[সম্প্রতি বিশিষ্ট লেখক শরীফ মুহাম্মদের একটি দীর্ঘ আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নেন জহির উদ্দিন বাবর। সেই সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের তৃতীয় সংখ্যায়। আওয়ার ইসলামে পুরো সাক্ষাৎকারটি পর্যায়ক্রমে গদ্য আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো ৬ষ্ঠ পর্ব]
আমরা যখন কামরাঙ্গীচর মাদরাসায় গিয়েছি, প্রথম বছর আবু তাহের মেসবাহ সাহেব-আদীব হুজুরকে দূর থেকে দেখতাম। একজন আনমনা মানুষ, রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, নবীন উস্তাদ ছিলেন, কিন্তু সবাই তাঁকে সমীহের চোখে দেখে। মাঝে মাঝে মসজিদের বারান্দায় একটা তেপায়া নিয়ে বসে লিখতেন। আমরা মাঠে খেলার সময় এই দৃশ্যটা দেখতাম। এক বছর পরই আমরা তাঁর ছাত্রত্ব গ্রহণের সুযোগ পাই।
তিনি আমাদেরকে নিজের লেখা ‘এসো আরবি শিখি’ পড়াতেন। ছাত্রদের মধ্যে যারা একটু আগ বাড়িয়ে সব বলত, শুনত, ইচ্ছে করে, চেস্টা করে নিজেকে সেই সারিতে নিয়ে যাই। বছরের শেষে তিনি আবার ক্লাসের ছাত্রদের মধ্যে একটা বাছাই করেন সাত-আটজনের। ওই গ্রুপটাতেও থাকার সুযোগ আমার হয়েছে।
আমি ছাত্রদের মধ্যে ছোট ছিলাম। মিজানের বছরও আমি উস্তাদদের বাসায় যেতাম। উস্তাদরা আমাকে কোনো কাজে বাসায় পাঠাতেন। এরপর থেকেই মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ সাহেবের লেখালেখি, তাঁর বক্তব্য, তাঁর বাচনভঙ্গি, খুব মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। মনে হতো এ রকম একজন লেখক যদি হতে পারতাম! তিনি তখন ‘ইকরা’ নামে একটি আরবি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।
অনেকে ভুলে লেখে ‘আল কলম’। আসলে তিনি ওই সময় ‘আল কলম’ করেননি, সেটা আরও পরে করেছেন। ওই যুগে মাদরাসায়ে নূরিয়া থেকে ‘ইকরা’ নামে একটি আরবি পত্রিকা বের হতো। তিনি এটার সম্পাদনা করতেন। ওইটাতে আমার একটা-দুটা লেখা তিনি প্রকাশ করেছেন। তবে সেই লেখায় আমার কিছুই থাকেনি। তিনি লেখাটি এতো সম্পাদনা করেছেন, সম্পাদিত হওয়ার পরে আমি দেখেছি আমার নামটা আছে লেখাতে আর থিমটা আছে, বাকি সবটাই তাঁর।
আরবিতে পরে আমার আর বেশি সময় দেয়ার সক্ষমতা হয়নি। তবে তিনি আমার ও আমাদের বাংলা কিছু লেখাও সম্পাদনা করে দিয়েছেন। তিনি অনেক গভীর সম্পাদনা করেন। দুই-চারটা বাক্য কাটেন না, লেখার লাইনে লাইনে কাটতে থাকেন। এখান থেকেও অনেক কিছু শিখেছি। আর বেশি প্রভাবিত হয়েছি আসলে তাঁকে দেখে। তাঁর প্রতি একটা চুম্বকের মতো আকর্ষণ অনুভব করতাম। ভাবতাম উনার মতো যোগ্যতাগুলো যদি আমারও হতো!
