উবায়দুল্লাহ সাদ
আওয়ার ইসলাম
কমিটির সেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের কারণে ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী কওমী মাদরাসা জামিয়া ইসলামিয়া অনিদ্রষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে ছাত্ররা।
গত ৯ ডিসেম্বর মাদরাসার ছাত্ররা আগের মুহতামিম মাওলানা আনোয়ারুল হককে ফেরানোর দাবি জানিয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য মাদরাসা বন্ধ করে চলে যায়। বিষয়টির সুরাহা না হলে তারা মাদরাসায় ফিরবেন না বলেও জানা গেছে।
ময়মনসিংহের ব্যস্ত এলাকা চরপাড়া মোড়ে ১৯৪২ খৃষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত জামিয়া ইসলামিয়া দেশের একটি উল্লেখযোগ্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। আল্লামা আতহার আলী রহ. এর হাতে গড়া এ জামিয়া থেকে অসংখ্য ইলম পিপাসু ইলম আহরণ করে সারা বিশ্বে আলো ছড়াচ্ছে। এ জামিয়া দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলনেও ভূমিকা রেখেছে অপরিসীম।
কিন্তু শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, গত ৭ বছর ধরে সুষ্ঠ পরিচালনার অভাবে জামিয়া তার পুরোনো ঐতিহ্য ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে। লেখাপড়া ও তরবিয়তের ময়দানে এ মাদরাসা যেভাবে একদিন সুনাম ও সুখ্যাতির শিখড়ে ছিল তা ভাটা পড়ছে ক্রমেই। ছাত্র সংখ্যাও দিন দিন কমতে শুরু করেছে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য গত দেড় মাস আগে মাদরাসার কার্যকরি কমিটি বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম মাওলানা শওকত আলীকে অব্যহতি দিয়ে ঢাকার যাত্রাবাড়ীর বড় মাদরাসার নায়েবে মুহতমিম মাওলানা আনোয়ারুল হককে মাদরাসার মুহতামিম হিসেবে নিয়োগ দেন।
মাওলানা আনোয়ারুল হক ঢাকার যাত্রাবাড়ী মাদরাসা থেকে বিদায় নিয়ে গত ১ নভেম্বর জামিয়া ইসলামিয়ায় প্রিন্সিপাল হিসাবে যোগদান করেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি ছাত্রদের সঙ্গে মাদরাসার নানা বিষয়ে আলোচনা করেন। একই সঙ্গে তিনি মাদরাসার সুনাম ফিরিয়ে আনতে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের তিন দিনের মাথায় রহস্যজনক কারণে মাওলানা আনোয়ারুল হককে তার নিয়োগ অবৈধ দাবি করে অব্যহতি দেন মাদরাসা কমিটির সাধারন সম্পাদক আশরাফ এবং পুনরায় সাবেক ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম মাওলানা শওকত আলীকে দায়িত্ব দেন।
জানা যায়, রহস্যজনক কারণে মাওলানা আনোয়ারুল হককে অব্যহতি দেয়ায় ক্ষিপ্ত হয় শিক্ষার্থীরা। গত নভেম্বর মাসজুড়ে বিভিন্নভাবে এর প্রতিবাদ জানায় তারা।
মাদরাসার একাধিক ছাত্র এ প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘আনোয়ার সাহেবকে দায়িত্ব দেওয়ার তিন দিনের মাথায় সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে মাদরাসা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। আমাদের একজন উস্তাদ কমিটি কর্তৃক অপমাণিত হবে আর আমরা বসে থাকব তা হতে পারে না।’
তারা বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত হুজুরকে সসম্মানে ফিরিয়ে এনে দায়িত্ব দেওয়া না হবে ততক্ষণ আমরা মাদরাসায় ফিরবো না।
জামিয়া ইসলামিয়ার দাওরায়ে হাদিস ও ইফতা বিভাগের একাধিক ছাত্র আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মাওলানা আনোয়ারুল হক চলে যাওয়ার পর আমরা এর সমাধানের জন্যে প্রথমে মাদরাসাটির সভাপতি মাওলানা আবদুর রহমান হাফেজ্জীর কাছে যাই। তিনি আমাদের বলেন, মিটিংয়ের মাধ্যমে সমাধান করা হবে। কিন্তু কার্যত কোনো মিটিং এখন পর্যন্ত হয়নি।
