মোস্তফা ওয়াদুদ
নিউজরুম এডিটর
রমজান মানেই মসজিদে ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিদের ভীড়। নতুন মুসুল্লিদের আগমন। তারা ইবাদাত করেন মনখুলে। সারাদিন রোজা রাখেন। রাতে তারাবির নামাজ পড়েন। মসজিদে একটা উৎসবমূখর পরিবেশ বিরাজ করে। একটা অন্যরকম আমেজ থাকে।
এ সময় নতুন মুসুল্লিদের ভীড়ে নিয়মিত মুসুল্লিগণও জায়গা পান না। বিষয়টি অবশ্যই অনেক তৃপ্তিকর। অনেক সুখকর। আনন্দদায়কও। সাথে সাথে তিক্তকর হলো রমজান শেষ হওয়ার সাথে সাথে মসজিদ থেকে মুসুল্লিগণও বিদায় নেন। অথচ রমজানের মতো সারাবছরই মানুষের উপর নামাজ ফরজ।
তাহলে রমজানে মসজিদে এত মানুষের ভীড়! রমজান শেষ হলেই ভীড় শেষ। এর কারণ কি?
জানতে চেয়েছিলাম গুলিস্তান গোলাপশাহ মসজিদের খতিব মাওলানা আব্দুল কাইয়ূম জামীর কাছে।
তিনি বলেন, রমজান রহমত ও বরকতের মাস। এ মাসে বান্দার প্রতি আল্লাহর বিশেষ নজর রয়েছে। এ মাসে সর্বত্র ধর্মীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তাই ইবাদাতের প্রতিও মানুষ খুব বেশি ধাবিত হোন।
রমজানে পরে সে পরিবেশটি বজায় থাকে না। তাছাড়া আজকে সাধারণ মানুষ স্যাটেলাইটে বন্দি। মসজিদ থেকে ঘরে এলেই টিভির সামনে বসতে হচ্ছে। সর্বক্ষণ সে একটি অন্য দুনিয়ায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এ যে, একটা ভিন্ন পরিবেশে মানুষের দিন অতিবাহিত হচ্ছে। যার ফলে মানুষ রমজানে যেভাবে মসজিদমুখী হয়েছিলো সেভাবে মসজিদমুখী থাকে না। বরং মসজিদবিমুখ হয়ে যায়।
রমজানের পরেও মসজিদে মুসুল্লিদের ধরে রাখার ব্যাপারে তিনি বলেন, ঘন ঘন ইসলাহি মজলিস করা যেতে পারে। উঠান মাহফিল করা যেতে পারে। এখনতো মাহফিলের প্রশ্ন আসলেই অনেক টাকার খরচের কথা চলে আসে।
এজন্য মাহফিলের খরচ কমিয়ে মাহফিলের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। আমার আব্বাজান মরহুম আব্দুর রহমান জামী রহ. বেশি বেশি উঠান মাহফিল করতেন। এতে করে মানুষের মাঝে সব সময়ই দীনি একটা পরিবেশ বিরাজ করতো।
আজকে সাধারণ মানুষ আলেমদের কাছে বেশি যায় না। বুযুর্গদদের সোহবতে সময় দেয় না। রমজানের পরেও যে নামাজের প্রতি সমান গুরুত্ত্ব রয়েছে সে বিষয়টি মানুষের জানা নেই। যার কারণে মসজিদে রমজানের পর মুসুল্লিও কম হয়।
আমাদের মসজিদগুলো শুধু ইবাদাতের জায়গায় সীমাবদ্ধ। শুধু নামাজের ইন্তেজাম থাকে। নামাজ পড়েই মুসুল্লিগণ চলে যান। মানুষের জীবনের কোনো খোরাক থাকে না। অর্থাৎ দীনি তালিম বা ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দেয়া হয় না। শুধু নামাজ পড়াটা মানুষের কাছে একরকম বোরিং বোরিং মনে হয়।
সুতরাং মসজিদকে শুধু নামাজে সীমাবদ্ধ না রেখে ধর্মীয় মারকাজ বানাতে হবে। ধর্মীয় মারকাজ বানাতে পারলে রমজানের পরেও আশা করি মসজিদে মুসুল্লিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ মসজিদকে যদি জীবনের খোরাক বানাতে পারি। তাহলে রমজানের পরও মুসুল্লিদের ধরে রাখা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।
কথা বলেছিলাম তানজিমুল আশরাফ আল ইসলামিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর মুহতামিম ও বিশিষ্ট ওয়ায়েজ, মাওলানা আমজাদ হোসাইন আশরাফীর সাথে।
তিনি বলেন, রমজানে মুসুল্লি বেশি হয় এটা রমজানের ক্রেডিট। উলামায়ে কেরাম, মসজিদের খতিব এমনকি সরকার পর্যায়ে মিডিয়ার মাধ্যমেও রমজানের গুরুত্ত্ব তুলে ধরা হয়। যার ফলে মানুষের কাছে রমজানের গুরুত্ত্ব অনেক বেড়ে যায়।
রমজানের পরে এ দাওয়াতি কার্যক্রম থেমে যায়। এতে মানুষের মনে যে আগ্রহ আর উদ্দীপনা থাকে রমজানকে ঘিরে সে আগ্রহ কমে যায়।
