আওয়ার ইসলাম : ঐতিহ্যবাহী ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর শক্তিশালী দেশ ও জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পশ্চিম সীমান্তে গ্রিস এবং পূর্ব সীমান্তে ইরানকে নিয়ে এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশের সঙ্গমস্থলে আধুনিক তুরস্ক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
২০০২ সাল থেকে রজব তাইয়েব এরদোগানের নেতৃত্বাধীন ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল তুরস্কের ক্ষমতায় রয়েছে। ১৯২৩ সালে আধুনিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগানের তত্ত্বাবধানেই দেশটিতে বেশ বড় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। দেড় দশক ক্ষমতায় থাকার পর রোববারের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও তার দল আবারো বিপুলভাবে জয়ী হয়েছেন।
১২৯৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল ঐতিহাসিক ওসমানীয় সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্য ৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার বেশির ভাগ এলাকা নিয়ে পৃথিবীর বুকে সগৌরবে টিকে ছিল। ইসলামের সব পবিত্র স্থাপনাসহ আধুনিক সৌদি আরবও এই সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। কিন্তু শেষের দিকে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের শৌর্যবীর্য ধীরে ধীরে ক্ষয় পেতে থাকে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে জার্মানির পক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পরাজয়বরণ করার পর সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন হয়। এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মোস্তফা কামাল আতাতুর্কসহ তুরস্কের সামরিক কর্মকর্তারা ১৯২৩ সালে এক ঘোষণার মাধ্যমে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
এরদোগান ক্ষমতায় আসার পর তুরস্ক আবারো ইরাক ও সিরিয়াসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য, বলকান রাষ্ট্রসমূহ এবং আফ্রিকায় ওসমানীয় যুগের ন্যায় প্রভাব বিস্তারে মনোযোগী হয়। আধুনিক তুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট কামাল আতাতুর্ক ১৯৩৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তুরস্ককে রাষ্ট্রীয়ভাবে পশ্চিমা রীতিনীতি ও মূল্যবোধের দিকে চালিত করেন এবং সেকুল্যারিজমকে দেশের অন্যতম মৌলিকভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর কামাল আতাতুর্কের উত্তরসূরি ইসমত ইনোনুর হাত ধরে ১৯৪৬ সালে তুরস্কে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা হয়।
অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক নিরপেক্ষ ছিল। এরপর ১৯৫২ সালে প্রতিবেশী গ্রিসের সাথে তুরস্ক ন্যাটো জোটে যোগ দেয়। দেশকে ধীরে ধীরে ইসলামীকরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং তুরস্কের পশ্চিমাঘেষা রীতিনীতি পরিবর্তনের জন্য সমালোচকেরা এরদোগানকে অভিযুক্ত করেন। কিন্তু ন্যাটোর সদস্য হিসেবে সেক্যুলার রাষ্ট্র পরিচয়ে থাকতেই তার দেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ বলে জোর দিয়ে জানিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। ১৯৬০, ১৯৭১ ও ১৯৮০ সালে তুরস্কের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী দেশটির সরকারকে উৎখাত করে।
ক্ষমতায় আসার পর এরদোগান দেশটির সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সীমিত করেন। সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা কমিয়ে আনতেই তাদের নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ২০১৬ সালের জুলাই মাসে কিছু বিপথগামী সেনা অভ্যুত্থানের ব্যর্থ চেষ্টা করে। অবশ্য এক সময়ের মিত্র ফতহুল্লাহ গুলেন এই অভ্যুত্থানের নির্দেশদাতা বলে অভিযোগ করেন এরদোগান। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা গুলেন এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এরপর এরদোগান তুরস্কে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে অভূতপূর্বভাবে প্রায় ৫৫ হাজার মানুষকে আটক করেন।
