তাওহীদ আদনান
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিশ্ব বিখ্যাত একটি উপত্যকা কাশ্মীর। কাশ্মীর অবস্থিত প্রধানত হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে। জম্মু, কাশ্মীর-উপত্যকা ও লাদাখ এই তিন অঞ্চল নিয়ে কাশ্মীর ও জম্মু নামে ছিল একটি স্বতন্ত্র রাজ্য। ছিল আলাদা রাজ্যশাসক৷ এ রাজ্যের শাসকেরা ঐতিহাসিক বৃহত্তর কাশ্মীর অঞ্চল শাসন করতেন।
সে হিসেবে এই রাজ্যের পূর্বে ও উত্তর-পূর্বে চীন অবস্থিত এবং রাজ্যের পশ্চিমে ও উত্তর-পশ্চিমে পাকিস্তান অবস্থিত আর রাজ্যের দক্ষিণে ভারত অবস্থিত৷ বর্তমানে কাশ্মীরের মালিকানা নিয়ে চীন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে রয়েছে বিবাদ। ফলে বর্তমানে কাশ্মীর অঞ্চলটি ভিন্ন ভিন্নভাবে তিনটি দেশ দ্বারাই পরিচালিত৷
কাশ্মীর নিয়ে তিন দেশের এই বিবাদের জেরে, চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকা কাশ্মীরের পূর্ব অংশটি আকসাই চিন নামে পরিচিত৷ আকসাই চীন ভারতের মতে ভারতের জম্মু এবং কাশ্মীর রাজ্যের লাদাখ নামক অঞ্চলের অংশ। অপরদিকে চীনের মতে, আকসাই চীন তাদের জিংজিয়াং প্রদেশের অংশ।
অপরদিকে পাকিস্তানের অধীনে থাকা কাশ্মীরের পশ্চিম অংশ পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিট-বালতিস্তান নামক অংশটি "পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীর" বা "আজাদ জম্মু ও কাশ্মীর" নামে পরিচিত। আর কাশ্মীরের দক্ষিণ অংশ ভারতের অধীনে থাকা জম্মু ও কাশ্মীর নামক অংশটি "ভারত-অধিকৃত কাশ্মীর" বা "ভারত-শাসিত কাশ্মীর" নামে পরিচিত।
কাশ্মীর হলো বিশ্বে সামরিকভাবে ব্যাপক গুরুত্ব পাওয়া অঞ্চলগুলোর একটি৷ একই সাথে ভারত ও পাকিস্তানের মতো দু'টি পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দেশের সবচেয়ে অস্থিতিশীল সীমান্তবর্তী এলাকাও এই কাশ্মীর। প্রতি বছরই ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে কোনো কোনো না ইস্যুতে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে হতেই থাকে একের পর এক সহিংসতা৷ ঘটতেই থাকে কোনো না কোনো নৃসংসতা৷
ভারত অধ্যূষিত কাশ্মীরে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংঘাতের কারণে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গিয়েছে গত বছর৷ ২০১৮ সালে নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিক ব্যক্তিসহ ৫০০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে।
ফিরে দেখা কাশ্মীর বিভক্তি
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান আর ভারত স্বাধীনতা পাবার আগে থেকেই কাশ্মীর বিতর্কের কেন্দ্রে। কাশ্মীরের অংশবিশেষ ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশ নিয়ন্ত্রণ করে। অপর একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ চীনের। কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৪৭ ও ১৯৬৫ সালে দু'বার আলাদা যুদ্ধ ছাড়াও দুই দেশের সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে অসংখ্য সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। যেসবের কারণে বর্তমানে কাশ্মীরের অর্থনীতির অবস্থা নাজুক, কর্মসংস্থান সঙ্কটপ্রবল এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চরমে।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ যখন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত ও মুসলিম মংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত হয় এবং ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে, তার আগে থেকেই কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিতর্ক ছিল। কাশ্মীরের পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিট-বালতিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে।
