সুফিয়ান ফারাবী
রজব আলী বিছানায় এপাশ ওপাশ করছেন। তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব। কিন্তু তিনি ঘুমুচ্ছেন না। কথাটি অন্যভাবে বললে বোধহয় আরো ভালো হবে। তার ঘুম আসছে না। মাথার উপর প্রকাণ্ড এক ফ্যান ঘুরছে। মোটেও বাতাস নেই। কিন্তু ক্রমাগত ক্যার ক্যার শব্দ করছে। দিন দিন ফ্যানের বিরক্তিকর শব্দ বেড়েই চলছে। কিছুদিন আগেও শব্দটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। কোনভাবে ঘুমানো যেত। এখন ঘুমানো যায় না। প্রচন্ড শব্দ হয়। মনে হয়, ফ্যান ঘুরছে না সাউন্ড বক্স বাজছে। তালে তালে শব্দ দিচ্ছে। এভাবেই কাটছে রজব আলীর বৃদ্ধাশ্রমের দিনরাত্রি।
নব্বইয়ের বেশী বয়স হয়ে গেছে রজব আলীর। কিন্তু তিনি এখনো বৃদ্ধাশ্রমে তার ছেলের কল্যাণের কথাই ভাবেন। প্রতিরাতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে ছেলের জন্য দোয়া করেন। যেই ছেলে তার বাবাকে সাত বছর আগে বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে রেখে গেছে। এরপর আর একবারও বাবাকে দেখতে আসেনি।
আদর করে রজব আলী ছেলের নাম রেখেছিলেন ইয়াকুব আলী। কিন্তু ইয়াকুব আলীর কাছে তার বাবার রাখা নাম পছন্দ হয়নি। তিনি নাম বদলিয়ে হয়ে গেলেন আহসানুল ইসলাম। চল্লিশোর্ধ্ব এই পুলিশ কর্মকর্তার অফিসের সামনে লেখা ইন্সপেক্টর আহসানুল ইসলাম। তার মনে জন্মদাতা পিতার জন্য সামান্যতম ভালোবাসাও নেই। এমনকি বাবার নাম বলতেও লজ্জা বোধ করেন তিনি।
কিন্তু শ্বশুর হাবিব মিয়ার নাম মুখে আনেন খুব গর্বের সাথে। কারণ তিনি পুলিশ সুপার। আর তার বাবা ছিলেন গ্রামের সাধারণ কৃষক। নিজের শেষ সম্বল আবাদি ভিটেমাটি বিক্রি করে ছেলেকে পুলিশের চাকরিতে জয়েন্ট করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
আজ দশ রমজান। রহমতের শেষদিন। রজব আলী ইফতারি সামনে নিয়ে বসে আছেন। সামান্য ছোলা, দুটো খেজুর, আর এককাপ মুড়ি। এই হলো বৃদ্ধাশ্রমে প্রতিদিনের ইফতার। ইফতারির আগ মুহূর্তে দোয়া কবুল হয়। দোয়া কবুলের এই সময়গুলো রজব আলীর খুব ভালোভাবে জানা। মাগরিবের দশমিনিট আগে তিনি মোনাজাত শুরু করলেন। দোয়ার ভেতর তিনি বারবার বলছিলেন; আল্লাহ তুমি ইয়াকুবকে যেখানেই রাখো, সুস্থ রেখো। সুখে শান্তি রেখো। দুনিয়ার সকল বালামুসিবত থেকে তাকে হেফাজত করো। আল্লাহ! তুমি আমার নাতি জাহিদুর রহমানকে নেকহায়াত দান করো। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকে সফলতা দান করো। আল্লাহ! তুমি আমার বউমাকেও সুস্থ রেখো, সুখসমৃদ্ধির জীবন দান করো। তোমার কাছে আমার একটাই মিনতি, আমাকে ঈমানের সাথে মৃত্যু দিয়ো।
শেষ দোয়াটি করার সঙ্গে সঙ্গে রজব আলীর দুচোখে অশ্রু জমতে শুরু করল। কষ্টের ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে খাবারের প্লেটে পড়তে লাগল। একসময় নিজেকে সামলাতে না পেরে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলেন, আল্লাহ! ঈমানের সাথে মৃত্যু দিয়ো। আল্লাহ! ঈমানের সাথে মৃত্যু দিয়ো।
বৃদ্ধাশ্রমের দিনগুলোতে রজব আলীর সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে গ্রামে কাটানো দিনগুলোর কথা। কত সুন্দর ছিল দিনগুলো। রজব আলী সারাদিনের কাজ শেষে বাড়ির উঠানে পাটি বিছিয়ে স্ত্রী মাহাবা বেগমের সাথে গল্প করতেন। প্রায় দিন মধ্যরাত পর্যন্ত পান চিবুতে চিবুতে কথা বলতেন তারা। বেশীরভাগ কথাই হতো তাদের ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে।
রজব আলী বলতেন, আচ্ছা! আমি যেদিন চলে যাবো, আমার যেদিন মৃত্যু হবে, তখন তুমি কী করবে, কার কাছে থাকবে?