তাছাড়া রমজান আসে বছরে একবার। যে জিনিস কম আসে সে জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশিই থাকে। যেমন ধরুন, শবে বরাত বছরে একদিন আসে। তাই শবে বরাতে মসজিদেও মানুষের ভীড় অনেক বেড়ে যায়।
আর রমজানের পরে সারাবছর মানুষ দৈনিক পাঁচবার নামাজ পড়ে। যে জিনিস বেশি করা হয় সে জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহও কমে যায়।
অতএব রমজানের পরে মানুষকে মসজিদমুখী করার জন্য রমজানের পরেও দাওয়াতি কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। নামাজের গুরুত্ত্ব মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। রমজান এলে দেখা যায়, আমরা রমজানের ফজিলতপূর্ণ হাদিস নিয়ে খুব আলোচনা করি।
রমজানের গুরুত্ত্ব নিয়ে অনেক বেশি বয়ান করা হয়। কিন্তু রমজান শেষ হয়ে গেলে বয়ানও শেষ হয়ে যায়। সুতরাং রমজানের পরেও নামাজের গুরুত্ব নিয়ে বয়ান চালু রাখতে হবে। দাওয়াতি কাজ চালাতে হবে।
এক্ষেত্রে মসজিদের ইমামদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও ভূমিকা রাখতে পারে। রমজানে যেভাবে সর্বত্র নামাজের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সেভাবে রমজানের বাইরেও নামাজি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই রমজানের মতো না হলেও অন্তত রমজানের কাছাকাছি রকমের মুসুল্লি রমজানের বাইরেও মসজিদে ভীড় করবে বলে আমি মনে করি।
একই বিষয় জানতে চেয়েছিলাম মাদরাসা মারকাজুন নূর এর মুহতামিম ও তরুণ বক্তা মুফতি রেজওয়ান রফিকীর কাছে। তিনি এর কারণ হিসেবে তিনটি ব্যাখ্যা দেন।
১. আমরা জানি, শয়তান মানুষকে কুমন্ত্রণা দেয়। রমজানে যেহেতু আল্লাহ তায়ালা শয়তানকে বন্দি করে রাখেন। শয়তান মানুষকে কুমন্ত্রণা দিতে পারেনা। তাই ইবাদাতের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায়।
রমজানের পরে শয়তানও মুক্ত হয়ে যায়। সে মানুষকে পুনরায় ওয়াসওয়াসাহ বা কুমন্ত্রণা দিতে থাকে। এতে করে মসজিদে মুসুল্লিও কমে যায়।
২. দ্বিতীয় কারণ হলো, আমাদের দেশের অনেক মুসুল্লি এমন আছেন যারা সাপ্তাহিক মুসুল্লি। তারা শুক্রবার ও বিশেষ দিনের ইবাদাতকে বেশি গুরুত্ত্ব দেয়। তাদের কাছে দিন মাসের গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই তারা শুক্রবার ও রমজানে মসজিদে বেশি ভীড় করে।
মানুষ যদি নিজেদের জায়গা থেকে একটু ভাবুক হয়। চিন্তা করে যে, আমরা বিশেষ দিনের ইবাদাত কেনো করছি? শুধু রমজান আর শুক্রবারকে কেনো গুরুত্ত্ব দিচ্ছি? আল্লাহর বিধানতো সব সময়ই পালন করতে হবে। আল্লাহর বিধানের জন্য বিশেষ কোনো দিন নির্ধারণ নেই। বিশেষ কোনো মাসে শুধু আল্লাহর ইবাদাত নয়।
বরং সারাবছরই আল্লাহর ইবাদাত করতে হবে। এ অনুভূতি যদি সবার মনে চলে আসে তাহলে আশা করি রমজানের মতো সারাবছরই মসজিদে মুসুল্লি সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
৩. তৃতীয় কারণ হলো, বর্তমানে মানুষ আল্লাহওয়ালাদের সোহবতে কম যায়। যার কারণে সাধারণ মানুষের মাঝে দীনের শিক্ষা দিক্ষা অনেক কম। তাই তারা মানুষের দেখাদেখি রমজানে যতটা গুরুত্ত্বের সাথে ইবাদাত করে। সারাবছর ততটা গুরুত্ত্বের সাথে ইবাদাত করে না।
যদি সাধারণ মানুষ আল্লাহওয়ালা বুযুর্গদের সোহবতে বেশি বেশি যায় তাহলে তারা সব সময় ইবাদাত করার শিক্ষা দিবেন। এতে করে রমজানের পাশাপাশি অন্য সময়েও মানুষ ইবাদাতের প্রতি ঝুঁকবে।
এতে করে সারাবছরই মসজিদে মুসুল্লি থাকবে বলে আমি মনে করি।
এমডব্লিউ/