মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী ।।
হিজরি বর্ষপঞ্জীর প্রথম মাস মহররম। মহররম মাসের দশ তারিখই আশুরা নামে অভিহিত। আশুরা একটি ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল তাৎপর্যময় অনন্য দিন। এ দিনটি আদি মানব হজরত আদম আ. থেকে শুরু করে অনেক নবি-রাসুলের স্মৃতির সাথে জড়িত বলে বিভিন্ন বর্ণনায় উল্লেখ হয়েছে।
আশুরার দিনে যেসব তাৎপর্যময় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, সংক্ষেপে সেগুলো হলো:
১. এ দিনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পৃথিবী সৃষ্টি করেন। আর এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে।
২. এ দিনে হজরত আদম আ. জান্নাত থেকে দুনিয়ায় নেমে আসেন। মহররমের ১০ তারিখে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হজরত আদম আ.-এর তওবা কবুল করেন এবং এ দিনে তিনি স্ত্রী হজরত হাওয়া আ.-এর সঙ্গে আরাফার ময়দানে সাক্ষাৎ লাভ করেন।
৩. হজরত নুহ আ.-এর জাতির লোকেরা আল্লাহর গজব মহাপ্লাবনে নিপতিত হওয়ার পর আশুরার দিনে তাঁর নৌকা জুদি পাহাড়ে থেমেছিলো এবং তিনি নৌকা থেকে ইমানদারদের নিয়ে দুনিয়ায় অবতরণ করেন।
৪. হজরত ইবরাহিম আ. নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ৪০ দিন পর আশুরার দিনে সেখান থেকে মুক্তি লাভ করেন।
৫. হজরত আইয়ুব আ. ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগ করার পর মহররমের এ দিনে আল্লাহর রহমতে সুস্থতা লাভ করেন।
৬. হজরত ইয়াকুব আ.-এর পুত্র হজরত ইউসুফ আ. তাঁর ১১ ভাইয়ের ষড়যন্ত্রে কূপে পতিত হন এবং এক বণিক দলের সহায়তায় মিসরে গিয়ে হাজির হন। তারপর আল্লাহর বিশেষ কুদরতে তিনি মিসরের প্রধানমন্ত্রী হন। ৪০ বছর পর ১০ মহররম পিতার সঙ্গে মিলিত হন।
৭. হজরত ইউনুস আ. জাতির লোকদের প্রতি হতাশ হয়ে নদী অতিক্রম করে দেশান্তরিত হওয়ার সময় নদীর পানিতে পতিত হন এবং মাছ তাঁকে গিলে ফেলে। মাছের পেট থেকে তিনি আল্লাহর রহমতে ৪০ দিন পর মুক্তি পান ১০ মহররম তারিখে।
৮. হজরত মুসা আ. ফেরাউনের অত্যাচারের কারণে তাঁর দলবলসহ অন্যত্র চলে যান। পথিমধ্যে লৌহিত সাগর পার হয়ে তিনি ফেরাউনের হাত থেকে আশুরার দিনে মুক্তি পান। আর এই রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করার সময় ফেরাউন তার দলবলসহ লৌহিত সাগরের পানিতে ডুবে মারা যায় এই আশুরার দিনেই।
৯. হজরত ঈসা আ.-এর জাতির লোকেরা তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করলে মহররমের ১০ তারিখ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নিয়ে মুক্তি দান করেন।
তবে এসব ঘটনার অধিকাংশই সহিহ বর্ণনার মাধ্যমে প্রমাণিত নয়। বরং এসব ঘটনা মওজু রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে বিভিন্ন পুস্তকে লেখা হয়েছে। মওজু রেওয়ায়েতের পর্যালোচনা করার উদ্দেশ্যে যেসব কিতাব লেখা হয়েছে সেগুলোতে একথা পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য কোনও রেওয়ায়েতে এসব কথার কোনো আলোচনাই আসেনি।
যেমন, আশুরার দিনেই হজরত আদম আ.-এর তওবা কবুল হয়েছে। একথা আবুল কাসিম ইস্পাহানি রহ. কর্তৃক সংকলিত ‘আত-তারগিব ওয়াত তারহিব’-এর ১৮৬৮ নং রেওয়ায়েতে এসেছে। কিন্তু এই রেওয়ায়েতের সনদ খুবই দুর্বল। এছাড়া আরও কিছু রেওয়ায়েতে এই কথা এসেছে, সেগুলো মওজু।
অবশ্য কোনো কোনো তাবিয়ি থেকে এই কথা বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা হজরত আদম আ.-এর তওবা কবুল হওয়া সম্পর্কে আশুরার দিনের কথাই বলতেন। ইমাম ইবনে রজব রহ. প্রণীত লাতাইফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা-১১৩-১১৫ এবং আবদুল্লাহ ইবনে ইমাম আহমাদ রহ. প্রণীত আল-ইলাল ওয়া মারিফাতির রিজাল, বর্ণনা নম্বর-৩৭৯৫।
এছাড়াও হজরত নুহ আ.-এর নৌকা যেদিন জুদি পাহাড়ে থেমেছিল সেই দিনটি ছিল আশুরার দিন। একথা মুসনাদে আহমাদের একটি রেওয়ায়েতে এসেছে। কিন্তু তার সনদ দুর্বল। মুসনাদে আহমাদ ১৪/৩৩৫, হাদিস নং-৮৭১৭, শায়িখ শুয়াইব আরনাউতকৃত হাশিয়াযুক্ত নুসখা।