অন্যদিকে কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিং চাইছিলেন স্বাধীন থাকতে অথবা ভারতের সাথে যোগ দিতে। কিন্তু সে সময় কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে এই দ্বন্দ্বের সুরাহা করতে না পারায় পরের দুই বছর কাশ্মীর ইস্যুতে যুদ্ধ চলে দুই দেশের মধ্যে। ফলে প্রাথমিকভাবে কাশ্মীর তখন বিভক্ত হয়ে যায় দুই ভাগে।
দুই দেশের মধ্যে কয়েক দশকের দ্বন্দ্বে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কাশ্মীরের পর্যটন খাত৷ ভারত ও পাকিস্তানের এই দ্বন্দ্বের মধ্যে ১৯৫০' এর দিকে পূর্ব কাশ্মীর যে অঞ্চল বর্তমানে আকসাই চিন নামে পরিচিত তা দখল করতে থাকে চীন। ১৯৬৫ সালে দ্বিতীয় দফা যুদ্ধ হয় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। সেই যুদ্ধে কোনো সমাধান তো আসেইনি উপরন্তু যুদ্ধের দরুন চীন, আকসাই চীন নিজেদের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়৷ ফলে কাশ্মীর মোট তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়৷
কেনো অমীমাংসিত কাশ্মীর ইস্যুটি
১৯৫০'এর দশক থেকে জাতিসংঘ বলে আসছে যে, কাশ্মীর ইস্যুতে ঐ এলাকার মানুষের মতকে প্রাধান্য দেয়ার লক্ষ্যে একটি গণভোট আয়োজন করা উচিত৷ পাকিস্তান রাজি হয়ে যায় গণভোটের জন্য৷ কিন্তু পরবর্তীতে গণভোট আয়োজনে ভেটো ভারত৷ ভারত এই পরিকল্পনাকে শুরুতে সমর্থন করলেও পরবর্তীতে তারা বলে যে, গণভোট আয়োজন প্রয়োজনহীন৷ কারণ, ভারত অধ্যূষিত জম্মু ও কাশ্মীরে গণভোটের নির্বাচনে সেখানকার মানুষ ভারতের সাথে থাকার পক্ষেই মত দেবে।
কিন্তু পাকিস্তান ভারতের দাবি সমর্থন করে না।তাদের বক্তব্য, ভারত অধ্যূষিত কাশ্মীরেরও বহু মানুষই ভারতের সাথে থাকতে চায় না৷ তারা হয় স্বাধীনতা চায়, নয়তো পাকিস্তানের সাথে যোগ দেয়ার পক্ষপাতী। কেননা ভারত অধ্যূষিত জম্মু ও কাশ্মীরের জনসংখ্যার ৬০ ভাগের বেশি মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এটিই ভারতের একমাত্র রাজ্য যেখানে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগুরু। ফলে ভারতের পিছুটানের দরুন আর হয়নি গণভোট৷ হয়নি মীমাংসাও৷ যার ফলে আজ অবধি চলছে বিবাদ৷
কাশ্মীরের বর্তমান ইস্যু
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের একটি জেলার নাম পুলাওয়ামা৷ এই পুলওয়ামা জেলায় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি মর্মান্তিক হামলা হয় ভারতীয় সামরিক বাহিনীর উপর৷ হামলাটি কে বা কারা করেছে তার সঠিক তথ্য এখনো আসেনি গণমাধ্যমে৷ হামলাটি ছিল কয়েক দশকের মধ্যে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর উপর হওয়া সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী আক্রমণ৷ যেখানে কয়েক দফা বোমা বিস্ফোরণে এবং গোলাগুলিতে প্রায় ৫০ জনের মতো নিহত হয়েছে সামরিক বাহিনী। হামলার দায় ভারত চাপাচ্ছে পাকিস্তানের উপর৷
আর পাকিস্তান জানাচ্ছে অস্বীকৃতি৷ বিশ্লেকষরা বলছেন, ভারতের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজেপি সরকারের রাজনৈতীক চাল এই হামলা৷
কী হচ্ছে কাশ্মীরে?