২০১৬ সালে জারি হওয়া জরুরি অবস্থা এখনো বিদ্যমান আছে এবং নির্বাচনের পর জরুরি অবস্থা তুলে নেয়া হবে বলে এরদোগান ও অন্যান্য বিরোধী নেতা অঙ্গীকার করেছেন। তুরস্ক এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ লাখ সিরিয়ান উদ্বাস্তুকে নিজের ভূখণ্ডে আশ্রয় দিয়েছে, যাদের বেশির ভাগই দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এবং ইস্তাম্বুলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি দেশটি ইরাক ও আফগানিস্তানের উদ্বাস্তুদেরও গ্রহণ করেছে। তা ছাড়া তুরস্ক কয়েক লাখ সিরিয় উদ্বাস্তুকে তুর্কি পাসপোর্টও প্রদান করেছে। তুরস্কের সবচেয়ে বড় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কুর্দি জনগোষ্ঠী। কুর্দি সমস্যার সমাধান হচ্ছে না দাবি করে অবৈধ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) ১৯৮৪ সালে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং এতে প্রায় এক লাখ মানুষ নিহত হয়।
২০০৩ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করার পরপরই এরদোগান কুর্দিদের অভূতপূর্ব অধিকার দিয়েছিলেন এবং তাদের সাথে সংলাপ শুরু করেন। যদিও পরে অস্ত্র বিরতি ব্যর্থ হয় এবং সংঘর্ষ চলতে থাকে। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
আরো একবার রজব তাইয়েব এরদোগানের ওপর আস্থা রাখলেন তুরস্কের ভোটাররা। রোববার অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ২২ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন এরদোগান। একই দিন অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনেও অর্ধেকের বেশি আসন লাভ করেছে এরদোগানের দল জাস্টিস এন্ড ডেভলপমেন্ট (একে) পার্টি।
২০০৩ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকা এরদোগানকে আরো এক মেয়াদের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিলো তুর্কি ভোটাররা। ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ও সে বছর থেকে দেশটির প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব পালন করছেন। রোববারের নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত ৯৮ শতাংশ কেন্দ্রের ফলাফলের মধ্যে প্রায় ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন এরদোগান। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মুহারেম ইঞ্চ পেয়েছেন ৩০ শতাংশের কিছু বেশি ভোট। অন্য চার প্রার্থীর সবার প্রাপ্ত ভোট ৮ শতাংশের নিচে। তবে নির্বাচন কমিশনের এই ঘোষণার অনেক আগেই নিজস্ব সূত্রে প্রান্ত ফলাফলের ভিত্তিতে বিজয় মিছিল শুরু করেছে এরদোগানের সমর্থরা।
এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন একটি যুগে প্রবেশ করল তুরস্ক। দেশটির প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা কার্যকর হবে নতুন মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে। গত বছর এক গণভোটে তুরস্কের জনগন প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা অর্জনের পক্ষে রায় দেয়। এর ফলে দেশটির শাসন ক্ষমতা আরো জোরদার হবে বলে দাবি করছেন এরদোগান ও তার দল একে পার্টি। এই ক্ষমতা অর্জনের ফলে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে।
