কৌশিক পানাহি: মুসলিম বিশ্বের প্রাচীন যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও টিকে আছে তার মধ্যে আল আজহার অন্যতম। এটি শুধু মুসলিম বিশ্বের নয়; বরং গোটা পৃথিবীরও অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়।
আল আজহার মসজিদকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তিত করা হয় ৯৭৫ সালে। শায়খ সাইয়েদ আল ফারিদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শায়খ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সূচনাকালে আল আজহারে বিভাগ ছিলো ৫টি। তাহলো, ইসলামি ধর্মতত্ত্ব, আইন, আরবি ভাষা ও সাহিত্য, ইসলামিক জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইসলামিক দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা।
আধুনিক আল আজহারের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬১ সালে। মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসের আল আজহারের হাজার বছরের অবকাঠামো ও ঐতিহ্য ভেঙে তাকে একটি সেকুল্যার বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেন।
তিনি আধুনিক অনেকগুলো বিভাগ ও অনুষদ যুক্ত করেন। যেমন– ব্যবসায় অনুষদ, অর্থনৈতিক অনুষদ, বিজ্ঞান অনুষদ, ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ ও কৃষি অনুষদ ইত্যাদি।
বর্তমানে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদগুলো তিনটি ইউনিটে ভাগ করা হয়েছে। তাহলো– ইসলামিক ও আরবি, বিজ্ঞান ও মানবিক। প্রত্যেক ইউনিটে রয়েছে একাধিক অনুষদ ও বিভাগ। আল আজহারে মোট ৮৭টি অনুষদ রয়েছে। যার ৪০টি মেয়েদের জন্য এবং ৪৭টি ছেলেদের জন্য।
বর্তমানে আল আজহারের প্রায় ১৫১৫৫ শ্রেণিকক্ষে ৩০ হাজারের বেশি শিক্ষক পাঠদান করেন। তাদের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করেন ৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের ২০ ভাগ বিদেশি। বর্তমানে ১০২টি দেশের শিক্ষার্থী আল আজহারে লেখাপড়া করছে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১০ জন ছাত্র আল আজহারের স্কলারশিপ পান। ২-৩ বছর আগে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আল আজহারের স্কলারশিপ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি দেয়া হতো এবং সেখানেই লিখিত পরীক্ষা ও ভাইভার মাধ্যমে ১০ জন মেধাবী ছাত্রকে বাছাই করা হতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। সেখানেই আবেদন প্রক্রিয়ার যাবতীয় তথ্য বিবরণী দেওয়া থাকে।
বলাই বাহুল্য, প্রতিবছর এই স্কলারশিপের কিছু না কিছু নিয়ম পরিবর্তন করা হয়। এই কারণে নির্দিষ্ট করে কোনও কাগজপত্রের কথা বলা হচ্ছে না। তবে পূর্ব-অভিজ্ঞতা বলছে, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ পেতে দাখিল ও আলিমের সার্টিফিকেট ও মার্কশিট, আলিমের প্রশংসাপত্র, জন্ম সনদ, মেডিক্যাল সার্টিফিকেট, পুলিশ-ক্লিয়ারেন্স, ছবি ইত্যাদি লাগে।
