আলী আবদুল মুনতাকিম
প্রকৌশলী ও কুরআন গবেষক
‘খায়রুকুমমান তায়াল্লামুল কোরআনা ওয়াআল্লামাহু’-অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ যে কুরান শিখে এবং অপরকে শেখায়।
আল্লাহপাকের এ ঘোষণার আলোকে আমরা যদি আমাদের সমাজের দিকে তাকাই এবং একটু চিন্তাশীল হই তাহলে গভীর দুঃখ আর বেদনাবোধ আমাদের ভারাক্রান্ত করবে। সেটা কী রকম?
ধরুন একটি গ্রামে কিংবা শহরের কোন পাড়ায় ২ হাজার লোকের বসবাস, সেখানে হয়ত ৪জন ডাক্তার, ১০জন ইঞ্জিনিয়ার, ২ জন উকিল, ৫জন শিক্ষক, ২০০জন উচ্চশিক্ষিতও নানা পেশায় নিয়োজিত, ২জন আলেম আছেন যাদের একজন মসজিদের ঈমাম ও অন্যজন মাদরাসার শিক্ষক।
তাকিয়ে দেখুন, ওই গ্রাম কিংবা পাড়ায় রাস্তাঘাট স্কুলকলেজ বা কোন উন্নয়নমূলক কাজে মাওলানা সাহেবকে ডাকা হয় না। তার ভূমিকা থাকলে সেখানে চুরি হত না, কারণ তিনি কুরানের শিক্ষক।
ওই মহল্লার কোন বিচার বা শালিস কার্যে আলেমদের ডাকা হয় না, কারণ তার সমাজে তিনি মূল্যহীন। বাস্তবতা হচ্ছে- তাতে ডাকা হলে তিনি যে কোনো রায় দিতেন কুরানের আলোকে।তিনি নিজ উদ্যোগে কোনো কাজে এগিয়ে গেলে বলা হয় হুজুর, আপনার কাজ মসজিদে, এখানে নাক গলাবেন না।
এটি একজন আলেমের জন্য শুধু অপমানজনক নয়, আমাদের সবার জন্য লজ্জার।আলেমদের মূল্য দেইনি বলে গোটা সমাজই আজ মূল্যহীন।
আপনার মাদরাসার জন্য নিন কওমি ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার
অসভ্যতা,বর্বরতা,বেহায়াপনা, অশালীনতা, গুন্ডামি, লুচ্চামিতে সমাজ ভরে গেছে। এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহপাক যেখানে আলেমকে শ্রেষ্ঠ বলেছেন সেখানে আলেমকে সর্বকাজের নেতৃত্বে না রাখলে সমাজ, দেশ ও গোটা জাতির অশান্তি দূর হবে না।
একতরফা সমাজকে দায়ীও করছি না। আলেমদের দায়ও কম না। আমার সুপ্রিয় পাঠকমন্ডলি জানেন আমি বাস্তব উদাহরণ দিয়ে কথা বলি, শ্রদ্ধেয় আলেমগণ (সবাই নন, কিছু সংখক মাত্র) ভুল বুঝবেন না, আমি সতর্ক হতে আপনাদের জোড় হাতে অনুরোধ করছি।
দু একটি উদাহরণ দেই। আমার নিজ গ্রাম কুমিল্লার শিকারপুর এ জিলানী মাদরাসায় প্রতিবছর বিশাল মাহফিল হয়।
প্রিন্সিপাল সাহেব আমাকে ফোন দিয়ে বল্লেন আপনার তো সারাদেশের আলেমদের সাথে পরিচয় আছে, একজন বিখ্যাত ওয়ায়েজিন এ বছর ঠিক করে দেন।
আন্তর্জাতিক একজন বক্তাকে আমি ফোন দিলাম। তিনি আমাকে বললেন, আমাকে অগ্রিম ৩০ হাজার টাকা পাঠাতে হবে তারপর বুকিং। আমি প্রিন্সিপালকে জানানো মাত্র তিনি কয়েকবার আস্তাগফের পড়েন।
এসে গেল যাদুকরী মাদরাসা ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার
দুর্ভাগ্য মাস চারেক পর এই ওয়ায়েজ ইনতিকাল করেন। মতিঝলে তার বিশাল জানাজায় গিয়েছি। টাকাটা দিলে কী হতো?