দীর্ঘ শাসনামলে তুরস্ককে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার কারণেই এরদোগানকে নির্বাহী ক্ষমতা দিয়েছে দেশটির জনগন-এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তুরস্কের সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিড্টে নির্বাচনে প্রার্থীদের কেউ নূন্যতম পঞ্চাশ শতাংশ ভোট না পেলে, নির্বাচন গড়ায় দ্বিতীয় দফায়। প্রথম দফায় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া দুই প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন দ্বিতীয় দফায়। প্রথম দফা নির্বাচনের পনের দিন পর অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় দফা নির্বাচন। যদিও ইতোমধ্যেই পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে গেছেন দেশটির তুমুল জনপ্রিয় নেতা এরদোগান। তাই দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।
এদিকে একই সাথে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনেও বড় ব্যবধানে জয় পেতে যাচ্ছে এরদোগানের দল জাস্টিস এন্ড ডেভলপমেন্ট (একে) পার্টি। পার্লামন্টে নির্বাচনে এখন পর্যন্ত প্রান্ত ফলাফলে একে পার্টির নেতৃত্বাধীন জোট পিপলস এলায়েন্স অর্ধেকের বেশি আসনে (৩৪২) জয়লাভ করেছে। এর মধ্যে এরদোগানের দল একে পার্টি এককভাবেই পেয়েছে ২৯৩টি আসন। তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স পেয়েছে ১৯২টি আসন।
আল জাজিরা জানিয়েছে, ইতোমধ্যেই বিজয় উল্লাস শুরু করেছে একে পার্টি ও এরদোগানের সমর্থকরা। রাজধানী আঙ্কারায় একে পার্টির সদর দফতরের সামনে হাজির হয়েছে লাখো সমর্থক। তারা বিজয় মিছিল করতে শুরু করেছেন। ইস্তাম্বুল সহ অন্য অনেক শহরেও আনন্দ উল্লাস শুরু হয়েছে তার সমর্থকদের মধ্যে।
ইস্তাম্বুলের ভোটার হওয়ার কারণে নির্বাচনের দিন নিজ শহর ইস্তাম্বুলেই অবস্থান করেছেন এরদোগান। এই নগরীর মেয়র হিসেবেই জাতীয় রাজনীতির পথে শুরু হয়েছিলো তার যাত্রা। ভোটের ফলাফল পাওয়ার পর সমর্থকদের উদ্দেশ্যে দেয়া সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় এরদোগান বলেন, তুরস্কের ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সমৃদ্ধির এই যাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে আমাদের। জনগন আমাদের প্রেসিডেন্সি ও নির্বাহী ক্ষমতা পালনের দায়িত্ব দিয়েছে। আশাকরি গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেব’।
৬৪ বছর বয়সী এরদোগানের জনপ্রিয়তা কতখানি তার প্রমাণ বিশ্ববাসী দেখেছে ২০১৫ সালের ১৫ জুলাই সেনাঅভ্যুত্থান চেষ্টার সময়। শুধুমাত্র তার একটি একটি ভিডিও বার্তার ডাকে সাড়া দিয়ে ট্যাঙ্ক, কামানের সামনে রুখে দাড়িয়েছে নিরস্ত্র জনতা। রাষ্ট্রনেতাকে কতখানি ভালোবাসলে ট্যাঙ্কের পথ রোধ করতে রাস্তায় শুয়ে পড়ে মানুষ!
গত দেড় দশকে ১৪টি নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রতিটিতে জয়ী হয়েছেন তিনি। ১৯৫৪ সালে ইস্তাম্বুলের কাশিমপাশায় জন্ম এরদোগানের। বাবা ছিলেন তুর্কি কোস্টগার্ডের ক্যাপ্টেন। মারমারা ইউনিভার্সিটিতে ব্যবসায় প্রশাসনে পড়ার সময় ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। যোগ দেন কমিউনিজম বিরোধী ন্যাশনাল টার্কিস স্টুডেন্ট ইউনিয়নে। ফুটবলও খেলতেন স্থানীয় একটি নামকরা ক্লাবে। ছাত্রজীবন শেষে যোগ দেন নাজিমউদ্দিন আরবাকানের ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টির যুব সংগঠনে। ১৯৮০ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দলটি বিলুপ্ত করা হলে আরবাকানের নতুন দল ওয়েলফেয়ার পার্টির সাথে যুক্ত হন। এই দল থেকেই ১৯৯৪ সালে নির্বাচিত হন ইস্তাম্বুলের মেয়র।
১৯৯৮ সালে সেক্যুলার সরকার ওয়েলফেয়ার পার্টি নিষিদ্ধ করে। কয়েক মাস জেল খাটতে হয় তাকে, সেই সাথে পড়তে হয় রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি সংক্ষেপে যা একে পার্টি নামে পরিচিত। ২০০২ সালে প্রথম পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়েই জয়লাভ করে দলটি।
সূত্র : ইনকিলাব
এসএস