মাহাবা বেগম বলতেন, কেন? আমাদের ছেলে আছে না! ওর কাছে থাকবো।
ও যদি তোমাকে না রাখে?
কেন রাখবে না? আমি কী ওকে গর্ভে ধারণ করিনি! আমি কী ওর মা নই!। ও রাখবে। নিশ্চয়ই রাখবে। আমার বিশ্বাস আমার সন্তান কখনো আমাকে ভুলবে না। মা হিসেবে আমাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিবে। আমি আমার ছেলের কাছ থেকে ভাল কিছুই আশা করি। একবার শুধু ওর চাকরিটি হতে দাও। দেখবে ও আমাদেরকে রাজা-রাণীর হালে রাখবে। ও যেখানে থাকবে আমাদেরকে সেখানেই রাখবে। যা খাবে আমাদেরও তাই খাওয়াবে।
রজব আলী সবসময় একটিই উত্তর দিতেন, তাই যেন হয়।
কিন্তু এখন রজব আলীকে নিজের দুর্ভাগ্য মেনে নিতে হচ্ছে। তিনি চিন্তায় ছিলেন তার স্ত্রীকে নিয়ে। অথচ এই নির্দয়তা, নিষ্ঠুরতা তার সঙ্গেই ঘটছে। তার ছেলে থাকে উত্তরার চার নাম্বার সেক্টর, দশ নাম্বার রোডের বিশাল ফ্লাটে। আর তিনি থাকেন মিরপুরে বৃদ্ধাশ্রমের একটি কামরায়। যেখানে সুস্থ মানুষের বসবাস করা প্রায় অসম্ভব। তার ছেলে ফাইভ স্টার হোটেলের খাবার ছাড়া খায় না। আর তার কপালে সাধারণ হোটেলের খাবারও জোটে না। ইন্সপেক্টর সাহেব ঘুমায় আলিশান খাটে। আরামদায়ক মেট্রেসের তুলতুলে বিছানায়। আর তার বাবা ঘুমান ছারপোকায় গিজগিজ করা, ময়লা দুর্গন্ধেভরা তোষকে। এই বুঝি ছিল তার কপালে! এই বুঝি ছিল আবাদি জমি বিক্রি করে ছেলেকে পুলিশ অফিসার বানানোর প্রতিফল!
আজ সাতাশ রমজান। রজব আলী বৃদ্ধাশ্রমের নামাজঘরে বসে আছেন। নামাজঘরে তারাবীর ব্যবস্থা আছে। যদিও তারাবীতে মুসল্লী তেমন হয় না। কারণ এখানে যারা থাকেন সবাই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। সবাই আশির ঊর্ধ্ববয়সী। তারা নামাজের ব্যাপারে উদাসীন। শুধু রজব আলীই নিয়মিত নামাজ পড়েন। তবে সমস্যা হলো এখানে খতম তারাবীর ব্যবস্থা নেই। ইমাম সাহেব সূরা তারাবী পড়ান। রজব আলী এখানে আসার আগে প্রতি রমজানে খতম তারাবী পড়তেন। এটি তার বাল্যকালের অভ্যাস। কিন্তু এখন তাকে নিরুপায় হয়ে সূরা তারাবী পড়তে হচ্ছে। মোটকথা দৈনন্দিন অন্যান্য সমস্যা ছাড়াও ইবাদাতও তিনি মনমতো করতে পারছেন না।
ঈদের চাঁদ উঠেছে। পৃথিবীর সকল মুসলমান আজ খুশি। কারণ রাত পোহালেই ঈদ। দীর্ঘ একমাস রোজা রাখার পর আল্লাহর পক্ষ থেকে এই দিনটি দিন নির্ধারিত হয়েছে আনন্দের জন্য। এদিনে পৃথিবীর সকল মুসলমানের মনে আনন্দের ঢেউ বইলেও কিছু মানুষ কষ্টের সাগরে হাবুডুবু খায়। তারা হলেন বৃদ্ধাশ্রমে ছেলে-মেয়েদের রেখে আসা অসহায় বাবা-মা। ঈদের দিনকে ঘিরে সবার মনে নানারকম পরিকল্পনা থাকলেও তাদের মনে থাকে না। তাদের মনে থাকে একধরনের চাপাকান্না। যা প্রকাশ করা যায় না ভাষায়। শুধু নিরবে চোখের অশ্রু ঝরে।