পরে মাদরাসা ছাত্রদের একটি প্রতিনিধি কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসাইনের সাথে দেখা করে দাবি তুলে ধরলে তিনি ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সময় চান। কিন্তু ২৮ নভেম্বর কোনো সমাধান না হওয়ায় ছাত্ররা আবারও আন্দোলন শুরু করলে আশরাফ হোসাইন আবারও ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নেন।
কিন্তু ৭ ডিসেম্বর সমাধান না হওয়ায় ছাত্ররা মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করে। গত ৯ ডিসেম্বর থেকে মাদরাসার সকল বিভাগ বন্ধ রয়েছে।
জানা যায়, ৯ ডিসেম্বর সকালে ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে মাঠে অবস্থান নেয়। ছাত্ররা ‘আমাদের দাবি মানতে হবে, আনোয়ারুল হককে ফেরাতে হবে’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দিতে মাদরাসা থেকে বের হয়ে যান।
অভিযোগের সত্যতা জানতে জামিয়া ইসলামিয়ার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম মাওলানা শওকত আলীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আওয়ার ইসলামের কাছে এর সত্যতা স্বীকার করেছেন।
নিয়োগের তিন দিনের মাথায় মাওলানা আনোয়ার কেন চলে গেলেন এমন প্রশ্নে তিনি আওয়ার ইসলামকে জানান মাদরাসার সাধারণ সম্পাদক তাকে চলে যেতে বলেছেন। এ কারণে চলে গেছেন।
তবে কী কারণে চলে যেতে বলেছেন সে প্রশ্ন করলে তিনি সাধারণ সম্পাদকের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।
মাদরাসার সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসাইনের সাথে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে মাওলানা আনোয়ারুল হকের কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, মাদরাসার সাধারণ সম্পাদক আমাকে বলেছেন আপনার কাগজ-পত্র আমরা রেডি করি নাই, তাই আপনার থাকাটা সমিচিন না।
তবে কাগজ পত্র নিয়ে মাওলানা আনোয়ারুল হক বলেন, আমাকে মাদরাসার সভাপতি মাওলানা আবদুর রহমান হাফেজ্জী হুজুর লিখিত দিয়েছিলেন। তার লিখিত পেয়েই আমি গত ১ নভেম্বর জামিয়া ইসলামিয়ায় যোগ দিয়েছিলাম।
জামিয়া ইসলামিয়া থেকে চলে আসার পর কমিটির কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি বলেও জানান তিনি।
মাদরাসায় চলমান সমস্যার কারণ জানতে কার্যনির্বাহী কমিটির কোষাধ্যক্ষ ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুর রহমানকে কল দিলে তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, মূলত আমাদের কমিটির সিন্ধান্তহীনতার কারণেই এমনটা হয়েছে। তবে শিক্ষকদেরও কিছু সমস্যা আছে।
লিখিত দায়িত্ব পাওয়ার পরও কেন সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আনোয়ারুল হককে বিদায় করলে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখানে আমাদের কিছুটা ভুল বুঝাবুঝি আছে। আজ কমিটির মিটিংয়ে সেটা সমাধান হবে বলে আশা করছি।
বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মুহতামিমের দিকে অনেকেই অভিযোগ তুলছেন এটার সত্যতা কতটুকু? জানতে চাইলে তিনি বলেন, উনারা আলেম মানুষ, উনাদের সরাসরি দোষারোপ উচিৎ না। তবে যে ধরনের আলামত পাওয়া যায় সন্দেহের তীর কিছুটা ওদিকে যায়।
‘আসলে আমরা যারা কমিটির দায়িত্বশীল তারা খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতে আছি। আশা করছি আজকের কমিটির মিটিংয়ে ছাত্ররা যেন ক্লাসে ফিরতে পারে এ ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি হবে’। এমন আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
দেশের প্রাচীন এ প্রতিষ্ঠান এমন অভিযোগে বন্ধ থাকায় ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুর রহমানও দুঃখ প্রকাশ করেন।
‘ধর্মীয় বিষয়ে আলেমদের অনুসরণের বিকল্প নেই’
আরআর