এর মধ্যে দুটি ঘটনা বিভিন্ন সহিহ হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। ঘটনা দুটি হলো- ১. হজরত মুসা আ. ও তাঁর সাথীদের ফেরাউন ও তার সৈন্যদের থেকে মুক্তি পাওয়ার ঘটনা; যেখানে সাগরে রাস্তা বানিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছেন। ২. সাগরের এই রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করার সময় ফেরাউন তার দলবলসহ লৌহিত সাগরে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা।
এই দুটি ঘটনা সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমসহ হাদিসের অনেক কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। (মুহতারাম মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক দা. বা.-এর পর্যালোচনা)।
পরিশেষে ৬১ হিজরির এ দিনটিতেই এমন একটি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যা উল্লিখিত সকল ঘটনাকে ছাপিয়ে ওঠে দিনটিকে একটি অনন্য ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করেছে। আর তা হলো, এ দিনেই প্রিয়নবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হজরত হুসাইন রা. কারবালা প্রান্তরে নির্মম ও নৃশংসভাবে শাহাদাত বরণ করেন। কারবালার এই হৃদয়বিদারক ঘটনা মুসলিম উম্মাহকে যে পরিমাণ শোকাহত করেছে, অন্য কোনো ঘটনা উম্মাহকে সেই পরিমাণ শোকাহত করেছে কিনা সন্দেহ।
কারবালার মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনা ইতিহাসের জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে আছে। যেখানে সত্যের পতাকাবাহী মাজলুমের রক্তে জালিমের হাত রঞ্জিত হয়েছে। ৬১ হিজরির এ দিনে মহানবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কলিজার টুকরা দৌহিত্র হজরত হুসাইন রা. সত্যের পতাকাকে সমুন্নত রাখার জন্য স্বীয় পরিবার-পরিজনসহ কারবালার ময়দানে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছেন, কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে থেকে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে পৃথিবীর বুকে অমর হয়ে আছেন হজরত হুসাইন রা.।
বাহ্যিক দৃষ্টিতে যুদ্ধে হুসাইন রা.-এর পরাজয় হলেও জয় হয়েছে সত্যের, জয় হয়েছে জালিমের বিরুদ্ধে মাজলুমের প্রতিবাদী চেতনার। যে চেতনা মজলুমকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়, আর জালিমের কলিজায় কম্পন সৃষ্টি করে। কারবালা ও ফোরাত শহিদদের রক্ত নিঃশেষ করে দেয়নি, বরং তা প্রতিটি মজলুমের ধমনীতে প্রবাহিত করেছে এবং জাগরণ সৃষ্টি করছে প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়ে।
আশুরা মাতম আর বুক চাপড়ানোর দিন নয়, বরং অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শপথ গ্রহণের দিন। বর্তমান সময়ে যখন বিশ্বব্যাপী মাজলুম মানবতা জালিমের যাতাকলে পিষ্ট। তখন আশুরার শিক্ষাকে ধারণ করে মানবতার মুক্তির জন্য সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকার করে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই প্রতিটি বিবেক সম্পন্ন মানুষের দায়িত্ব।
তাইতো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মহররম মাসের আগমনকে স্মরণ করে লিখেছেন : ফিরে এলো আজ সেই মহরম মাহিনা/ ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা।/ উষ্ণীষ কোরানের, হাতে তেগ আরবীর/ দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শীর।/ তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা/ শমশের হাতে নাও, বাধ শিরে আমামা/........
পবিত্র এই দিনে আমাদের প্রত্যাশা, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অবশ্যই মিথ্যার উপর সত্যকে বিজয় দান করবেন, জালিমের মুকাবিলায় সহায় হবেন মাজলুমের।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ মাইলস্টোন কলেজ, উত্তরা, ঢাকা।