কয়েক যুগ আন্দোলনের পর সরকারস্বীকৃত হয়েছে কওমি মাদরাসা সনদ। পূরণ হয়েছে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন। এ নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। শুরু হয়েছে বিরোধিতাও। তবে উলামায়ে কেরাম বলছেন এখন পেছনে চিন্তার সুযোগ নেই, এগিয়ে যেতে হবে সম্ভাবনাকে সামনে রেখে।
কওমি স্বীকৃতির ইতিহাস, ছাত্রদের এগিয়ে যাওয়া, যাদের অবদানে এ স্বীকৃতি এসব নিয়ে কথা হয় জাতীয় দীনি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের সহসভাপতি ও জামিয়া ইসলামিয়া আযমিয়া বনশ্রী’র মুহতামিম মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ এর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মদ আসআদ।
আসআদ : কওমি মাদরাসার শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির দাবি থেকে সাফল্য কিভাবে এলো, ইতিহাসটা জানতে চাই?
মাওলানা ইয়াহয়া মাহমুদ : কওমী শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির সূচনা এর আলোচনা করলে প্রথমে স্বরণ করতে হয় আল্লামা আতহার আলী রহ. এর নাম। যিনি সর্ব প্রথম স্বীকৃতির আওয়াজ তুলে ছিলেন।
শায়খ নূরুদ্দিন গওহরপুরিসহ শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর নাম বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়। যিনি বিগত বিএনপি সহ চার দলীয় জোর সরকারের আমলে মুক্তাঙ্গনে এই দাবিতে পাঁচ দিন অবস্থান ধর্ম ঘট করে ছিলেন। তার পাশে কিছু সময় আমিও ছিলাম।
ওই আন্দোলনে সরকারের ভেতরে ইসলামী ঐক্য জোটের ওলামায়ে কেরামও ছিলেন। বিশেষ করে মরহুম মুফতি আমিনী এবং মাওলানা মুফতি ওয়াক্কাস। সে সময় চাপের মুখে জোট সরকার স্বীকৃতির ঘোষণা দেয়। গ্যাজেটও হয়।
কিন্ত পরবর্তীতে এটি আর আলোর মুখ দেখেনি। সরকারের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা জামাতের এজেন্ট এবং বেদাতি ও অন্যান্য কওমি বিদ্বেষীদের বিরোধিতার কারণে চাপা পড়ে যায়।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বর্তমান সরকার প্রথম টার্মে ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রীয় বাসভবন যমুনাতে ওলামায়ে কেরামদের নিয়ে দুটো বৈঠক করেন। এই দুটো বৈঠকেই আমি উপস্থিত ছিলাম।
আমার যতদূর মনে পড়ে প্রথম বৈঠকে প্রায় ২৫জন ওলাময়ে কেরামকে নিয়ে হয়েছিল। দ্বিতীয় বৈঠকেও শীর্ষ আলেমগণ উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.।
নানূপুরের পীর হযরত মাওলানা শাহ জমিরউদ্দীন রহ.সহ বর্তমান সারা বাংলার মুরব্বি আল্লামা আহমদ শফীসহ শীর্ষ ওলামায়ে কেরামও ছিলেন।
এভাবে স্বীকৃতির কাজ এগুতে থাকে। একটা সময় স্বীকৃতি দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেলেও হেফাজতের ইসলামের অনেক নেতা এর কঠোর বিরোধিতায় পিছিয়ে যায়।
কওমি মাদরাসা ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার – বিস্তারিত জানুন
এ কারণে একটা সময় স্বীকৃতি নিয়ে কোনো আলোচনা ছিল না। পরে মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদের একটি প্রোগ্রামে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা এক হয়ে আসুন স্বীকৃতি হবে। তখন থেকে আবার নতুন মাত্রা পায়।
এখানে অনেক ঘাত প্রতিঘাত পাড় হয়েছে। হাজি ক্যাম্পে একটা অফিসও নেয়া হয়েছিল। সেখানে কিছুদিন কাজ চলেছে। তখন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদকে নিয়ে অনেকের আপত্তি আসে, তিনি কমিশনে থাকলে অন্যরা আগাবে না।
অনেক সমালোচনা পাড় হয়ে শেষ পর্যন্ত সবার সম্মিলিত বৈঠক হলো হাটহাজারীতে। সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত গণভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতির ঘোষণা দিলেন।
আসআদ: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আলেমদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে আসতে বলেছিলেন, তো সবাই কি শেষ পর্যন্ত এক হতে পেরেছেন?
