মূল বয়ান : মাওলানা আহমদ লাট
ভাষান্তর : মাওলানা ওমর ফারুক
টঙ্গী ময়দান থেকে শ্রুতিলিখন মিযানুর রহমান জামীল
মুহতারাম দোস্ত বুযুর্গ! আল্লাহ তাআলার প্রসংশা এবং রাসূলের উপর দুরুদ পাঠের পর মেহমান বলেন যে- প্রত্যেক মাখলুক আল্লাহ তাআলার কাছে নিজের পরিবারের সদস্যের মতো। যেমনিভাবে দুনিয়ায় নিজ গোত্রের লোকদের প্রতি মানুষের টান থাকে ভালোবাসা থাকে, তেমনি আল্লাহ তাআলারও মানুষের প্রতি ঐরকম টান রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করে কেবল তার অবস্থার উপর ছেড়ে দেননি; বরং তিনি তাদের জন্য বিধান আরোপ করে দিয়েছেন। এমন না যে, তিনি তাদের চোখ, মুখ, হাত-পা’কে তাদের জন্য আপন অবস্থার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি তাদের জন্য আসমান থেকে কিতাব নাজিল করেছেন এবং আম্বিয়াদের নমুনা ও মডেল হিসেবে পাঠিয়েছেন।
আসমানী কিতাবগুলো যাতে জানতে ও বুঝতে পারে সে জন্য তিনি নবী রাসূল পাঠিয়ে সবার জন্য দীনকে বুঝানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
মুহতারাম দোস্ত বুযুর্গ! আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে মানুষ ব্যতিত এরকম হাজারো প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। যাদের চোখ-পা সবই সুস্থ কিন্তু তাদের হৃদপিনণ্ড ঠিক নেই। এর দ্বারা মাকসাদ হলো- তিনি তাদের এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন, যেমন কারো কান আছে; তবে শুনার মধ্যে কমতি। মুখ আছে খাবারের মধ্যে কমতি। নাক আছে ঘ্রাণের মধ্যে কমতি। চোখ আছে দেখার মধ্যে কমতি।
যেমন অঙ্গের ব্যবহার হৃদপিণ্ড। মানুষের অঙ্গের অবস্থা হৃদপিণ্ডের ওপর। যদি তাদের হৃদপিন্ড ঠিক থাকে; তবে তারা সর্বত্রই সুখে শান্তিতে বসবাস করতে সক্ষম হবে।
মুহতারাম দোস্ত বুযুর্গ! আল্লাহ এটা বুঝাতে চান যে, তুমি স্বাধীন নও, তোমাকে দেয়া হয়েছে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। এগুলো কয়েক দিনের জন্য তোমার কাছে আমানত রাখা হয়েছে। আল্লাহ দেখছেন তুমি সেগুলো কীভাবে ব্যবহার করো?
মায়ের গর্ভ থেকে আসা আর মৃত্যুর মাধ্যমে কবরে চলে যাওয়া, তুমি এটাকে এমন ভেবো না যে এখানেই শেষ, অথচ এটা ভুল। আল্লাহ দেখতে চাচ্ছেন- কে কীভাবে নিজের জীবন পরিচালিত করছে? যদি তোমরা ভেবে থাকো আমার কাছে আসতে হবে না; তবে এ সিদ্ধান্ত ভুল।
মুহতারাম দোস্ত বুযুর্গ! হে আদম ও হাওয়ার সন্তানরা! যাতে মানুষ ভুলে না যায়- আল্লাহকে কীভাবে জানবো, কীভাবে বুঝবো! আল্লাহ তো নিজেই নিজের পরিচয় দিচ্ছেন- তোমার ইলাহ একজন, ঐ মাবুদ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। এমনটা ভেবে ভয় পেও না যে, তিনি না জানি কিছু করে ফেলবেন! না; বরং তিনি অত্যন্ত দয়ালু।
শুন আমি কে? আসমানকে তোমাদের উপর টাঙ্গিয়ে দিয়েছি। জমীনকে বিছিয়ে দিয়েছি তোমাদের জন্য। আর সেখানে পাহাড়কে পেরেক হিসেবে স্থাপন করে দিয়েছি। এগুলো তৈরি করে তিনি তাঁর পরিচয় দিচ্ছেন, তিনি কত ক্ষমতাবান, কত শক্তিশালী।