আবেদন শেষ হওয়ার পরে যাদের বাছাই করা হয়, তাদের নাম ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর সুযোগ পাওয়া ১০ জন মেধাবী ছাত্রের সমস্ত কাগজপত্র শিক্ষা মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে তারা মিশর অ্যাম্বসিতে পাঠিয়ে দেয়। মিশর অ্যাম্বসি আবার সকল কাগজপত্র মিশরের বিভিন্ন দফতরে প্রেরণ করে। তারপরে মিশরের যাবতীয় কাজ শেষ হয়ে যখন মিশরের নিরাপত্তা মন্ত্রণালয় থেকে মুয়াফাকা আমানিয়া চলে আসে বাংলাদেশের মিশর অ্যাম্বসিতে তখন ওই ১০ জন ছাত্রকে ভিসা নেওয়ার জন্য ডাকা হয়।
স্কলারশিপে আল আজহারে গেলে যে যে সুবিধা মেলে
- বাংলাদেশ থেকে আসা ১০ জন ছাত্রকে বিমানবন্দর থেকে আনার জন্য বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন মিশর-এর ছাত্র ভাইয়েরা তাদের গ্রহণ করে গাড়িতে করে আল-আযহার এর হোস্টেলে নিয়ে আসবে,
- ফ্রি থাকার ব্যাবস্থা,
- ফ্রি ৩ বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা,
- প্রতি বছর কিতাব ক্রয়ের জন্য অর্থ প্রদান,
- ছাত্রদের জন্য ফ্রি কুরআন মুখস্ত করার কোর্স,
- মারকাজ-এর মাধ্যমে ফ্রি আরবি ভাসা শিক্ষা কোর্স,
- মিশরের সমস্ত দর্শনিয় স্থানে ফ্রি ভ্রমণ করা,
- প্রতি মাসে ছাত্রদের জন্য মিশরিয় ৫০০ পাউন্ড প্রদান,
- এখানে এসে ২ বছর ছানাবিয়াহ (আলিম) শেষ করলে বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার টিকিট প্রদান,
- অনার্স ২ বছর শেষ করলে বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার টিকিট প্রদান,
- অনার্স শেষে একবারে চলে যাওয়ার টিকিট প্রদান,
- আর যদি কেউ অনার্স শেষ করে এখানে মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি করতে চান, তাহলে মাস্টার্স-এ তাকদিম করলে বাড়ি যাওয়া-আসার টিকিট প্রদান,
- আর সবচেয়ে বড় যে সুবিধাটা এ বছর থেকে চালু হয়েছে তা হলো বাংলাদেশের আলিম-এর সার্টিফিকেট-এর সঙ্গে আল-আযহার এর ছানাবিয়াহ (আলিম) সার্টিফিকেট-এর মোয়াদালা করা হয়েছে। আগে ছাত্রদেরকে এখানে এসে মাহাদে ভরতি হতে হতো, তারপরে সেখানে পরীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে তারা কোনও না কোনও শ্রেণিতে সুযোগ পেতো, ফলে দেখা যেতো, তাদের অনেকের অনার্স-এ উঠতে প্রায় ৩-৪ বছর লেগে যেতো। কিন্তু এবার মোয়াদালা হওয়ার কারণে মাত্র এক বছরের একটা মারকাজুল লুগাহ কোর্স করে সরাসরি অনার্স-এ ভর্তি হতে পারবে (এটা হলো যাদের বাংলাদেশের আলিয়া মাদ্রাসার সার্টিফিকেট আছে, শুধু তাদের মোয়াদালা)।
- আরেকটি সুবিধা হলো এখানে যেকোনও বয়সের লোক এসে ভর্তি হতে পারবে, যেমন- আলিয়া, কওমি, ইংলিশ মিডিয়ামসহ সব মাধ্যমের শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবে। তারা এখানে এসে যে ক্লাস পাবে, সেখান থেকে আস্তে আস্তে অনার্স লেভেলে যাবে।
যেভাবে নিজ খরচে আল আজহারে ভর্তি হওয়া যাবে
স্কলারশিপে আসার পাশাপাশি আল-আযহার ইউনিভার্সিটি’তে নিজ খরচেও পড়ালেখা করার সুযোগ আছে। সেটা যেভাবে হয়ে থাকে তাহলো– বাংলাদেশ থেকে টুরিস্ট ভিসা নিয়ে এখানে চলে আসার পরে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ভিসার মেয়াদ বাড়ানো যাবে। আর ১-২ বছরের মতো নিজ খরচে বাইরে থেকে স্কলারশিপের আবেদন করলে সাধারণত বেশিরভাগ ছাত্রের আবেদন কবুল করা হয়। সেক্ষেত্রে তারা পরবর্তীতে স্কলারশিপ-এর সকল সুবিধা পাবে। আর জেনে রাখা দরকার যে, মিশরে আল-আযহার ইউনিভার্সিটি-এর স্কলারশিপ হলো সবচেয়ে দামি স্কলারশিপ।
কেপি