ইয়াহয়া মাহমুদ : স্বীকৃতি সকল আলেমের ঐক্যবদ্ধতায় হয়েছে। মোটাদাগে কোনো বিরোধ ছিল না।
এ ঐক্য সৃষ্টির জন্য মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদের অবদান রয়েছে। এ কথা ঘরোয়াভাবে স্পষ্টই বলেছেন, মুফতি ওয়াক্কাস সাহেব, মুফতি নূরুল ইসলাম সাহেব এবং লালবাগের মুফতি ফয়জুল্লা সাহেব।
আসআদ : ৪ দলীয় জোট সরকার আমলেও স্বীকৃতি প্রায় চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। ব্যর্থ হয়েছিল কেন?
ইয়াহয়া মাহমুদ : বিগত জোট সরকারের আমলে স্বীকৃতির ঘোষণা ছিল চাপের মুখে, আর এবার স্বীকৃতির ঘোষণা ছিল সরকারের আন্তরিকতাপূর্ণ সৎ ইচ্ছার কারণে। এ জন্য হয়তো তখন হয়ে ওঠেনি। আর সে সময় অনেকের বিরোধিতা তো ছিলই।
এ সরকার আমলেও তো চার দলীয় জোটে থাকা অনেকেই চেয়েছেন, এই সরকারের আমলে স্বীকৃতিটা না হোক, এই ক্রেডিট আওয়ামী লীগের ঝুলিতে না যাক।
কিন্তু আবহাওয়া যখন পালটে গেছে এবং প্রধানমন্ত্রী যখন ঘোষণা দিয়েছেন যতজন পারেন ততজন আসেন। তখন সবাই আবার পক্ষে এসে যান।
আসআদ : এবার যে বিল পাশ হয়েছে আপনি তো তার সূচনা লগ্নেই ছিলেন। সাফাল্যের এই মুহূর্তে কেমন লাগছে?
ইয়াহয়া মাহমুদ : হ্যাঁ, আমি খুবই আনন্দিত। আমি মনে করি, স্বাধীনতার পরে আওয়ামী লীগের সব থেকে বড় কাজ বা অবদান হল কওমি সনদের স্বীকৃতি সংসদে পাশ করা।
কারণ এটা এমন একটি কাজ, যার দ্বারা কওমি মাদরাসার ওলায়ে কেরাম পরিশুদ্ধ চিন্তাচেতনা ও ইখলাসের সঙ্গে সব জায়গায় যে খেদমত করতে চান তা অনেক ক্ষেত্রে দ্বাররুদ্ধ ছিল। এখন তাদের জন্য সে দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেছে।
এ জন্য আমি সত্যি সত্যি খুবই আনন্দিত। এতটা আশা ছিল না যে, এত দ্রুত আইনগত ভিত্তি পেয়ে যাবে। তবে একদিক দিয়ে আবার একটু আশঙ্কাও আছে। সেটা হল, جاء البرد والجبات ঠাণ্ডা যখন আসে শীতবস্ত্র নিয়ে আসে।
এরকম সরকারি স্বীকৃতি যখন আসে আবর্জনার আশঙ্কাও থাকে। এ মুহূর্তে আমাদের সাবধান থাকতে হবে এ স্বীকৃতির যে আবর্জনা আছে তা থেকে যেন আমাদের ছেলে মেয়েরা মুক্ত থাকতে পারে।
উলামায়ে কেরাম চেষ্টা করেছেন ফাঁক-ফোকর বন্ধ করার। এরপরও কিছু ফাঁক ফোকর থাকবেই। ওই ফাঁক গলে যেন অনাকাঙ্খিত কোনো কিছু না আসে সেদিকে আমাদের সজাগ সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
আসআদ : এবারের বিল পাশের জন্য আপনি কাকে বেশি স্মরণ করছেন?
ইয়াহয়া মাহমুদ : এ মুহূর্তে আমি বিশেষভাবে স্বরণ করছি মাননীয় জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি মনে করেন, কওমি অঙ্গেনের বিশ লাখ ছেলে মেয়ে যারা এখানে পড়াশোনা করে আমি তাদের অভিভাবক।
অভিভাবক হিসেবে নিজস্ব বিবেকের তাড়নায়, নিজের দায়বদ্ধতা থেকে তিনি এ কাজ করেছেন। মনে হয় তিনি কোন লোভ লালসায় করেননি। আমি এটা মনে করি।
আসআদ : একটা কঠিন প্রশ্ন। যে প্রশ্নটি বাতাসে খুব ঘুরছে। কওমি স্বীকৃতির দ্বারা কী হেফাজতের রক্তের দাগ মুছেবে?
