সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


‘সিলেবাসের ত্রুটিগুলো মেনে নিয়ে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে'

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী। প্রায় একযুগ ধরে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে শাইখুল হাদীসের মসনদে সমাসীন। একই সঙ্গে দেওবন্দের সদরুল মুদাররিসের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও আঞ্জাম দিচ্ছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। প্রায় অর্ধশতাধিক কিতাবের লেখক এ মনীষীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় স্নাত হয় পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীরা। তিনি নিজেও পৃথিবীময় বিলিয়ে বেড়ান জ্ঞানের এ ভা-ার। দেশের বাইরে সফর খুব কম করলেও তার প্রতিটা সফরই হয় তাৎপর্যবহ।

মহান এ জ্ঞানবৃক্ষের সঙ্গে শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন আওয়ার ইসলাম দেওবন্দ প্রতিনিধি তাওহীদ আদনান

তাওহীদ আদনান : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ

তাওহীদ আদনান : হুজুর কেমন আছেন? শারীরিক অবস্থা কেমন আপনার?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর রহমতে ভালই আছি। তুমি কেমন আছ? কী বিষয়? কিছু বলবে নাকি?

তাওহীদ আদনান : জি হুজুর, একটি বিষয় নিয়ে আপনার কাছে এসেছিলাম। একটু সময় নিয়ে কথা বলতে চাই আপনার সাথে।

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : ঠিক আছে বলো সমস্যা নেই।

তাওহীদ আদনান : হুজুর বাংলাদেশে ‘আওয়ার ইসলাম’ নামে ইসলামিক একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল রয়েছে। আমি পোর্টালটির দেওবন্দ প্রতিনিধি। আওয়ার ইসলামের পক্ষ থেকে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে একটি বিশেষ সংখ্যা বের হবে। এ সংখ্যায় আমরা আপনার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করতে চাই।

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : কী বিষয়ে?

তাওহীদ আদনান : বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে।

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : আহহা! শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সাক্ষাৎকার নিতে আসছ আমার কাছে? আমি তো ছোট মানুষ। কী সাক্ষাৎকার দেব? শিক্ষাব্যবস্থা তো অনেক বড় বিষয়। এ বিষয়ে কথা বলার যোগ্যতা তো আমার নেই। তবুও আসছ যখন বলো কোন দিক থেকে কী আলোচনা শুরু করব?

তাওহীদ আদনান : জি হুজুর! শুরুতেই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আপনার ভাবনা শুনতে চাই। তো শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে মৌলিক কিছু কথা যদি বলতেন!

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : আসলে দেখো, শিক্ষাব্যবস্থা বা তালিমি নেযাম মূলত একটি বিষয় নয়। বাস্তবিক অর্থে এখানে দুটি বিষয়। দুটি বিষয়ই ভিন্ন ভিন্ন। তালিম বা শিক্ষা একটি বিষয় আর নেযামে তালিম বা শিক্ষাব্যবস্থা আরেকটি বিষয়। আর উভয়টি যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন একেকটি বিষয়, তাই এর উপর আলোকপাতও করতে হবে ভিন্ন ভিন্নভাবে।

তাওহীদ আদনান : জি। তাহলে হুজুর! প্রথমে তালিম সম্পর্কেই কিছু আলোচনা শুনি!

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : আসলে তালিম সম্পর্কে কিছু বলতে হলে তো প্রথমে নেযামে তালিম নিয়েই আলোচনা করতে হয়। আলোচনার ফাঁকেই তালিমের বিষয়টাও চলে আসবে।

তাওহীদ আদনান : ঠিক আছে হুজুর, পাঠকদের জন্য আপনি যেভাবে বলতে সুবিধা মনে করেন সেভাবেই বলুন!

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : আচ্ছা তাহলে আমি নেযামে তালিম থেকেই শুরু করি। নেযামে তালিম বর্তমান সময়ের কোনো বিষয় নয়। এটা চলে আসছে সেই আকাবিরদের সময় থেকেই। আকাবিরদের সময়ে যেই নেযামে তালিম চালু ছিল বর্তমান সময়েও সেই নেযামে তালিমই চালু রয়েছে। শুধু ব্যবধান হলো পূর্বেকার সেই ধারাটা বর্তমানে সেভাবে আর বজায় নেই।

