শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
কাল যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন: মজলিস মহাসচিব ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল

মাওলানা সামিউল হক কে ছিলেন?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আবদুল্লাহ তামিম
আওয়ার ইসলাম

অনেক বছর ধরে তালেবান ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যস্থতায় যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনিই হলেন মাওলানা সামিউল হক। যাকে গোটা বিশ্বে ‘ফাদার অব তালেবান’ হিসেবে জানে।

১৯৩৭ সালের দিকে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের তালেবানদের ইতিহাস বলতে গেলে তার কথা অবশ্যই উঠে আসবে। মাওলানা সামিউল হক পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের আফগানিস্তান সীমান্তের কাছে দারুল উলুম হাক্কানিয়া মাদরাসার পরিচালক ছিলেন।

তাকে তালেবান আন্দোলনের প্রধান নেপথ্য পুরুষ হিসেবেও গণ্য করা হয়। কারণ এ আন্দোলনের প্রথম সারির নেতাদের শিক্ষক ছিলেন তিনি।

তার ছাত্রদের মধ্যে প্রসিদ্ধ একজন ছিলেন তালেবান নেতা মোল্লা ওমর। পাকিস্তানে তালেবান আন্দোলনের সঙ্গে তার সম্পর্ক সত্ত্বেও তিনি যে মাদরাসা পরিচালনা করতেন সরকার তাতে কো ধরনের হস্তক্ষেপ করেনি কোনো দিন। শুধু তাই নয় এ  দারুল উলুম হাক্কানিয়া মাদরাসায় পাকিস্তানের আঞ্চলিক সরকার অর্থও বরাদ্দ করতো।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সামিউল হকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বলেছেন, পাকিস্তান এক গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি নেতাকে হারিয়েছে। এ শূন্যতা পূরণীয় নয়।

মৃত্যুর একদিন আগে মাওলানা সামিউল হক খাইবার পাখতুনখোয়া এর চরসাদ্দা জেলার টঙ্গি অঞ্চলে একটি সম্মেলনে তার শেষ বক্তৃতা করেছিলেন।

সেখানে উপস্থিত তার ছাত্র ও অনুসারিদের তিনি জিহাদের ওপর বায়াত করেছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাদের যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

৮১ বছরের এ মহান নেতা ও বিশিষ্ট আলেম দারুল উলুম হক্কানিয়ার প্রধান ছিলেন। মাওলানা সামিউল হক পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতা  ও পাকিস্তান সিনেটের সাবেক সদস্যও ছিলেন।

শেষ বয়সে তার জনপ্রিয়তা আরো বেশি হয়ে ওঠেছিলো। রাজনৈতিক ও মতাদর্শগতভাবে বিভিন্ন ইসলামি কাজে সক্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।

রক্ষণশীল ইসলামিক রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে মতাদর্শের দিক দিয়ে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল তিনি একজন শিক্ষক। দারুল উলুম হাক্কানিয়ার প্রিন্সিপাল। বহু ছাত্র তৈরি করে গেছেন তিনি। হাজার হাজার তালিবে ইলম তার মাদরাসা থেকে ইলম অর্জন করেছেন।

১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দারুল উলূম হক্কানিয়া। একে মানুষ ‘জিহাদ বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবেই বেশি চিনে।

মাওলানা সামিউল হক এটি পরিচালনা করতেন। তিনি ৪০টির বেশি সংগঠনের জোট দিফা-ই-পাকিস্তান কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। নিষিদ্ধ সংগঠন সিপাহ-ই-সাহেবা ও হাফিজ সাঈদ নেতৃত্বাধীন জামাত-উদ-দাওয়া (জেইউডি) এই জোটেরও সদস্য ছিলেন বলে জানা যায় এনডিটিভির সূত্রে।

তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন মাওলানা আবদুল হক রহ. থেকে। আফগানিস্তানে রাশিয়ান হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যিনি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন।

আফগানিস্তানের বহু ছাত্র দারুল উলূম হক্কানিয়াতে পড়তে আসতো। তাদের নামের শেষে হাক্কনি যুক্ত করা হয়। এখনো মাদরাসাটিতে বহু ছাত্র আছে আফগানিস্তানের।

আফগান তালেবানদের অন্যতম নেতা আমির খান মক্কি, মাওলানা আহমদ জং, মোল্লা খায়রুল্লাহ খায়ের এ মাদরাসারই ছাত্র। হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা জালালুদ্দীন হাক্কানি কিছুদিন আগে মারা গেছেন। তিনিও এ মাদরাসার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন।