ইয়াহয়া মাহমুদ : কওমি স্বীকৃতির দ্বারা হেফাজতের রক্তের দাগ কেন মুছবে? যে রক্তপাত হয়েছে এর কলঙ্কের কালিমা দায়ীদের অবশ্যই বহন করতে হবে।
তবে কেও যদি ভুল স্বীকার করে সরি বলে, কাফফারা দিতে প্রস্তুত হয়, তাহলে তো তাকে বুকে টেনে নেয়াটাও মহানুভবতার পরিচয়। আকাবিরদের ইতিহাসে এমন মহানুভবতার পরিচয় রয়েছে।
আসআদ : দাওরায়ে হাদিস শেষ করে একজন ছাত্র মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য কতটা যোগ্য?
ইয়াহয়া মাহমুদ : ভাল কথা। আমরা ইসলামিক স্টাডিজ এর ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি বলছি। আমরা তো বলছি না ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর ডিগ্রি বা অন্য কোনো বিষয়ে।
আমরা তো এ ময়দানের মাস্টার্স হয়ে আছি আগে থেকেই। এটা শুধু একটা ঘোষণা। তবে সাধারণ বিষয়ে যেন আমাদের ছেলেরা যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে এ জন্য আমাদের শিক্ষাকার্যক্রমকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে।
তবে যে বিষয়ে মাস্টার্সের সমমান দেয়া হয়েছে, মাদরাসায় আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের এর থেকেও আরও যোগ্য করে তৈরি করছি।
আসআদ: স্বীকৃতি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কিছু বলতে চান?
ইয়াহয়া মাহমুদ : বাংলাদেশ সরকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলব, আপনার সরকার যত ভাল কাজ করেছে, সেই ভাল কাজের ফিরিস্তি নির্বাচনি ইশতেহারে বা বিভিন্ন জায়গায় যখন দিবেন সেখানে সর্ব প্রথম এটাকে রাখবেন।
কারণ এর দ্বারা যুগ যুগ ধরে দেশ ও জাতি উপকৃত হতে থাকবে এবং মৌলিক উপকার হবে দীন ও ঈমানের রক্ষা। অনেক সেক্টরে দীন ঈমানের রক্ষণাবেক্ষণ নেই। যদি কোনো সেক্টরে এ সনদের মাধ্যমে একজন কওমি আলেম ঢুকতে পারে তাহলে ওই অঙ্গনের অনেকগুলো মানুষের দীন ঈমানের রক্ষা হবে।
প্রধানমন্ত্রীকে বলব, আপনার বাবার মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আপনার মাধ্যমে কওমি সনদের বিল পাশ হয়েছে। এ মূহুর্তটি আপনার জন্য স্বরণীয় হয়ে থাকবে আজীবন। কারণ ওই মূহুর্তে আপনি যে হাসিটি দিয়েছেন এর দারা বুঝা যায় আসলে আপনি মন থেকেই কাজটি করেছেন।
স্বীকৃতির মাধ্যমে যেসব ক্ষেত্রে আলেমগণ যেতে পারেননি ওই সকল ক্ষেত্রও উন্মুক্ত হয়েছে। সবাই যেন এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব রাখেন। এর বিরোধিতা করার চেষ্টা যদি কেও করে তাহলে সে নিজের সঙ্গেই নিজে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।
আসআদ: এতক্ষণ সময় দেয়ার জন্য আওয়ার ইসলামের পক্ষ থেকে আপনাকে অসংখ্য শুকরিয়া ও ধন্যবাদ।
ইয়াহয়া মাহমুদ : তোমাকেও ধন্যবাদ। আওয়ার ইসলামকেও ধন্যবাদ। আওয়ার ইসলামের সকল পাঠককেও ধন্যবাদ।
[মালিবাগে চালু হয়েছে অত্যাধুনিক হিজামা সেন্টার। নবীজি সা. নির্দেশিত এ চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করে সুস্থ থাকুন। হার্টের রোগ, কিডনির, লিভারের ও স্ট্রোকসহ শরীরের বাত ব্যথার জন্য খুবই উপকারী হিজামা: যোগাযোগ ০১৮৫৮১৪১৮৪৬]
-আরআর