দীর্ঘ ত্রিশ বছর সংগ্রামের পর সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছে কওমি মাদরাসা। বিষয়টি এখন সবার মুখে মুখে। কিন্তু এই স্বীকৃতি আলোচনার শুরু কোত্থেকে, কী অবদান রাখবে কওমি স্বীকৃতি, দেওবন্দি চিস্তা চেতনার সঙ্গে কতটা যৌক্তিক।
এসব নিয়ে ঢাকা তেজগাঁও রেলওয়ে মাদরাসার শাইখুল হাদিস ও ইসলামি ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক ড. মাওলানা মুশতাক আহমদের সঙ্গে কথা বলেছেন আওয়ার ইসলামের দুই প্রতিবেদক আব্দুল্লাহ আফফান ও ইসমাঈল আযহার।
আওয়ার ইসলাম: কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির জন্য কাদের অবদানকে সবচে উল্লেখযোগ্য হিসেবে আনবেন?
ড. মুশতাক আহমদ: কওমি স্বীকৃতির বিষয়ে আমরা অনেকের অবদান লক্ষ করি। কিন্তু এ বিষয় নিয়ে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি চিন্তা ভাবনা করেন তিনি হলেন মাওলানা আবদুল জাব্বার জাহানাবাদী রহ.।
শুরুতে কওমি মাদরাসার কোন বোর্ড ছিল না। আবদুল জাব্বার জানাহাবাদীর প্রচেষ্টায় একটি হয়। যার নাম ‘বেফাকুল মাদারিসির আরাবিয়া বাংলাদেশ’। তিনি কওমি স্বীকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা করেন। বেফাকে গঠনের চূড়ান্ত লক্ষ্যও ছিল স্বীকৃতি।
আওয়ার ইসলাম: আর স্বীকৃতি আন্দোলনে যাদের ভূমিকা বেশি দেখেছেন?
ড. মুশতাক আহমদ: আলেমদের মধ্যে যারা সচেতন, তারা এ ব্যাপারে কাজ করেছেন। পত্র পত্রিকায় যারা লেখালেখিতে সক্রিয় তাদের অবদান অনেক। লেখালেখির কারণে বারবার আলোচনা এসেছে বিষয়টা। প্রশাসনের দৃষ্টি গোচর হয়েছে।
ইতোপূর্বে অনেক আলেম এ বিষয়ে দাবি তুললেও বর্তমান যেসব আলেম লেখালেখিতে সক্রিয় আমি মনে করি তাদের ভূমিকা এখানে বেশি।
আওয়ার ইসলাম: আপনি একজন সিনিয়র আলেম এবং শাইখুল হাদিস। লেখালেখিও করেন। আপনার ভূমিকা কেমন ছিল?
ড. মুশতাক আহমদ: আলহামদুলিল্লাহ স্বীকৃতির কিছু কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। প্রেস ক্লাবের কয়েকটি বক্তব্যে আমি স্বীকৃতির প্রয়োজনিয়তা তুলে ধরেছিলাম।
ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটে কওমি মাদরাসা ও কর্মসংস্থান নিয়ে একটি আর্টিকেলে আমি স্বীকৃতির বিষয়টি ফুটিয়ে তুলেছি। স্বীকৃতির শর্তসমূহ সম্পাদনা করাসহ খুটিনাটি অনেক কিছু করেছি।
আর স্বীকৃতির ভেতর এমন কোনো শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় কিনা যার দ্বারা আমাদের ক্ষতি হতে পারে এ বিষয়টিও আমি তদারকি করেছি।
আওয়ার ইসলাম: বর্তমান সরকার আলেমদের চাহিদা অনুযায়ী স্বীকৃতির বিল পাশ করেছে, বিষয়টিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. মুশতাক আহমদ: আমরা শুরু থেকে চেয়েছিলাম আমাদের চাহিদা অনুযায়ী স্বীকৃতি দেয়া হোক। আল্লামা শাহ আহমদ শফী যেভাবে শর্তগুলো লিখে দিয়েছেন, তাতে কোনো রদবদল করেনি আ’লীগ সরকার। এমনকি তাতে কোন হরফ বা নুকতাও পরিবর্তন করেননি।
কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক রুটে যাওয়ার জন্য স্বীকৃতি বাধা ছিল। এখন আর এ বাধা থাকল না। তবে স্বীকৃতি নিয়ে বসে থাকলে হবে না। এটা হলো জাগতিক কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হওয়ার প্রথম ধাপ।
ইসলামিক স্টাডিজে পড়ে অন্যরা যেমন সুযোগ সুবিধা পায়, আমাদেরও তেমন সুযোগ সুবিধা নিতে হবে। সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে এ জন্য অবশ্যই সরকার ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
‘যে মানুষের শুকরিয়া করে না সে আল্লাহর শোকর আদায় করে না’। শোকর আদায়ের অর্থ এই না যে, আমরা সরকারের মতাদর্শ মেনে নিলাম বা তার দলের কেউ হয়ে গেলাম। একজন ধন্যবাদ দেয়া আর তার মতাদর্শ গ্রহণ করা এক বিষয় না।
আওয়ার ইসলাম: স্বীকৃতির এই ঘোষণা দেওবন্দের চিন্তা দর্শণের সাথে কতটা যৌক্তিক?