আমার মনে আছে, একটা ঘটনা। জালালাইনের বছর সম্ভবত। তখন আমরা মাদরাসায়ে নূরিয়ার উপরের দিকের ছাত্র। মরহুম মাওলানা মাসউদুর রহমান ভাইয়েরা তখন দাওরা পড়েন। কুরবানির আগে বিরাট একটি অনুষ্ঠান হয়। সেখানে হামদ, নাত, কবিতা, গজল, কেরাত, প্রবন্ধ অনেক কিছুর প্রতিযোগিতা ছিল। একজন ছাত্র দুইটা কি তিনটা বিষয়ে অংশগ্রহণ করতে পারত।
আমি প্রবন্ধে ছিলাম, বক্তৃতায় ছিলাম, কবিতায় ছিলাম। কবিতা মানে তখন যা লিখতে পারতাম আর কি। কবিতা যেটা লিখেছি সেটা সেদিন আবৃত্তি করেছি। আমার আবৃত্তির পরে আসরের আজান হয়ে যায়। আদিব হুজুর মঞ্চের পেছনে এসে আমাকে বললেন, ‘আমি তো কবিতা বুঝি না, তোর কবিতা কেমন হয়েছে সেটা আমি জানি না; তুই যে পড়েছিস সেটা আমার কাছে ভালো লেগেছে।’ আবৃত্তিটা উনার কাছে খুব ভালো লেগে যায়, সেটা তিনি বলেনও। এসব ঘটনাই আমাদের জন্য অনেক বেশি অনুপ্রেরণার ছিল। অনেক উদ্বুদ্ধকরণের ঘটনা ছিল।
মাওলানা মহিউদ্দীন খান রহ.-এর সান্নিধ্যে
প্রথমে ‘মুসলিম জাহান দর্পণ’ নাম ছিল; পরে ‘মুসলিম জাহান’ নাম হয়েছে। আমি তখন মতিঝিলের শিক্ষক। কিন্তু সন্ধ্যায় লালবাগে চলে আসি। মুফতি ফজলুল হক আমিনী সাহেবের সঙ্গে একদিন বাংলাবাজারে ‘মদিনা’ হাউজে গেলাম। তখন মুসলিম জাহান অফিসে গিয়ে মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী ভাইসহ পরিচিত কয়েকজনকে পাই। খান সাহেবের সঙ্গে সেদিন আমিনী সাহেব আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। অন্য কয়েকজনের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল।
মুহিউদ্দীন খান সাহেব বললেন, লেখা দিবা। পরিচিত অন্যরাও লিখতে বললেন। এটা সম্ভবত ১৯৯২-৯৩ সালের কথা। এরপর থেকে আমি বিকালে মুসলিম জাহানে যাওয়া শুরু করি। প্রথম কিছুদিন শখে শখে যাই। টুকটাক কাজ করি। তাদের যেটা দরকার হয় সেটা লিখে দিই। কিছু তরজমা করি। এক-দুই মাস পরে আমাকে সংযুক্ত করে নেয়া হয় প্রদায়ক হিসেবে।
শুরুতে মুসলিম জাহান ট্যাবলয়েড ছিল। সেখানে আসলে কে কোন পোস্টে ছিল সেটা লেখা হতো না। শুধু সম্পাদক আর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি-এই দুজনের নাম থাকত। পরে এটা ম্যাগাজিন হয় তখন বিভিন্ন পদ-পদবির সঙ্গে নাম লেখা হয়। পরবর্তী সময়ে আমি যখন স্টাফের মতো হয়ে গেলাম, আমি আর মাওলানা শহিদুল ইসলাম; আমাদের নাম প্রদায়ক হিসেবে লেখা হতো।
আসলে ছিলাম প্রতিবেদকই, প্রদায়ক হিসেবে লেখা হতো। প্রতি সংখ্যায় লিখতাম। উবায়দুর রহমান খান নদভী ভাই ছিলেন নির্বাহী সম্পাদক। আর কলামিস্ট ছিলেন সালেহ উদ্দিন আহমদ জহুরী, তিনি জহুরী নামে সংগ্রামেও লিখতেন। সেখানকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন। সৈয়দ মুহাম্মদ জহিরুল হক সাহেব ছিলেন।
ওখানে আমি বছরখানেক কাজ করেছি। আমাদের কাজের সময়ে বা শেষের দিকে দুজন যোগ দিয়েছেন। একজন মাওলানা মুহাম্মদ যুবায়ের, সম্পর্কে তিনি আমাদের মামা হন; জামিয়া ইসলামিয়া চরপাড়ার উস্তাদ ছিলেন, এখন কামরাঙ্গীচরে বাসা। উনার কিছু বইয়ের অনুবাদ আছে, দরসি কিতাব ও দ্বীনী সাধারণ বই। সুন্দর লেখেন, সুন্দর তরজমা করেন, তবে খুব নিভৃতচারী মানুষ।
আর মাওলানা যাইনুল আবিদীন ভাই। তিনি দেওবন্দ থেকে পড়ে এসে চৌধুরীপাড়া মাদরাসা, ময়মনসিংহের জামিয়া ইসলামিয়ায় শিক্ষকতা করে মুসলিম জাহানে যোগ দেন। সেখানে নদভী ভাই, জহুরী সাহেব এবং বিশেষভাবে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেবের সান্নিধ্য পেয়েছি। বিভিন্ন সময় বিভিন্নজনের কাছে লেখা দেখানো এবং একটা লেখাকে মূল্যায়ন করার ধরন, একটা বিষয়কে সাজানো, এটা নিয়ে নানারকম নির্দেশনা, নানারকম কথাবার্তা এ রকম একটা পরিবেশে আমাদের কাজ করার সুযোগ হয়েছে।