তাওহীদ আদনান : হুজুর, এই জায়গাটা যদি একটু স্পষ্ট করতেন। পূর্বের সেই ধারাটা বর্তমানে বজায় নেই বলতে কী উদ্দেশ্য?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : আসলে নেযামে তালিম নিয়ে কথা বলার মতো কোনো যোগ্যতা বা সাহস আমার নেই। উপরন্তু আকাবিরদের সময় থেকে চলে আসা নেযামে তালিম নিয়ে কিছু বলার কোনো প্রয়োজনও নেই। কেননা আকাবিরদের সময়ে প্রণীত নেযামে তালিম পুরোপুরি ঠিকই ছিল। কিন্তু সমস্যা হলো পূর্বের সেই ধারা বর্তমানে আর অবশিষ্ট নেই। মানে সেই সময়ের প্রণীত নেযামে তালিমের মধ্যে বর্তমানে বেশকিছু ত্রুটি বিরাজ করছে। যেই ত্রুটিগুলো দূর করা সময়ের অপরিহার্য দাবি।

তাওহীদ আদনান : ত্রুটিগুলো কী? আর বর্তমানে সেই সময়ের রচিত এই নেযামে তালিমে যে ত্রুটিগুলো আছে তা দূর করার পথ বা তা থেকে উত্তরণের উপায় কী?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : ত্রুটি দ্বারা উদ্দেশ্য হলো বর্তমান সময়ের নেযামে তালিম মূলত আকাবিরদের সময়েরই নেযামে তালিম। কিন্তু এই একই নেযামে তালিম সেই সময় জাতিকে যা উপহার দিয়েছে বর্তমানে তার বিন্দু পরিমাণও দিচ্ছে না। আর উত্তরণের উপায় বলতে চাইলে জরুরি তো হলো, ত্রুটি যে সৃষ্টি হয়েছে প্রথমে তা মেনে নেয়া। এরপর উত্তরণের উপায় খোঁজা। কিন্তু পরিস্থিতি তো এমন, উত্তরণের উপায় খোঁজা তো দূরের কথা, উল্টো নেযামে তালিমে যে কিছু ত্রুটি সৃষ্টি হয়েছে তাও মানতে রাজি নয় কেউ। ফলে এসব ত্রুটি থেকে উত্তরণের উপায়ও অবলম্বন করা হচ্ছে না। তদুপরি বলতে চাই, মাদরাসা কর্তৃপক্ষ, জিম্মাদার উস্তাদগণ, বিশেষভাবে মাদরাসা পরিচালনাকারী বোর্ড ও কর্তৃপক্ষের উচিত একত্রে বসে ত্রুটিগুলো কীভাবে সৃষ্টি হচ্ছে? কেন সৃষ্টি হচ্ছে? তার কারণ নির্ণয় করা। কারণগুলো নির্ণয় হলে পয়েন্ট বাই পয়েন্ট তার সমাধান বের করতে সচেষ্ট হওয়া এবং পরিকল্পিতভাবে সেই সমাধানের পথ অবলম্বন করা।

Image result for deoband
জামিয়া দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত

তাওহীদ আদনান : আকাবিরদের রচিত নেযামে তালিমে বর্তমানে যে ত্রুটিগুলো সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে মূল কারণটা কী? এই ত্রুটিগুলো কেন দেখা দিচ্ছে?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : আসলে এর পেছনে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না। ছড়ানো ছিটানো বিভিন্ন বিষয় কারণ হিসেবে যোগ হতে পারে এই ত্রুটিগুলো জন্ম নেয়ার পেছনে। যেমন ধরা যেতে পারেÑ আকাবিরদের সময়ের নেসাবে তালিম এখনো চালু আছে কিন্তু এর প্রকৃতি বদলে ফেলা হয়েছে। কেননা তখন বর্তমান সময়ের মতো জামাতভিত্তিক পাঠদানের কোনো পদ্ধতি ছিল না। কিন্তু নেসাব এগুলোই ছিল।

আগে নিয়ম ছিল যে নেসাবে যতদিন সময় লাগে সে নেসাবে ততদিন সময় দেয়া। ফলে কোনো কোনো নেসাব শেষ হয়ে যেত এক বছরেই। আবার কোনো কোনো নেসাব তার চেয়ে কম সময়ে। আবার কোনো কোনো নেসাব তার চেয়ে বেশি সময়ে। তো যদি কোনো নেসাব এক বছরের আগে শেষ হয়ে যেত তাহলে ওপরের নেসাবে চলে যেতে পারত। আবার কোনো নেসাব এক বছরের পরও বাকি থেকে গেলে সেই নেসাবেই থাকতে হতো। কিন্তু বর্তমানে এই পদ্ধতিটা আর নেই। পরিপূর্ণ পাল্টে ফেলা হয়েছে।

