রোকন রাইয়ান
আওয়ার ইসলাম
রাজনীতিতে যেহেতু শেষ বলে কোনো কথা নেই, নির্বাচনে থাকবে এ কেমন আন্দাজ। সুতরাং- নির্বাচনে জিততে ‘মন যা চায় করো’ নীতি অবলম্বন করছেন প্রার্থীরা। আর এতে সমালোচিত হচ্ছেন ব্যক্তি বা দল।
চলমান সিটি নির্বাচনগুলোতে যাচ্ছেতাই নীতির অনেক ফেক্ট সামনে এসেছে। সবচেয়ে আলোচিত ফেক্ট হলো হেফজত ও আল্লামা আহমদ শফীর সমর্থন। শুরু হয়েছিল গাসিক নির্বাচন দিয়ে। এখনো চলছে এই সমর্থন অসমর্থনের ঝালমরিচীয় কামড়।
ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল গাসিকের আ’লীগ প্রার্থী এ্যাডভোকেট মো. জাহাঙ্গীর আলম। গাজীপুর সিটির নির্বাচনী প্রচারণা চলছে তখন। ১১ মার্চ হেলিকপ্টারে হাটহাজারী উড়ে গেলেন জাহাঙ্গীর আলম। আল্লামা আহমদ শফীর পায়ের কাছে বসলেন। একজন আল্লাহর বান্দা দোয়া চাইতে এসেছে। তিনি মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দিলেন।
সেই ঘটনা নিউজ হলো। প্রকাশ পেলো কয়েকটি ছবি। এতটুকু থাকলে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু গাজীপুরের সেই নেতার ভক্তরা হয়তো ভাবলেন, এত টাকা ব্যয় করে হাটহাজারী গেলেন তা উসুল না করলে কী করে হয়। তাই প্রচারণা দিলেন হেফাজত গাসিক নির্বাচনে মো. জাহাঙ্গীরকে সমর্থন দিয়েছে।
সেই স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়লো ফেসবুকে। আর সেটা বিবেচনা না করেই কেউ কেউ মন্তব্য করতে শুরু করলো, ‘হ এরা এখন ওদেরই সমর্থন দেবে’, চেনা আছে তাদের’ ইত্যাদি। কুৎসা রচনা করতে শুরু করলো হাজারও মানুষ।
গাজীপুর নির্বাচন শেষ হয়েছে। গত ২৬ জুন বিপুল ভোটে পাশ করেছেন এডভোকেট জাহাঙ্গীর। কিন্তু আল্লামা আহমদ শফীর দোয়ার সেই ছবি নিয়ে সমালোচনা এখনো শেষ হয়নি। অশ্বস্তি কাটেনি আলেমদেরও।
আগামী ৩০ জুলাই বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেটে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সিটি নির্বাচন। এ নির্বাচনেও সেই দোয়া ও সমর্থন ফেক্ট চাউর হয়ে উঠেছে। এসব নিয়ে আড়ালে বিদ্রুপের শিকার হচ্ছেন মুরব্বি আলেমরা। এটি একে তো অনুচিত দ্বিতীয়ত অন্যায়।
গাজীপুর শেষ হয়ে এখন চলছে তিন সিটি নির্বাচনের প্রচারণা। এখানেও সেই দোয়া সমর্থনের নাটকীয় উপস্থানা শুরু হয়েছে।
জানা গেছে, সিলেট নির্বাচনেও দোয়া ও সমর্থন নিয়ে অপ্রচারের শিকার হচ্ছেন জেলার প্রবীন ও খ্যাতিমান আলেম প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান। প্রার্থীরা তার সঙ্গে দেখা করে প্রচার করছেন তিনি তাকে সমর্থন দিয়েছেন।
সম্প্রতি সিলেটে নাগরিক ফোরাম থেকে নির্বাচন করা জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী এহসানুল মাহবুব যোবায়ের দেখা করেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির ও কাজিরবাজার মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। তার থেকে তিনি দোয়া নিয়ে এলে গাসিকস্টাইলে প্রচার করা হচ্ছে তিনি যোবায়েরকে সমর্থন জানিয়েছেন।
এদিকে এহসানুল মাহবুবের সমর্থকরা আরও প্রচার করছেন, নির্বাচনে ঘড়ি মার্কাকে সমর্থন জানিয়েছে হেফাজতও। ভক্তদের দাবি হেফাজতে ইসলামের সিলেট জেলার সমন্বয়ক ও সিলেট মহানগরীর সহ সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আসলাম রহমানী নির্বাচনী প্রোগ্রামে এসে জামায়াতে ইসলামের মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী বিশিষ্ট আইনজীবী এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকে সমর্থনের কথা জানান!