মুহতারাম দোস্ত বুযুর্গ! আল্লাহ সবকিছু জোড়া জোড়া দিয়ে বানিয়েছেন। যেমন সুখকে দুঃখের সাথে, শান্তিকে অশান্তির সাথে, কষ্টকে সুখের সাথে জোড়া দিয়ে বানিয়েছেন। যে মহিলা, সে পুরুষ নয়, সুখ আছে যার, তার কোনো কষ্ট নেই, হাসি আছে যার, তার কোনো কান্না নেই। সুস্থ ব্যক্তির দিন অসুস্থ ব্যক্তির দিনের মতো নয়।
সুস্থ ব্যক্তির চলা-ফেরা অসুস্থ ব্যক্তির চলা-ফেরার মতো নয়। এগুলো দিয়ে তিনি দেখতে চান, কে তার জান-মালকে দীনের জন্য কীভাবে ব্যয় করে? অথচ যার যা খুশি করে যাচ্ছে, এটা দেখেই তো আল্লাহ ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করবেন। তিনি গাছ-পালা নদী-নালা, জীব-জানোয়ার সৃষ্টি করে বলেন- এসব কিছু আমি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছি, আর তোমাদের সৃষ্টি করেছি আমার ইবাদতের জন্য।
আল্লাহর পক্ষ থেকে যে হুকুম করা হয়েছে, সেই হুকুম মেনে আল্লাহর দিকে দৌড়ানোর জন্যই আমাদের বানিয়েছেন। যদি তুমি আল্লাহর জন্য দৌড়াও; তবে তোমার সবকিছু সুন্দর হয়ে যাবে। এসব দিয়েই তিনি আসমান থেকে কিতাব নাযিল করেছেন এবং মডেল হিসেবে পাঠিয়েছেন নবী-রাসূল।
মুহতারাম দোস্ত বুযুর্গ! আমি যদি আমাকে গড়তে না পারি তাহলে আমার মৃত্যু, কবর, হাশর হবে অত্যন্ত কঠিন। চাই আমি ধনী হই বা গরীব হই, পুরুষ হই বা মহিলা হই, হাকীম হই বা জনগন হই, শহরের হই বা গ্রামের হই, সর্ব প্রথম আমাকে আমার দীন শিখতে হবে। কারণ আমরা প্রত্যেকেই আল্লাহর নিযুক্ত খলিফা। এ কাজ সর্বপ্রথম আমাদের করতে হবে।
জীব-জানোয়ার এবং মানুষ এ দুটোই আল্লাহর সৃষ্টি। মানুষের মধ্যে দীন ও দীনের বিধান আছে কিন্তু জানোয়ারের মধ্যে কোনো দীন নেই এবং কোনো বিধানও নেই। সে যা করে তার কোনো বাচ-বিচার নেই। সব ব্যাপারে সে স্বাধীন। কিন্তু মানুষ এর ব্যতিক্রম। পার্থক্য হবে মানুষ আল্লাহর যত বেশি অনুসারী হবে তত বেশি তার এবং জীব-জানোয়ারের মধ্যে পার্থক্য বাড়তে থাকবে। কারণ মানুষের জীবন চলা ও নিময়-নীতি এক কথায় খানা-পিনা সব ক্ষেত্রে জীব-জন্তুর থেকে আলাদা হতে হবে।
মুহতারাম দোস্ত বুযুর্গ! দীনের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর নৈকট্য। আর এতে আল্লাহর সাহায্য আসবে। অন্যায়-অবিচার থাকবে না। যদি কোনো বাচ-বিচার ছাড়া মানুষ গরু-ছাগলের মতো হালাল-হারাম সবকিছু পেটে ঢুকানো থাকে; তবে তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো ধরণের সাহায্য আসবে না।
হযরতজী মাওলানা ইউসুফ রহ. বলেন- দুনিয়ায় তিন প্রকারের জীবজন্তু রয়েছে। এক রকমের জীব হলো- নিজের পেট নিয়ে নিজে ব্যস্ত থাকে। যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা। তারা নিজের পেট ভরায় ব্যস্ত থাকে। অন্য জানোয়ার কি খেল আর না খেলো সেটা তারা চিন্তাও করে না। ঠিক এমন কিছু মানুষও আছে যারা নিজের পেট ভরায় ব্যস্ত থাকে। চাই সে যেই হোক। এরকম ব্যক্তি পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট।
মুহতারাম দোস্ত বুযুর্গ! দ্বিতীয় প্রকার হলো- এমন কিছু জানোয়ার আছে, যারা অন্যের ক্ষতি করে হলেও নিজেদের পেট ভরার চিন্তায় বিভোর থাকে। যেমন বাঘ-ভল্লুক। যাদের চিন্তা হলো- অন্যের ক্ষতি করে হলেও নিজের পেট ভরতে হবে।