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেবের নাম আমরা স্বপ্নের মতো শুনে এসেছি। ছাত্র জমানাতেই দূর থেকে বিভিন্ন মিটিং-মিছিলে দেখেছি। তবে ঘনিষ্ঠতা মুসলিম জাহানে কাজ করার সময় থেকে। আমি সেখান থেকে কাজ করে চলে আসার পরও মুহিউদ্দীন খান সাহেবের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কোনো হেরফের হয়নি। সেই সময় থেকে তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত আমার কাছে মনে হতো, আমার একজন অভিভাবক ঢাকার এক প্রান্তে আছেন। উনারও হয়তো অনেক সময় মনে হতো, উনার একজন শাগরেদ আমি। আবার এমন অনেক হয়েছে, মনের মধ্যে একটা বিষয় লিখব বলে ঘুরপাক খাচ্ছে, পল্টনে গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করে কথা বলতাম। ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি কিছু সময় দিতেন।
আমার জীবনে তাঁকে ঘিরে খুব উজ্জ্বল একটা স্মৃতি আছে। তখন আমি কেউ না, আমার দুই-তিনটা বইও বের হয়নি, ‘মুসলিম জাহান’ ছেড়ে চলে এসেছি, পত্রিকাতে কাজ করি না; মতিঝিল মাদরাসার শিক্ষকতা করি। শমরিতা হাসপাতাল তখন পান্থপথের মোড়ের দিকে ছিল। জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে তিনি একবার সেখানে ভর্তি হলেন। আমাকে কেউ একজন মতিঝিল মাদরাসায় ফোন করে বললেন, খান সাহেব আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। তিনি অসুস্থ, শমরিতা হাসপাতালে। এক সন্ধ্যায় আমি গেলাম। তখন মোবাইলের যুগ ছিল না।
সন্ধ্যার পরে সেখানে গিয়ে জহুরী সাহেবকে পেলাম। আরও কয়েকজনকে পেলাম। খান সাহেব বললেন, তুমি আসছ! আমি তোমাকে খুঁজছি। ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে বাপ-চাচারা যেভাবে কথা বলেন, সেই টোনে কথা বলতে থাকলেন। বললেন, এখন তো আমি ভালো, আমার তো অসুখ হয়ে যায় অনেক, আমার মনে হয়েছে, তোমাকে একটা কথা বলা দরকার। তুমি নীরদচন্দ্র চৌধুরীর বইগুলো পড়বা। কে এই নীরদচন্দ্র চৌধুরী! পশ্চিমবঙ্গ প্রবাসী, পরে লন্ডন প্রবাসী পূর্ববঙ্গের একজন বাঙালি, কথিত বুদ্ধিজীবী, যার বাড়ি কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের দিকে। মুহিউদ্দীন খান সাহেবের স্মৃতিচারণে তার বর্ণনা আছে।
হিন্দু জমিদারদের কী মানসিকতা ছিল, পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের প্রতি এটার নানা রকমের তাচ্ছিল্যপূর্ণ বর্ণনা নীরদচন্দ্র চৌধুরী তার ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ বইটাতে দিয়েছেন। খান সাহেব আমাকে বললেন, তার বইগুলো পড়বা আর পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের পক্ষ হয়ে লেখবা। বাঙালি অভিজাত হিন্দুরা, জমিদারিপ্রবণ হিন্দুরা, যারা মনে করে জমিদারি মুসলমানদের ওপর করবে, তাদের মানসিকতা তার লেখাগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে। তোমরা এগুলোর জবাব দিবা। তোমাকে বিশেষভাবে বলে যাচ্ছি। আমি মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেবের পরামর্শ বা ওসিয়ত কিছুই পালন করতে পেরেছি বা পারছি কি না জানি না, তবে তাঁর কথা মনে হলে আমার এই স্মৃতির কথাটিও মনে হয়।
আরেকটি ঘটনা। সেটা তাঁর জীবনের শেষ দিককার। একদিন মুফতি আবদুল মালেক সাহেবসহ গিয়েছিলাম হাসপাতালে তাঁকে দেখতে। সেদিন তাঁকে দেখতে যাওয়ার প্রোগ্রামটা হয়েছিল মুফতি আবদুল মালেক সাহেবের আগ্রহের কারণেই। তখন অন্য অনেক কথার মাঝে খান সাহেব বলেছিলেন, মাওলানা গাজি ইমামুদ্দিন বাঙালি সাহেব রহ.-এর ওপর তুমি লিখবা। সৈয়দ আহমদ শহীদ রহ.-এর সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব মুজাহিদ শরিক হয়েছিলেন ওইসব নিয়ে লিখবা।
এই কথাগুলো যখন আমার মনে হয় তখন মনে হয় তিনি এই কথাগুলো অনেক দুঃখী কোনো পিতা তার সন্তানদের যেমন ওসিয়ত করে যান রাজার গুপ্তধন উদ্ধার করার জন্য, অথবা বংশের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার জন্য, মাওলানা খান সাহেবও আমাকে কথাগুলো ওইভাবেই বলেছেন। এসব কথা মনে হলে আমার কাছে ওইরকম একটা অনুপ্রেরণাবোধ হয়, দুঃখবোধ হয়। চোখের পানি এবং হৃদয়ের পানি নিয়ে এই কথাগুলো আমার স্মৃতিতে জেগে ওঠে।
চলবে...
আরএম/