তানভীর সিরাজ
আমাদের থেকে খুশির দিন ঈদ চলে গেলো। শরিয়তের আনন্দ বা উৎযাপনের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে শরিয়ত বিরোধী কার্যকালাপ থেকে দূরে থাকতে। কারণ তা শরিয়ত নিষিদ্ধ কাজ, যা জান্নাতি নয়, বরং জাহান্নামি বলে আখ্যা দিয়েছেন প্রিয় রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
তাই বলতে পারি ঈদকালীন আনন্দ-উৎযাপন শরিয়ত নিষিদ্ধ নয়, বরং শরিয়ত সম্মত, যদি তা শরিয়তের বাউন্ডারিতে সীমাবদ্ধ থাকে।
এ যে দেখুন, ঈদের দিন মুসলিম সম্প্রদায় ঈদের আমেজ উপভোগ করে আত্মীয়- অনাত্মীয়, কাছে বা দূরে ভিন্ন ভিন্ন ঘরে কিংবা বাসা বাড়িতে বেড়াতে যান। কেউ যান মামার বাড়িতে, কেউ যান খালার বাড়িতে, আবার কেউ যান চাচার বাড়িতে।
কেউ যান বন্ধুর বাড়িতে, কেউ যায় বান্ধবীর বাড়িতে, আবার কেউ যায় নানার অথবা দাদার বাড়িতে, কেউ যায় শ্বশুরবাড়িতে। সামাজিক সম্প্রদায় যারা, তারা যান সামাজিক জীবনের ঝাক্কিঝামেলা না থাকলে। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা খুব ভালো আর অনেক বড় নেকির কাজ।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ইরশাদ করেছেন- “وَاتَّقُوْا اللهَ الَّذِىْ تَسَائَلُوْنَ بِه وَالْأَرْحَامَ”
আর আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করো। যার ওছিলা দিয়ে তোমরা একে অন্যের কাছে নিজেদের হক চেয়ে থাকো এবং আত্মীয়দের (অধিকার খর্ব করা)কে ভয় কর। (সূরা নিসা, আয়াত ১)
মানবতার নবি বলেন-
يا أيها الناس أفشوا السلام، وأطعموا الطعام، وصلوا الأرحام، وصلوا بالليل والناس نيام تدخلوا الجنة بسلام. رواه الترمذي
‘হে মানবসকল ! তোমরা সালামের প্রচলন কর। অন্যকে খাবার দাও। আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখ আর রাতে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন তোমরা সালাত আদায় কর তাহলে শান্তির সাথে জান্নাতে যেতে পারবে।’ বর্ণনায়: তিরমিজি সহিহ বুখারিতে আছে, “من كان يؤمن بالله واليوم الأخر فليصل رحمه”
যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলা এবং পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে। (সহিহ বুখারি : ৬১৩৮)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “من أحب أن يبسط له فى رزقه وينسأ له فى أثره فليصل رحمه”
যে ব্যক্তি এই কথা পছন্দ করে যে, তার রিযিক প্রশস্ত করে দেয়া হোক এবং তার হায়াত বাড়িয়ে দেয়া হোক, তাহলে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে। (সহিহ বুখারি: ৫৯৮৬)
এসব আয়াত আর হাদিস শরিফ দ্বারা বুঝা যায় ঈদ কেন্দ্রিক কেন, যেকোনো সময় আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাদের কাছে আসা-যাওয়া করা ইসলামের একটি মহান কাজ।
আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার মাধ্যমে রিজিক প্রশস্ত করে দেয়া হয়, হায়াত বাড়িয়ে দেয়া হয় আর উভয়জাহানে সম্মানিত করা হয়।
বেশ দুঃখের সাথে বলতে হয় আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া ভালো, তবে সেই যাওয়া যদি গোনাহের কারণ হয় তাহলে না যাওয়া আরো বেশি ভালো কাজ। কারণ আজ আমরা গোনাহমুক্ত কদম কল্পনা করাও আজ স্বাপ্নিক কল্পনা।
কে কাকে বুঝাবে?! মা মেয়েকে, নাকি মেয়ে তার মায়ে?! সবার একই হালাত। আবার কখনো দেখা যায় মায়ের পরিধানে ইসলামী পোশাক নেকাপহীন বোরকা আর সাবালিকা মেয়ের গায়ে জিন্স পেন্ট!
আজকাল তো আরও ভয়ানক অবস্থা! সামান্য রাস্তা পারাপারে বাসা থেকে যখন মসজিদে যাই, তখনও নিজেকে গোনাহ থেকে সংবরণ করা কষ্টকর হয়ে যায়, কারণ গতানুগতিক জাহান্নামি পোশাকিদের ঈদ-বেড়ানোর যে এক মহড়া!
খুব মুশকিল আজ নিজের চোখকে পর্যন্ত শীশা ঢালা জাহান্নামী শাস্তি থেকে রক্ষা করাটা। আর সেইসব নারী, মহিলা আর মেয়েদের অভিভাবকদের কী অবস্থা হবে? বেপর্দা থেকে বাধা দেয়ার অধিকার যাদের আছে। তাদের সেই সম্পর্কে নবী আ. বলেন,
( ثلاثة قد حرم الله – تبارك وتعال- عليهم الجنة: مدمن الخمر، والعاق، والديوث الذي يقر في أهله الخبث). رواه أحمد والنسائي.