কিছু মানুষ এমন আছে- যারা জানোয়ারের চেয়েও হিংস্র। জুলুমের মাধ্যমে এতীমের মাল আত্মসাৎ করে থাকে। সরকারি মাল লুটপাট করে থাকে। উদ্দেশ্য হলো- নিজের পেট। তাদের উদ্দেশ্য- সম্পদ কম আছে, এজন্য বাড়াতে জবে। তাদের ধারণা- সম্পদ বেশি হলে সম্মানও বেশি হবে। ক্ষমতা হবে। সবাই তাকে ভয় করবে। এলাকায় বাঘ না থাকলেও তাদের ভয়ে মানুষ বাঘের কথাও ভুলে যায়। এরা মানব জাতির জন্য বেশি ক্ষতিকর।
মুহতারাম দোস্ত বুযুর্গ! আরেক প্রকার জানোয়ার আছে- নিজের কোনো ধরণের লাভ ছাড়াই অন্যের ক্ষতি করে। যেমন সাপ-বিচ্ছু। ছোবল দিলে তার কোনো লাভ হয় না; বরং অন্যের ক্ষতি করে সে ক্ষ্যন্ত হয়। এটা তার স্বভাব। দীন না থাকলেও মানুষ জীব-জানোয়ারের চেয়ে নিকৃষ্ট হয়ে যায়।
আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলদের এ বুনিয়াদের উপর পাঠিয়েছেন- তাদের সকলের উদ্দেশ্য হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। আজ সবকিছু থেকে আমরা ব্যতিক্রম হয়ে গেছি, স্বাধীন হয়ে গেছি। আমরা আল্লাহকে ভুলে গেলেও আল্লাহ কিন্তু আমাদের ভুলেননি।
যখন মানুষ তিন প্রকার পশুর মতো হয়ে যায় তখন আল্লাহ তাআলা তাদের হঠাৎ হঠাৎ ধাক্কা দেন। ঝড়-তুফান, জলোচ্ছাস, ভূমিকম্প, সাইক্লোন দিয়ে সতর্ক করেন। কুরআনের বর্ণনা হলো- এগুলো মানুষের হাতের কামাই। কারণ সৃষ্টির পর থেকে মানুষের কর্ম ও হুকুম বণ্টন করে দেয়া হয়। সর্বপ্রথম হলো আল্লাহর হক।
এটা হলো- মানুষকে আগে তার পরিচয় প্রদান করা, তাকে চেনানো। এটা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। এটা না থাকায় সারা দুনিয়া জুলুমের কুণ্ডলির মতো হয়ে গেছে।
মুহতারাম দোস্ত বুযুর্গ! একদিন হুজুর সা. সাহাবাদের উদ্দেশ্যে ফজরের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত বয়ান করেন। আদম আ. থেকে শুরু করে তিনি তাঁর অবস্থা পর্যন্ত আসলেন। কেয়ামতের আলামতের বর্ণনা দিতে থাকলেন।
এমন সময় তিনি বলেন- তখন তাদের উদ্দেশ্য হবে পেট। মূল লক্ষ্য হবে- সঞ্চয় বা জমা। এটা হুজুর সা. বলে গেছেন। সারা দুনিয়ায় এখন সম্পদ অর্জনের স্লোগান লেগে গেছে। ঐ তিন প্রকার জানোয়ারের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ তিনি বলে গেছেন- ইসলামের বুনিয়াদ পাঁচ জিনিসের উপর।
ফাযায়েলে আমাল, ফাযায়েলে সাদাকাত, হেকায়েতে সাহাবা এগুলো হলো- এক একটা এক্স-রে মেশিন। এগুলোর মধ্যে মানুষের রোগের আসল রূপটা ধরা পড়ে। এগুলো কারো সাথে বন্ধুত্বের আচরণ করে না। বাস্তব কথা বলে দেয়।
ঠিক তেমনি ফাযায়েলে আমালসহ কিতাবগুলো পড়লে নিজেদের ভুলগুলো ধরা পড়তে থাকবে। এতে মানুষের সামনে আল্লাহর পরিচয় ফুটে উঠবে। এটাই ঈমানের বুনিয়াদ।
হযরতজী মাওলানা ইলিয়াস রহ. বলতেন- ইমামরাও বের হও! মুযাজ্জিনরাও বের হও! তিনি বলেন- আমি চাই উম্মতের সব মানুষ যাতে রাসূলের ইন্তেকালের সময় সাহাবাদের অবস্থায় ফিরে আসে।
এজন্য যখন মানুষ এবং পশুর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হবে তখনই দুনিয়া শান্তিতে ভরে উঠবে।
আরআর
[একুশে বইমেলায় প্রকাশ হয়েছে রোকন রাইয়ানের গল্পগ্রন্থ ভ্যারাইটিজ স্টোর। পাওয়া যাবে সাহসের স্টল ৩১৩ তে। আজই সংগ্রহ করুন]