ইউটিউবে যে কেউ দেখবেন মাওলানা তফাজ্জলকে এক এলাকার মাহফিলের জন্য ২০ হাজার টাকা অগ্রিম দেয়া হয়, কিন্তু তিনি মাহফিলে যাননি। কমিটির লোকজন এসে যে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছে, তা কষ্টদায়ক। তারা বলে, আপনি একজন সুবিধাবাদি, ভণ্ড, প্রতারক।
ঢাকার একটি মাদরাসার সভাপতি হিসেবে গতবারের বার্ষিক মাহফিলে নোয়াখালীর এক মোফাস্সিরকে দাওয়াতের জন্য আমাকে বলা হয়। আমি ফোন দিলে তিনি অগ্রিম ১০ হাজার টাকা বিকাশে পাঠাতে বলেন এবং তিনি সায়দাবাদ নামলে কয়েকটি মোটরসাইকেল পাঠিয়ে করডন করে নিয়ে আসতে বলেন।
সাগরপাড়ের এক মাওলানার ওয়াজ নিতে এক বছর আগে ফরম নিয়ে ফিলাপ করে অগ্রিম টাকা দিয়ে বুকিং নিতে হয়। আমার সভাপতিত্বে তিনি অনেক ওয়াজ করেছেন, আমি তার কথার কোনো গভীরতা দেখিনি। তবে তার সুর সুন্দর, কিস্সা ভাল বলেন।
রাসুল সা. বলেছেন, তোমার সামনে কেউ তোমার প্রসংসা করলে তার মুখে থুথু মার, দেখা যায় মাওলানা সাহেব মাহফিলের মঞ্চে আসার কালে তকবির আর স্লোগান, স্টেজে বসলে প্রশংসার ফুলঝুরি, তিনি পুলকিত হন।
হাদিস নিজে অমান্য করেই ওয়াজ শুরু করেন। ওয়াজ শেষে ব্যবসা কাজের বকেয়া বিল আদায় করে নেন। আমরা জানি নানারকম উন্নয়ন কাজের জন্য ঠিকাদারকে/ব্যবসায়ীকে অগ্রিম দিতে হয়, কাজ শেষে বিল দিতে হয়। ওয়াজ ও কি ব্যবসা?
কিন্তু না, সকলেই না। যাদের ওয়াজে হেদায়েতি কথা থাকে, কুরান হাদিস নিয়ে গভীর আলোচনা করেন, তারা কোন ডিমান্ড করেন না। আপনি যাতায়াত ভাড়া দিলেই হল। তারা কি সঠিক না সাগরপাড়িরা সঠিক?
ওপেন এয়ার কন্সার্ট করে গানের শিল্পিরা যেভাবে টাকা নেয় আপনারাও তাই করেন।
বুঝতে হবে আল্লাহ আপনাকে কণ্ঠ আর মেধা দিয়েছেন দ্বীন প্রচারের জন্য, ব্যবসার জন্য নয়। ২ ঘন্টা ওয়াজ করে ৭০ হাজার টাকা? টাকার লোভ দ্বীনকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। জবাবদিহিতার ওপরে কেউ নয়।
তাই বলছিলাম, আলেমদের মর্যাদাহানির পেছনে এমন কিছু সুবিধাবাদী আলেমের দায় কম নয়। তারা যে কাজগুলো করছেন বিবেচনা করা উচিত।
মানুষ যে ভাষায় গালি দেয়, নামের সাথে জঘন্য তকমা লাগায়, তা যেন আর না হয় এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আলেমদের সতর্ক হওয়ার বিনীত অনুরোধ করছি।
এটিও পড়ুন: ওয়াজ মাহফিল নিয়ে অভিযোগের সুযোগ নেই; তবে সতর্ক হতে হবে কিছু বক্তাকেও
-আরআর