লেখাটির সঙ্গে কয়েকটি স্ক্রিনশটও ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুকজুড়ে। তবে হেফাজত কর্মীদের দাবি, এটা স্রেফ অপপ্রচার। কেননা হেফাজত কোনো রাজনৈতিক দল নয় এবং নির্বাচনে কারও সমর্থনও দেবে না।
মূলত হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক প্লাটফরম, একে রাজনীতিমুক্ত রাখতে সবসময় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এর নেতাকর্মীরা। কারণ হেফাজত ঈমান ও আকিদাবিরোধী কাজের প্রতিবাদেই মূলত গড়ে উঠেছে।
এ ব্যাপারে হেফাজতের আমির আল্লামা আহমদ শফী সম্প্রতি একটি জনসভায় স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন।
তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য নেই। কারও সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক স্বার্থভিত্তিক বন্ধুত্ব বা শত্রুতাও নেই। কোনো নির্বাচনে হেফাজত কাউকে মনোনয়ন বা সমর্থন দেবে না। কেউ যদি সমর্থনের প্রচার করে তা তা মিথ্যা।
এদিকে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ছাপিয়ে উঠেছে দোয়া ও সমর্থন বিতর্ক। সিটির ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে লড়ছেন এ অঞ্চলের প্রবীন আলেম মাওলানা ওবায়দুর রহমান মাহবুব।
তিনি বরিশালের জামিয়া মাহমুদিয়ার প্রিন্সিপাল ও হেফাজত ইসলামের জেলা আমির।
গত ১ জুলাই সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ভক্তরা প্রচার করেন ‘বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে হাফেজ মাওলানা ওবায়দুর রহমান মাহবুবকে আল্লামা শাহ আহমদ শফি সাহেব নির্বাচন করার অনুমতি বা সর্মথন দিয়েছেন’।
এসব নিয়ে আলোচনা সমালোচনা অব্যাহত থাকলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম একটি বক্তব্যে এ বিষয়ে আলোচনাও করেন।
পরে হেফাজতের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতির মাধ্যমে জানানো হয় হেফাজত আমির তাকে অনুমতি বা সমর্থন কিছুই জানাননি। বরং মাদরাসা ও দীনি খেদমতে আরও সময় দেয়ার পরামর্শ দেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হেফাজতে ইসলাম ২০১৩ সালে জাগরণমূলক যে গণজোয়ার তৈরি করেছিল সে প্রভাব রাজনীতিতে এখনো বিদ্যমান। হেফাজতের প্রতি মানুষের আস্থা, ভালোবাসা ও ইমোশন কাজে লাগাতে কেউ কেউ দোয়াকে সমর্থন বলে চালিয়ে দিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে হেফাজতের মহাসচিব হাটহাজারী মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম নির্বাচনমুখী সংগঠন নয়। এটা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক আক্বিদাভিত্তিক ধর্মীয় সংগঠন। তাই হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না।
তবে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই ইসলামী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তারা যদি নিজস্ব দলীয় ব্যানারে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন, সেটা তাদের দলীয় ব্যাপার। এটার সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।’
তাই হেফাজত অমুককে সমর্থন দিয়েছে, অমুক প্রার্থীর সফলতা কামনা করেছে এসব নিউজে, লেখায় বা প্রচারণায় না আনা উচিত।
রাজনীতিতে হেফাজতের প্রভাব নিয়ে পড়ুন সাংবাদিক ও কলামিস্ট শরীফ মুহাম্মদের সাক্ষাৎকার: ‘জাগরণমূলক যে কোনো আন্দোলনের প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে পড়েই’
-এআর