কারণ আনন্দ তো হয় নিজের পরিবারের সাথে, আপনজনদের সাথে। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমে যে তাদের আপন কেউ নেই। তারা কার সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করবে!। তাদেরকে জীবনযাপন করতে হয় একা। একদম নিঃসঙ্গ। ঈদে কমবেশি সবারই নতুন জামা থাকে। কিন্তু তাদের কপালে জোটে না একটুকরো ভালো কাপড়ও। বলা চলে ঈদ বলতে তাদের জীবনে কিছু নেই। আছে শুধু বুকভরা কষ্ট, মনভরা দুঃখ আর হৃদয়ে চাপা কান্না।
দীর্ঘ সাতবছর পর রজব আলীর সাথে কেউ একজন দেখা করতে এসেছে। আশ্রমের ঝাড়ুদার এসে রজব আলীকে বললো, চাচা! আপনার সাক্ষাৎ এসেছে। আমি ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রেখে এসেছি। আপনি গিয়ে দেখা করুন।
রজব আলী মনে মনে ভাবলেন, হয়ত রজব নামের নতুন কেউ আশ্রমে এসেছে। সাক্ষাৎ তার এসেছে। ঝাড়ুদার রফিক ভুল করে আমাকে ডেকেছে। আমাকে দেখতে আসার মতো কেউ নেই। সাতবছর যখন কেউ আসেনি, আর আসবেও না। এই ভেবে রজব আলী ফ্যান বন্ধ করে ঘুমুতে গেলেন। কিছুক্ষণ পর রফিক এসে বলল, “আপনি এখনো এখানে কী করছেন! বললাম না, আপনার সাক্ষাৎ এসেছে!
রজব আলী বললেন, যে এসেছে তার নাম কী?
রফিক বললো, জানি না। তবে গায়ে পুলিশের পোষাক।
রজব আলী শোয়া থেকে উঠলেন। তাহলে কী ইয়াকুব এসেছে! এতোদিন বাদে বুঝি বাবার কথা মনে পড়লো! যাক, মনে পড়েছে এটাই বড় কথা। রজব আলী ওয়েটিংরুমে গিয়ে দেখেন তার ছেলে আসেনি। এসেছে পুলিশের পোষাক পরিহিত অন্য একজন। কনস্টেবল হবে হয়ত।
সে রজব আলীকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কী স্যারের বাবা? মানে আহসান স্যারের।
রজব আলী বললেন, হ্যাঁ, আমি তোমাদের স্যারের বাবা। কি জন্য এসেছ বলো।
কনস্টেবল কি যেন বলতে চেয়েও নিরব রইল। রজব আলী বললেন, কী সমস্যা? আহসান কী আমাকে নিতে পাঠিয়েছে?
জি না, স্যার!
তাহলে যা বলতে চাচ্ছ সোজাসুজি বলে ফেল। মুখের ভেতর আটকে রেখো না।
কিছুক্ষণ বিষন্ন চেহারায় চুপ থেকে কনস্টেবল কাঁপা গলায় বলে, আজ দুপুরে গাড়িতে করে স্যার বাসায় ফিরছিলেন। মতিঝিল থেকে জসিমুদ্দীন পৌঁছলে উল্টোদিক থেকে আসা একটি বাসের সাথে তার গাড়ির সংঘর্ষ হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার জানিয়ে দেন, তিনি আর বেঁচে নেই...।
পরিশিষ্ট: সেদিন একই পরিবারের দু’জনের মৃত্যু হয়েছিল। ইন্সপেক্টর আহসানুল ইসলাম ও তার পিতা রজব আলীর। রজব আলী ছেলের মৃত্যুর শোকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। তখন তার চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রজব আলীর সেই বন্ধ চোখ আর খোলেনি। সেখানেই তার জীবনের সমাপ্তি ঘটেছে।
-এএ