তিনপ্রকার মানুষের উপর মেহেরবান খোদা জান্নাতকে হারাম করেছেন: যে সর্বদা মদ পান করে, মাবাবার অবাধ্য সন্তানাদি আর দয়ুস (যে তার পরিবারে বেপর্দার সুযোগ করে দিয়েছে।) (ইমাম আহমদ ও ইমাম নাসায়ি)
আর স্বয়ং রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে আল্লাহ্ তাআলা বলেন-
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل لِّأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَابِيبِهِنَّ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَن يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا
(الأحزاب، / 59)
হে নবি! তুমি তোমার স্ত্রীদের, তোমার কন্যাদের এবং মুমিন নারীদেরকে বলে দাও, তারা যেন তাদের চাদর নিজেদের (মুখের) উপর নামিয়ে দেয়।
এ পন্থায় তাদেরকে চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দায়ালু। (সূরা আহযাব, আয়াত-৫৯)
মূলত উক্ত আয়াতটি ইভটিজিং প্রতিরোধক। সোনালি যুগে মুনাফিকরা মুমিন নারীদের উত্যক্ত করতো। সেইসময়ের কথা। পর্দার এই হুকুম কেবল নবী-পত্নীদের জন্য বিশেষ নয়, বরং সমস্ত মুমিন নারীদের জন্য বিশেষ হুকুম।
যখন নেকাব -হেজাবসহ পূর্ণ পর্দার সাথে চলাচল করা হবে তখন মুমিন নয় কেবল, প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর নারীরাই নিরাপদ, ইভটিজিং-এর আকাঁড়া আর ঝাপটা থেকে মুক্ত থাকে।
আমরা অনেকেই তো আজকাল দেখি বোরকা পরিধান করে অনুসলিম মেয়েরাও নানা অপকর্মে জড়িত হয়, পরে সব দোষ চাপাই মুসলিম সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি নারীর পর্দার উপর! নারীদের রক্ষাকবচ যদি হয় কোনো কিছু, তা একমাত্র শরিয়তি পর্দাই।
তবে যে সব অভিভাবক অধিনস্থদের বেলায় পর্দার পূর্ণ অভিভাবকত্ব করে না তাদের জন্য জান্নাতকে যেমন হারাম করা হয়েছে, তেমনি তাদের জন্য রয়েছে অবধারিত অভিশাপ। لَعَنَ اللّٰهُ النّٰاظِرَ وَ الْمَنْظُوْرَ اِلَيْهِ.
মহান আল্লাহ অভিশম্পাত করেন দৃষ্টিদানকারী পুরুষ ও দৃষ্টিদানে সুযোগদানকারীর উপর।’ -বাইহাকি, মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-২৭০ অথচ আল্লাহ্ তা'আলার ইলাহি সংস্কৃতি হল, দৃষ্টি অবনত রাখার।
আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
মুমিন নারীদের বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে আর তাদের শরমগাহ হেফাজত করে এবং নিজেদের ভূষণ অন্যদের কাছে প্রকাশ না করে, যা আপনিই প্রকাশ পায় তা ছাড়া এবং তারা যেন তাদের ওড়নার আঁচল নিজেদের বক্ষদেশে নামিয়ে দেয় এবং নিজেদের ভূষণ কেবল স্বামীর কাছে প্রকাশ করবে। (সূরা নূর-৩১)
উল্লেখিত আয়াতে যদি গভীর দৃষ্টি দেই তাহলে বেপর্দার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে আর অভিভাবকত্ব করতেও বেশ ভালো পাথেয় যুগাবে। আজকাল ঈদের আমেজের নামে যাই কিছু হচ্ছে তার ৯৯% ভাগই শরিয়তি পর্দার খেলাফ!
জেনার শ্রেণিভাগ- ১. বেগানা নারীর দিকে তাকানো চোখের জেনা। ২. বেগানা নারীর কন্ঠস্বর শোনা কানের জেনা। ৩. বেগানা মহিলার হাত স্পর্শ করা হাতের জেনা। ৪. পর মহিলার দিকে দুই পা অগ্রসর হওয়া পায়ের জেনা। ৫. বেগানা মহিলার সাথে কথা বলা জিহ্বার জেনা। ৬. কামভাবে কোনো বেগানা নারীর কথা মনে চিন্তা করা মনের জেনা।
৭. কামভাব মনে রেখে কারো সঙ্গে পত্রলাপ করাও হাতের ও মনের জেনা। প্রকৃত জেনার পূর্বে এত ধরনের আনুষঙ্গিক জেনা হয়ে থাকে বলেই আল্লাহ্ তা'আলা বলেন- “তোমরা জেনার নিটকবর্তীও হইও না।” (আল কুরআন)
ঈদে যারা আনন্দ প্রকাশ করে না প্রায় অসামাজিক। শক্তকথা। ঈদে যারা আনন্দ প্রকাশ করে তারা প্রায় সামাজিক। নরমকথা।
ঈদ যাপন করতে গিয়ে যদি আবার জান্নাতি আনন্দ জাহান্নামের খোরাক হয়, তা হলে সেই বেপর্দার ঈদ-যাপন মুসলিম সম্প্রদায়কে ভালো কিছু উপহার দিবে না, গিফট দিবে কেবল মনস্তত্ত্বিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক অশান্তি, অপথ, ইভটিজিং আর বেহায়াপনায় চিন্তার মহান মহান মুশকিলাত!
-এটি