আমার ভাই ও বন্ধুগণ! আমার আখেরী নসীহত এটাই যে, আল্লাহর দরবারে বিনয়-কাতর প্রার্থণা ও দোয়া-মোনাজাত, যা প্রকৃতপক্ষে রাসুল সা. এর বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্য, সেটাকে আপনারা নিজেদের জীবনে আঁকড়ে ধরুন। নিয়মিত দোয়া ও মুনাজাত করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
আল্লাহ তায়ালার দান ও দয়ার প্রতি পূর্ণ ভরসা রেখে পূর্ণ বিনয়ের সঙ্গে প্রার্থনা করুন। নিজের সকল প্রয়ােজন তারই কাছে নিবেদন করুন, হােক তা দুনিয়ার প্রয়ােজনে।
জান্নাত প্রার্থণা করুন, জাহান্নাম থেকে নাজাতের প্রার্থণা করুন। ঈমান ও বিশ্বাস প্রার্থণা করুন। যাবতীয় আমল ও ইবাদতের তাওফীক প্রার্থনা করুন। ইলমে নববীর মীরাছ প্রার্থণা করুন।
আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি প্রেম ও আনুগত্য প্রার্থণা করুন। মােটকথা, জীবনে যা কিছু আপনার কাম্য ও কাঙ্ক্ষিত তা আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করুন এবং যা কিছু অপ্রিয় ও অনাকাক্ষিত তা থেকে আল্লাহর পানাহ প্রার্থনা করুন।
আর দোয়া ও মোনাজাতের ক্ষেত্রে বেশীর চেয়ে বেশী নবুয়তের পবিত্র যবানের পবিত্র আলফায অনুসরণ করুন। যাতে কবুলিয়াতের বেশী আশা করা যায়। আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র দাতা।
বড় থেকে বড় কোন পূর্ণতা ও যােগ্যতার ওপর এখনাও মােহর লাগিয়ে দেয়া হয়নি যে, আর কেউ তা পাবে না। এমন কোন ফায়সালা করা হয়নি যে, আমাদের পূর্ববর্তীদের যাকিছু দান করা হয়েছে তা আর কাউকে দান করা হবে না।
ইলমের যে স্তরে তারা ছিলেন; রূহানিয়াত ও আধ্যাত্মিকতার যে মাকামে তারা ছিলেন তা তাদের যুগেই শেষ হয়ে গেছে ? না তা নয়। আল্লাহর দান তখনকার জন্য যেমন ছিল, এখনকার জন্য তেমনি আছে:
তখনও মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়েছে, এখনও হয়, তখনও গাছে ফুল ফুটেছে, এখনও ফোটে, তখনও চাঁদের জোছনা ছিল, এখনও আছে, তখনও ভােরে সবুজ ঘাসের উপর শিশির ঝরেছে এখনও ঝরে।
ইলমের সাধনা তখন যেমন ছিল, এখনও যদি তেমন থাকে তাহলে কেন আমার কলবের শুলবাগে ফুটবে না ইলমের গােলাব?