২০০৩ সালে যখন রাশিয়ার হুমকি আসে তখন মাওলানা সামিউল হক আফগানিস্তানে তার ছাত্রদেরকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে কড়া বক্তৃতা করেন।

পশতুতে তার বক্তৃতায় তিনি বলেন, অতীতে কেবলমাত্র ইসলামের অবসান ঘটানোর জন্য হুমকি এসেছিলো এখন হুমকি এসেছে মুসলিম ও ইসলাম, মসজিদ ও মাদরাসাকে বিলিন করে দিতে। তাই আমাদের মুকাবিলা করতে হবে।

অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র দিয়ে মুকাবিলা করতে হবে। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাশিয়ার মত পরাশক্তির বিরুদ্ধে তালেবানরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো।

আফগানিস্তানে রাশিয়ান হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সংস্থার সাহায্যের প্রয়োজন হলে মাওলানা সামিউল হক এর পরামর্শে পাকিস্তানের তালেবানরা তাদের সহযোগিতা করেছিলো। রাজনৈতিক দূরদর্শিতার জন্যে সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হকের সাথেও তার ভালো সম্পর্ক ছিল।

মওলানা সামিউল হকের বক্তৃতা ছিলো চমৎকার। মানুষ তার বক্তৃতা শুনার জন্য ভিড় করতো। মঞ্চে ওঠলে তাকে আর চেনা যেতো না। তার চেতনা আর ধারালো বক্তৃতায় পাগল হয়ে যেতো মানুষ।

মতাদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তিনি বিবিসি রেডিওতে ধারাবাহিকভাবে অংশ গ্রহণ করতেন। বিভিন্ন বিষয়ে জাতীয় পরিষদের হামিদ হকের মাধ্য নিয়মিত সংবাদ বা বক্তব্য পাঠাতেন।

২০১৩ সালে পোলিও ভ্যাকসিনের সমর্থনে মাওলানা সামিউল হকও ফতোয়া জারি করেছেন। পাকিস্তানে নিষিদ্ধ তেহরিক-ই-তালেবান ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে আলোচনার জন্য নেহরু একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মুফতি নাঈম তাকে সরকার ও তালেবানের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন বলে উল্লেখ করেছেন।

তেহরিক-ই-তালেবান ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে আলোচনা আরো লাভজনক করার লক্ষ্যে কাজ চলছিলো। এ আলোচনা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই মাওলানা সামিউল হক চলে গেলেন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় তালেবানদের সঙ্গে প্রস্তাবিত আলোচনার যে মিশন শুরু হয়েছিলো সেটিরও নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা সামিউল হক।

তার মৃত্যুতে পাকিস্তানের বড় বড় ব্যাক্তিবর্গ শোক প্রকাশ করেছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেন, নিসন্দেহে পাকিস্তান একজন গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় নেতা হারিয়েছে। মাওলানা সামিউল হকের ত্যাগ ও অবদান মানুষ সবসময় স্মরণ রাখবে। মাওলানা সামিউল হকের ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রধান মাওলানা ফজলুর রহমান বলেন, আমি তার মাদরাসা দারুল উলুম হক্কানিয়াতে ৮ বছর পড়াশোনা করেছি। তিনি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। আমি তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বলেন, দেশের একজন বিশিষ্ট আলেমের এভাবে শহিদ হওয়া বড়ই দুঃখের বিষয়। এর উপযুক্ত বিচার হওয়া দরকার।

মাওলানা সামিউল হকের ছেলে মাওলানা হামিদুল হক জানান, মরহুমের মৃতদেহ এম্বুলেন্সে করে তার জন্মস্থান খাইবার পাখতুনখোয়ার নওশেরা জেলায় নেওয়া হয়েছে। সেখানেই তার জানাজা শেষে দাফন করা হবে।

উল্লেখ্য, গত শুক্রবার ২ নভেম্বর নিজ বাসায় আততায়ী কর্তৃক ছুড়িকাঘাত ও গুলিবিদ্ধ করে নির্মমভাবে শহিদ করা হয়। তার ছেলে মাওলানা হামিদুল হক জানান, ড্রাইভার ও দেহরক্ষী ঘর থেকে বের হওয়ার পরই এ ঘটনা ঘটে। মৃত্যুর সময় মাওলানা সামিউল হকের বয়স ছিলো ৮২ বছর।

মাওলানা সামিউল হকের মৃত্যুর কারণে আফগানিস্তানের সাথে তালেবানদের সুসম্পর্কের একটি প্রধান প্রধান অধ্যাযয়ের অবসান হয়েছে।

বিবিসি উর্দূ থেকে আবদুল্লাহ তামিমের অনুবাদ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