সম্প্রতি বিশিষ্ট লেখক শরীফ মুহাম্মদের একটি দীর্ঘ আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নেন জহির উদ্দিন বাবর। সেই সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের তৃতীয় সংখ্যায়। আওয়ার ইসলামে পুরো সাক্ষাৎকারটি পর্যায়ক্রমে গদ্যআকারে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো নবম পর্ব
দৈনিক পত্রিকায় কাজ করা একই সঙ্গে আমার জন্য ছিল শেখার জায়গা, চ্যালেঞ্জের জায়গা, এগিয়ে যাওয়ার জায়গা। আবার কিছুটা নিজেকে বাঁচিয়ে চলার জায়গাও। আমি দৈনিক আমার দেশে ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সালে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত কাজ করেছি। একদম শুরুরদিকের সময়গুলো ছিল নিতান্তই শিক্ষার। দূরে দূরে থেকে লিখেছি, দেখেছি।
পরবর্তী সময়ে ইসলাম পাতার আয়োজন, লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ, বিষয় বিন্যাস, সাবজেক্ট ঠিক করা, এই পুরো বিষয়গুলোর সঙ্গে জড়িয়ে যাই। আমার দেশের হাউজটা ছিল একটা ওপেন হাউজ, খোলামেলা একটি ফ্লোরে। এটার সুবিধা ছিল এই, সম্পাদকীয় বিভাগে যারা কাজ করছেন, সাহিত্য বিভাগে যারা কাজ করছেন, রিপোর্টিংয়ে যারা কাজ করছেন, ডেস্কে যারা কাজ করছেন, প্রুফ সেকশনে যারা কাজ করছেন, এমন কি ডিজাইন ও কম্পিউটার সেকশনে যারা কাজ করছেন সবারই আমাদের একসঙ্গে চলাফেরা হতো।
এজন্য একটি পত্রিকার নানা রকম পরিস্থিতি বোঝা, সেন্স বোঝা, কোন ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত, কোন জিনিসটা আলোচনায় আসা উচিত, কখন কী করা দরকার, এই জিনিসগুলোর কিছু বিষয় আমি আমার দেশ থেকে শেখার সুযোগ পেয়েছি। পত্রিকাটির শেষ দিকে আমি কিছু গোছানো কাজ উপহার দেয়ার চেষ্টা করেছি।
মূলধারার গণমাধ্যমে আসলে একটা মিশ্র পরিবেশ থাকে। মানুষগুলোর মধ্যেও থাকে বিভিন্ন মনস্তত্ত্ব। নারী থাকে, অনেক সময় অমুসলিমও থাকে। ইচ্ছা করেই এই বৈচিত্র্যটা ঘটানো হয়। সেখানে একজন তরুণ আলেম তার লেবাস পোশাক ঠিক রেখে চলতে গেলে কিছু টিজ, খোঁচাখুঁচি, গুতাগুতির শিকার হতে পারে। মনের জোর দিয়ে এগুলো অতিক্রম করতে হবে, এটা আমার মূল্যায়ন ও অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয়ত আদর্শিক জায়গাগুলোতে খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন ভুলভাবে আমি ব্যবহৃত না হয়ে যাই। আল্লাহ যে আমাকে লেখার একটা হাত দিয়েছেন, ভাবার একটা যোগ্যতা দিয়েছেন এখানেও যেন আমি আমার কথাটা বলার চেষ্টা করতে পারি। এই চেষ্টাটা করতে থাকতে হবে।
উল্টো আরেকটি ব্যাপার হলো, মিশ্রপরিবেশে অনেকের সহযোগিতাও পেয়েছি। যারা একটু ইসলামমনা শুধু তাদেরই নয়, আমি চলতে গিয়ে দেখেছি, মন মানসিকতায় যে লোকটাকে মনে করা হয় উল্টো ধারার, কাজের ক্ষেত্রে তাকেই আবার ভিন্নভাবেও পেয়েছি। লোকটাকে মন-মেজাজে একটু সেক্যুলার মনে হচ্ছে, আমার কাজের অন্য জায়গায় বা লেখার সুযোগের ক্ষেত্রে সে অনেক ভদ্র, আমি এটাও পেয়েছি। এজন্য কেউ যদি মূলধারার মিডিয়ার জায়গায় কাজ করতে যায় তার মধ্যে ধৈর্য থাকতে হবে, আবার দৃঢ়তাও থাকতে হবে।সবাইকে শুরু থেকেই বৈরী মনে করে, বৈরী ধরে নিয়ে এবং বৈরী হিসেবে আচরণ করে চলার দরকার নেই। বরং অপ্রত্যাশিত সহযোগিতাও পাওয়া যায় চলাচলের ক্ষেত্রে।