ইমাম গাযযালী, ইমাম রাযী রহ. ও অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম আমাদের মাথার তাজ। তাদের ইলমের যাকাত গ্রহণ করেই আমরা আজ এতো ধনী। তাদের জ্ঞানের আলাে দ্বারাই আমাদের জ্ঞানের জগত আজ আলােকিত। এ সবই সত্য।
আমরা অবশ্যই তাদের ঋণ স্বীকার করি। কিন্তু আল্লাহর দান! তা তাে কোন যুগের সীমানায় আবদ্ধ নয়। সে যুগের রাযী, গাযযালী না হােক, অন্তত এখনাে পয়দা হতে পারে যামানার রাযী, গাযালী, যামানার কুরতুবী, তাহাবী এবং যামানার দেহলবী, কাশ্মীরী।
তদ্রুপ জোনায়েদ বাগদাদী, শায়েখ আবদুল কাদের জিলানী রহ. ও অন্যান্য আউলিয়ায়ে কেরাম। তারা আমাদের মহান পূর্ববর্তী। তারা আমাদের সারতাজ। তাদের পদধূলি গ্রহণ করেই আমরা আজ ধন্য।
তাদের রূহানিয়াত ও নুরানিয়াত থেকেই আমাদের কলবের জাহান আবাদ ও আলােকিত। এ সবই সত্য। তাদের এহসান ও অবদান অবশ্যই আমরা স্বীকার করি। স্বীকার করতেই হবে।
আল্লাহর ‘দান’ স্থান ও কালের কোন গণ্ডি তাঁর দানকে আটকে রাখতে পারে না! সে যুগের জোনায়েদ, জিলানী না হােক, অন্তত যামানার জোনায়েদ, জিলানী তাে পয়দা হতে পারে এখনও।
সুন্নাতুল্লাহ এই , যে কোন স্থানের এবং যে কোন যুগের মানুষ ইলমী ও রূহানী তরীর জন্য চেষ্টা-সাধনা করলে ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতের সঙ্গে মেহনত মুজাহাদা করলে, কামাল ও কামালিয়াত হাসিলের শর্তগুলাে পূরণ করলে এবং হক আদায় করে আল্লাহর কাছে সওয়াল করলে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তাকে ইলমী ও রূহানী মাকাম দান করবেন।
আল্লাহর দানে কোন কুণ্ঠা নেই, বান্দার গ্রহণে যদি কার্পণ্য না থাকে। হাদীস শরীফে এমন মায়মূনও এসেছে যে, এই উম্মত হলাে বৃষ্টির মত। কেউ বলতে পারে না যে, তার শুরুতে বেশী কল্যাণ, না শেষে!
অর্থাৎ সাধারণ অবস্থা এটাই যে, বিগত যুগ নবুয়তের দিকে নিকটবর্তী হওয়ার কারণে অধিকতর কল্যাণপূর্ণ, তবে খাছ খছভাবে পরবর্তী যুগের কল্যাণ পরবর্তী যুগের সমান, এমনকি বেশীও হতে পারে।
দাতা যখন দান করেন বাধা দেয়ার কেউ নেই। আবার দাতা যদি না দেন তাহলে পাওয়ার কোন উপায় নেই। তবে সে যুগে যেমন প্রত্যেক রাত্রের শেষভাগে আসমান থেকে ডাকা হতাে: আছে কি কোন মাগফেরাত তলবকারী, যাকে আমি মাফ করব?
যারা জায়নামাযে দাঁড়িয়েছেন এবং ভিখারী সেজে প্রার্থণা করেছেন তারা মাগফেরাত পেয়েছেন এবং আঁচল ভরে পেয়েছেন দান। এ যুগেও প্রতি রাতের শেষভাগে একইভাবে আসমানের ঘােষণা জারি আছে।
এখনও যারা শেষ রাতে জায়নামাযে দাঁড়াবে, দু'হাত তুলে কাকুতি-মিনতি করে ফরিয়াদ জানাবে, তারা আল্লাহর পক্ষ হতে মাগফিরাত লাভ করবে এবং তাদের উপর একইভাবে এবং আরও প্রবলভাবে, মুষলধারে আল্লাহর দান বর্ষিত হবে।
সুতরাং হে আমার প্রিয় ভাই, কেন তােমরা নিরাশ হবে? এ যুগেও তােমরা সবকিছুই হতে পারাে। আল্লাহর কাছ থেকে তােমরা ঐ সবকিছুই অর্জন করতে পারাে, যা আমাদের আসলাফ ও পূর্ববর্তীগণ অর্জন করেছেন।
শর্ত একটাই: তারা যে পথের পথিক ছিলেন, আমাদেরও হতে হবে সেই পথের পথিক। পথ চলার জন্য তারা যে পাথেয় গ্রহণ করেছিলেন, আমাদেরও গ্রহণ করতে হবে একই পাথেয়।
