আমি বলবো তেমন না। তবে এটাও বলব, গত পাঁচ-সাত বছর যারা আমার বইগুলো প্রকাশ করেছেন তারা এককালীন বা দুই ভাগে বা তিন ভাগে যে টাকাটা দিয়েছেন সেটা আমার জন্য অনেক টাকা।
আমি এই লাভটাকে তুচ্ছ করে দেখতে পারি না। এই টাকা দিয়ে আমি হয়তো কোনো ঋণ পরিশোধ করেছি, কোনো প্রয়োজন পূরণ করেছি। আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে বলব, অনেক লাভবান হয়েছি। আমার এই অনেক লাভবানের মধ্যে কৃতজ্ঞতার ভাষাটা বেশি। এর মানে এই নয় যে, অন্য অনেকের চেয়ে অনেক বেশি লাভবান হয়েছি। আমি যেটা পেয়েছি এটাও কম না আবার এটাকে কম করে দেখতেও চাই না।
আরএম/