মূলধারার নিউজ পোর্টাল বার্তা টোয়েন্টিফোর ডট নেটে শুরুর দিকে ছয় মাসের মতো আমি কাজ করেছি। সেটা ২০১১ সালের দিকে। আমার জন্য সেটা শুধুই শেখার ব্যাপার ছিল। কারণ আমি কম্পিউটারে খুব পারদর্শী না। অনলাইন পোর্টালে কাজ করতে গেলে ইন্টারনেট এবং কম্পিউটার ও সাংবাদিকতা এই তিনটা জিনিসের সমন্বয় থাকলে ভালো। আমার নিউজভিত্তিক সাংবাদিকতার সেন্স এতো প্রখর ছিল না। কারণ আমি কাজ করেছি ইসলাম পাতায়। আর কম্পিউটারে খুব দুর্বল। এখনও আছে এই দুর্বলতাটা। আর তখন ফেসবুক, নেটের ব্যবহারটা এতোটা ছিল না।
২০১১ সালের কথা। মোবাইল কোম্পানির ইন্টারনেট প্যাকেজও তখন এতো সহজ ছিল না। ফলে দেশ-বিদেশের খবরা খবরের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততাও ছিল না তেমন। তবুও সম্পাদক সরদার ফরিদ আহমদ ভাইকে আমি শুকরিয়া জানাই, তিনি আমার অন্যান্য লেখার কাজ দেখেই আমাকে সেখানে জড়িত করেছেন। আমি সেখান থেকে নিউজের সেন্স, অনলাইনের সেন্স এবং ইসলাম পাতার সীমানা অতিক্রম করে মূল নিউজ-রিপোর্ট এগুলো নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার একটা মেজাজ পেয়েছি। আমি সেখান থেকে অনেক কিছু শিখেছি।
বর্তমানে নিউজ পোর্টাল সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। এখানে অভিজ্ঞতা তো নানারকম। এরমধ্যে কিছু উপহার দেয়ার আনন্দের পাশাপাশি আক্ষেপের অভিজ্ঞতাও থাকে অনেক। আমাদের আয়োজনের ঘাটতির কারণে অনেক সময় মনে হয় দরকারি অনেক রিপোর্ট বা স্টোরি আমরা করতে পারতাম হয়তো রাজধানীতে এবং ঢাকার বাইরে আমাদের নিজস্ব রিপোর্টার থাকলে। এতে আমাদের সাইটটি আরও সমৃদ্ধ হতো। প্রতিদিনই আমার মনে হয়, আমাদের এই নিউজটা মিস হচ্ছে।এই জিনিসটার সরেজমিন হওয়া উচিত ছিল, সেটা হচ্ছে না। আবার অনেক নিউজ তথ্যের ঘাটতির কারণে যেভাবে করা উচিত সেভাবে করা যাচ্ছে না।
আরেকটি বিষয় হলো, সবাই জানেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় এখন কী ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে।এজন্য এমন অনেক তথ্য কানের কাছে এলেও, ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করলেও, ফোনে আমার কাছে এলেও তা করতে পারি না। মনে হয়, আমি যদি চাই পোর্টালটি টিকে থাকুক তাহলে কিছু নিউজ অপ্রকাশিত থেকে যাওয়াটাই ভালো। আমার এর চেয়ে বেশি আর আগানো উচিত না। এরকম বিচিত্র অভিজ্ঞতা হচ্ছে।
তারপরও মানুষের সহযোগিতা এবং নানাধরনের আবেগ ও ভালোবাসা যা পাচ্ছি এই পোর্টালে কাজ করে সেটা অনেক। আমাদের উপরে যারা রয়েছেন পরিচালনায়, আমাদের যেটা মূল প্রতিষ্ঠান ফেইথ মিডিয়া করপোরেশন এবং আমাদের প্রকাশক মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ সাহেব সহ অন্যদের ভালোবাসা এবং অপরদিক থেকে পাঠকের ভালোবাসা, এটার কথা মনে হলে আমাকে কৃতজ্ঞ হতেই হবে।
-এএ