পথ ও পাথেয় যদি অভিন্ন হয়, ইনশাআল্লাহ মানযিলও হবে অভিন্ন। তবে তুর্কিস্থানের পথ ধরে সে যুগে যেমন কাবায় পৌঁছা সম্ভব হয়নি, এ যুগেও তা সম্ভব হবে না। হতে পারে না।
খােলাছা কথা; আমার পেয়ারে ভাই! দিলের দরদ-ব্যথার কারণে এবং ভাব ও আবেগের প্রবাহের কারণে কথা অনেক লম্বা হয়েছে, তবে এই লম্বা বয়ানের খােলাছা খুবই মুখতাছার। আর তা এই যে, প্ৰথমত আপনারা নিজেদের চিনুন। নিজেদের মাকাম ও মর্তবা এবং অবস্থান ও মর্যাদা বুঝতে চেষ্টা করুন।
দ্বিতীয়ত; ইলমের তলবে নিজেদের ফানা করে দিন। সত্যিকার মজনুরূপে লায়লা ইলম'কে হাসিল করার চেষ্টা করুন।
তৃতীয়ত; তায়াল্লুক মায়াল্লাহ পয়দা করুন। তাকওয়া ও আল্লাহ-ভীতির মাকাম হাসিল করুন। তা হবে একনিষ্ঠ ইবাদতের মাধ্যমে। রূহানিয়াত ও নূরানিয়াতপূর্ণ নামায ও তিলাওয়াতের মাধ্যমে। |
চতুর্থত; গােনাহের খাবাছাত ও গান্দেগি থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করুন এবং তাওবা ও ইসতিগফারের মাধ্যমে নিজেকে পাক-ছাফ রাখার চেষ্টা করুন।
পঞ্চমত; নবী সা. যেভাবে আল্লাহর দরবারে দোয়া-মোনাজাত করেছেন তার সামান্য পরিমাণ হলেও নিজেদের মধ্যে আনার চেষ্টা করুন। পরম দাতা ও পরম দয়ালু আল্লাহ তাআলার দান ও দয়ার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে ভিখারী সেজে আল্লাহর কাছে চাইতে থাকুন।
তারপর দেখুন আল্লাহ তায়ালা আপনাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করেন! আল্লাহর ওয়াদা এই যে, বান্দা যদি আল্লাহর দিকে এক বিঘত আগে বাড়ে, আল্লাহ বান্দার দিকে একহাত আগে বাড়েন।
আর বান্দা যদি আল্লাহর দিকে হেঁটে হেঁটে অগ্রসর হয়, আল্লাহ তায়ালা বান্দার প্রতি দৌড়ে অগ্রসর হােন। আল্লাহর ওয়াদা চিরসত্য।
আমার পেয়ারে ভাই! এ পর্যন্ত যে সকল নসীহত আপনাদের খেদমতে আরয করেছি তা প্রথমত আমার নিজের জন্য। তারপর আপনাদের জন্য। আল্লাহ তাআলা আমাকে এবং আপনাদের সবাইকে এই কথাগুলাের ওপর পূর্ণ আমল করার তাওফীক দান করুন, আমীন।
কিয়ামতের দিন এ কারণে যেন আমার পাকড়াও না হয় যে, মানুষকে তাে ভালাে ভালাে নসীহত করেছ এবং সুন্দর সুন্দর উপদেশ দিয়েছে, কিন্তু নিজে তার উপর আমল করােনি।
তদ্রুপ আপনারা যেন এ কারণে ধৃত না হন যে, তােমাদের কাছে তাে কল্যাণের বাণী পৌঁছানাে হয়েছিল, তােমরা তা গ্রহণ করােনি কেন?
কুরআন-কারীমে আল্লাহ তায়ালা বলেন: সুতরাং আপনি আমার বান্দাদের খােশখবর দিন, যারা মনযােগের সঙ্গে কথা শােনে এবং উত্তম অংশকে অনুসরণ করে। ওরাই এমন লােক যাদের আল্লাহ তাআলা হিদায়াত দান করেছেন এবং তারাই জ্ঞানের অধিকারী। (সূরা যুমার ১৭-১৮)
আমার পেয়ারে ভাই, বিদায়! হয়ত আবার দেখা হবে, হয়ত আবার নাও হতে পারে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে জান্নাতে একত্র করেন, আমীন। ওয়া আখিরু দাওয়ানা আনিল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন।
সূত্র: মুফতি আব্দুল মালেক ও মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ্ অনূদিত মাওলানা মনযূর নোমান রহ. রচিত ‘তালিবানে ইলেমের রাহে মাঞ্জিল’ গ্রন্থ থেকে।
রোকন হারুন