ড. মুশতাক আহমদ: কওমি স্বীকৃতি দেওবান্দি চিন্তা চেতনার সাথে অযৌক্তিক নয়। দেওবন্দের প্রতিষ্ঠার আট মূলনীতি যা কাসেম নানূতবি রহ. প্রণয়ন করেছেন তাতে স্বীকৃতিকে নিষেধ করা হয়নি।
তবে মূলনীতিতে আযাদীর কথা এসেছে। কুরআন সুন্নাহ একজন মানুষকে যে স্বাধীনতা দেয় তা যেন ক্ষু্ন্ন না হয়। আমি মনে করি দেওবন্দের এ শিক্ষা ব্যবস্থা স্বীকৃতির মাধ্যমে যুগোপযোগিতা পেয়েছে, আন্তর্জাতিকতা লাভ করেছে।
আওয়ার ইসলাম: দেওবান্দের ৮ মূলনীতির সাথে স্বীকৃতির কোন বৈরিতা আছে?
ড. মুশতাক আহমদ: দেওবান্দের ৮ মূলনীতির সাথে স্বীকৃতির সাংঘাত দেখি না। মূলনীতির পরিপূরক বলতে হবে। আমাদের স্বীকৃতির মধ্যে এটা বলা আছে আট মূলনীতিকে ক্ষুন্ন করা হবে না। এবং মূলনীতি মেনে আমরা এ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবো।
আওয়ার ইসলাম: শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ ও আগামী নির্মাণে এই স্বীকৃতি কতটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আপনি মনে করেন?
ড. মুশতাক আহমদ: কওমি স্বীকৃতির ইতিবাচক অনেক দিক রয়েছে। যদি এটাকে যথাযথ ব্যবহার করা হয়। যদি শুধু চাকরি প্রাপ্তির উসিলা হিসেবে নেওয়া হয় তাহলে শুধু চাকরিটাই হবে।
এটাকে যদি জ্ঞান আহরণের মাধ্যম ধরা হয় তাহলে এটা অনেক কল্যাণকর আমাদের জন্য। আমাদের দাওরা পাস করা ছেলেরা ভারত পাকিস্তান মিশরসহ আরো অনেক দেশে শিক্ষা গ্রহণের জন্য যেতে পারবে। বলা যায় বিদেশে উচ্চ শিক্ষার দ্বার খুলবে সহজে।
এ ক্ষেত্রে আমরা নতুন নতুন অনেক বিভাগ খুলতে পারি। যেসব সাবজেক্টের দু’একটি কিতাব পড়ানো হয় সেগুলোর প্রত্যেকটির জন্য আলাদা আলাদা বিভাগ খুলতে পারি।
যেমন উলূমে হাদিস, ফেকাহ, নাহু, সরফের সাথে আমরা মান্তেক, হেকমাহ, বালাগাতসহ অন্যান্য বিভাগ খুলতে পারি।
এসে গেল যাদুকরী মাদরাসা ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার
এখন আমরা টিচার্রস ট্রেনিং সেন্টার খুলতে পারি। এতে করে আমাদের শিক্ষার মান আরো উন্নত হবে সে সব বিষয়গুলো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। সেগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে।
আওয়ার ইসলাম: মাদরাসা শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং বহিঃর্বিশ্বে পড়াশোনার ক্ষেত্রে কওমি স্বীকৃতি কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে?
ড. মুশতাক আহমদ: উচ্চ শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অনেক ভূমিকা রাখবে। একটা সময় সরকারি সকল চাকরির ক্ষেত্রে প্রবেশের অধিকার এসে পড়বে।
তবে আমাদের মনে রাখতে হবে চাকরিটা মুখ্য নয় বরং গৌণ। মূল হচ্ছে এ শিক্ষাধারাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে দেওয়া।
ব্যবসা বাণিজ্য নতুন নতুন উদ্ভাবন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ধর্মীয় পরিবেশটা সযত্নে লালন সবকিছু এর ভেতরে আসবে।
হেফাজত, কওমি স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা বিষয়ে দীর্ঘ কথা বললেন প্রধানমন্ত্রী
-আরআর