এই পুলওয়ামা হামলাকে কেন্দ্র করে বরাবরের মতো এ বছরও চলছে কাশ্মীরজুড়ে ভারত সরকারের সহিংসতা৷ এমনকি শুধু কাশ্মীরজুড়ে নয় বরং পুরো ভারতজুড়েই চলছে কাশ্মিরীদের উপর নৃসংসতা৷ পৃথিবীর ভূ-স্বর্গ খ্যাত কাশ্মীর, যেখানের মেঠোপথ ও পাহাড়ী উপত্যকা, যেখানের বরফ ও প্রাকৃতিক দৃশ্য, যেখানের গাছ-গাছালী ও পাখ-পাখালী, যেখানের প্রতিটি খাল-বিল ও নদী-নালা এমনকি যেখানের প্রতিটি দৃশ্যই দুনিয়াতে পরকালীন স্বর্গের স্বাদে নিমজ্জিত করে দেয় মানুষকে, সে স্থানটিতেই বানানো হয়েছে এখন জ্বলন্ত নরক৷
বোধগম্যহীন বিষয় হলো, ভারত সরকার হামলার দায় দিলো পাকিস্তানকে আর সহিংসতা চালাচ্ছে কাশ্মিরী মুসলিমদের উপর! এ জায়গাটিতে এসে কেনো অঙ্কের এই গরমিল তা নিয়ে রীতিমতই ভাবনায় বোদ্ধামহল৷
কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে সর্বদাই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে দ্বন্দ্বের মূল রেশটা এসে বর্তায় ভারত নিয়ন্ত্রীত কাশ্মীরে বসবাসকারী নিরিহ মুসলমানদের ওপর। এই ধারাবাহিকতায় ইদানিংকালেও ভারতের বেশ কিছু শহরে বিক্ষোভের পাশাপাশি কাশ্মিরী মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী এবং ব্যাবসায়ীরা শিকারও হয়েছেন এবং হচ্ছেন জনরোষের।
ভারত অধ্যূষিত কাশ্মীরে গত সপ্তাহের শেষদিকে মোবাইল ইন্টারনেটও করে দেয়া হয়েছিল বিচ্ছিন্ন৷ মোট কথা পুরো ভারতজুড়েই চলছে কাশ্মিরী মুসলিমদের উপরে অত্যাচারের স্টিম রোলার৷ কাশ্মিরী মুসলিমদের বাসা-বাড়িতে হানা, ভারতের কলেজ-ভার্সিটিগুলোতে তাদের উপর অত্যাচারসহ চলছে অবর্ণনীয় তাণ্ডব, যা এক কথায় অমানবিক৷
কী চায় ভারত?
বর্তমান ইস্যুতে কাশ্মীরে সংঘটিত বিষয়গুলো কিছুই নয় কেবল ধর্ম বৈষম্যতা আর মুসলিম বিদ্বেষ৷ নতুবা ভারতীয় বাহিনীর এটা দেশের প্রতি কোন ধরণের ভালবাসা যে, স্বদেশেরই নিষ্পাপ শিশুদের করা হচ্ছে হত্যা, স্বদেশেরই ব্যবসায়ীদের করে দেয়া হচ্ছে নিশ্চিহ্ন, স্বদেশেরই ছাত্র সমাজকে করে দেয়া হচ্ছে পঙ্গু, স্বদেশীদেরই মুখ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে খাবার, বঞ্চিত করা হচ্ছে বাসস্থান থেকে?
এটা দেশের প্রতি কী ধরণের ভালবাসা যে, স্বদেশেরই মা-বোনদের সম্ভ্রমহানী করা হচ্ছে পদে পদে! সামরিক বাহিনীর অনুশীলন কেন্দ্র বানানো হচ্ছে যেনো স্বদেশেরই উর্বর একটি ভূমিকে! এগুলো কেনো হচ্ছে রোজ রোজ কাশ্মীরে? কাশ্মিরীদের কী অপরাধ তাহলে? কী অপরাধের বদলা নেয়া হচ্ছে তাদের থেকে? অপরাধ একটাই তারা মুসলিম৷ আর কাশ্মিরী মুসলিম নয়, ভারতের চাই মুসলিমমুক্ত কাশ্মীর৷
ভারতীয় বাহিনীর যদি মুসলিম বিদ্বেষ নাই হতো, যদি দেশের প্রতি এতোটাই ভালোবাসা তাদের হতো, তাহলে স্বদেশীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, কেনো বারংবারই ঠেলে দেয়া হচ্ছে তাদের বিপদের মুখে? এটা কোন ধরণের দেশীয় ভালোবাসা? এমন অমানবিক অত্যাচার তো ভীনদেশী শত্রুরাও চালায় না কোন শত্রু বাহিনীর উপর! স্বদেশেরই উর্বর ভূমি ভূ-স্বর্গ খ্যাত স্থানটিকেই করা হচ্ছে অনুর্বর ও ভূ-নরক৷
এটাও কি তবে দেশের প্রতি ভালোবাসা? যদি পুলওয়ামায় হামলা পাকিস্তানই করে থাকে, তাহলে কী অপরাধ কাশ্মিরী অধিবাসীদের? কেনো নিশানা বানানো হচ্ছে বারংবারই তাদের? অপরাধ কি একটাই যে, তারা মুসলমান? ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়াই তাদের মূল অপরাধ? ভারত তাহলে ছেড়ে দিক তাদের; ছেড়ে দিক তাদের উপত্যকা! কিন্তু না, এটা হওয়ার নয়৷ এটা হবেও না৷ কারণ, কাশ্মিরী মুসলিম নয়, ভারতের চাই মুসলিমমুক্ত কাশ্মীর!
আরআর