এখন তো সব জামাতের জন্যই সময় বেঁধে দেয়া, এক বছর। যদি এর আগে শেষ হয়ে যায় তাহলেও পরের জামাতে কেউ যেতে পারবে না। আবার শেষ না হলেও উক্ত জামাতে সে থাকে না। সালানা ইমতেহান দিয়ে সবাই অটোমেটিক উপরের জামাতে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। এমন আরও বহু কারণ রয়েছে এই কমতিগুলো তৈরির পেছনে।

তাওহীদ আদনান : কিন্তু হুজুর, আমরা তো সবসময়ই দেখি বছর শেষ হতে হতে কিতাবাদিও সব শেষ হয়ে যায়!

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : বর্তমানে তো কোনো না কোনোভাবে নেসাব শেষ করেই দেন উস্তাদগণ। তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়। কতটুকু হক আদায় করা হয়? বছর শেষে তো ‘চলো ভাই চলো’ করে করে শেষ করা হয়। এটাকে কি শেষ করা বলে?

তাওহীদ আদনান : জিনা। হুজুর! বর্তমান সময়ের নেসাবে তালিম বা নেযামে তালিম সম্পর্কে আরও কিছু বলার থাকলে...

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : আসলে বর্তমান সময়ের নেসাবে তালিম বা নেযামে তালিম যেটাই বলা হোক, যদিও তা আকাবিরদেরই, তবু এর মাধ্যে বিরাট পরিবর্তনও আনা হয়েছে।

একটা সময় পর্যন্ত দাওরার পর আর কিছু পড়ানো হতো না। দাওরা শেষ তো প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখাও শেষ। এরপর কারো আগ্রহ থাকলে ব্যক্তিগত মুতালায়া চালু রাখত। কারো ইচ্ছা হলে তাদরিসি খেদমত আরম্ভ করে দিত। কিন্তু বর্তমানে দাওরার পর আরও কতো কী? অভাব নেই জামাতের। অমুক তাখাসসুস তমুক তাখাসুস ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আগে তো এসবের কিছুই ছিল না। তাহলে নতুন করে কেন এসব প্রণয়ন করা হলো? দাওরা পড়েও যথাযথ যোগ্যতা হচ্ছে না বলে এ সব জামাতের আবির্ভাব? দাওরা পর্যন্ত পড়েও থেকে যাওয়া কমতিগুলো দূর করার জন্যেই এসব জামাতের উদ্ভাবন? দাওরা পর্যন্ত পড়ার পড়েও থেকে যাওয়া দুর্বলতা দূর করণার্থেই এই প্রয়াস? তাহলে তো বিষয়টা হাস্যকর।

তাওহীদ আদনান : হুজুর, বিষয়টি যদি আরেকটু বুঝিয়ে বলতেন!

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : আচ্ছা শুনো, ধরো সাত-আট তলাবিশিষ্ট একটি ভবন তৈরি করা হলো। কিন্তু ঘটনাক্রমে মাঝে কোনো এক জায়গায় একটু দুর্বলতা থেকে গেছে, বা ধরা যাক ভবনটি মাঝ থেকে নড়বড়ে হয়ে গেছে। তো এই দুর্বলতা বা নড়বড়তা দূর করার উপায় কী হবে? আট তলার উপরে আরও কয়েক তলা বৃদ্ধি করে দেয়া নাকি নিচে যেখানে নড়বড়ে হয়ে গেছে বা দুর্বলতা রয়ে গেছে সেখানে মেরামত করে দেয়া? কেউ কি বলবে? যে ভবনটি উপরে আরও কয়েকতলা বৃদ্ধি করে দাও, তাহলে মজবুত হয়ে যাবে! উপরে আরও কয়েকতলা বৃদ্ধি করলে ভবনটি মজবুত হবে, না আরও দুর্বল হবে?

তাওহীদ আদনান : দুর্বল হবে।

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : যদি দুর্বলই হয় তাহলে মজবুত করার পদ্ধতি কী হতে পারে? মজবুত করার পদ্ধতি একটিই হতে পারে। তা হলো, নিচের দুর্বলতা নড়বড়তার জায়গাটাকে মেরামত করে দেয়া। অনুরূপ দাওরার নিচেও যদি কোনো দুর্বলতা থেকেই থাকে, তাহলে তা দূর করার পদ্ধতিটাও দাওরার নিচেই হওয়া উচিত। উপরে নয়।

তাওহীদ আদনান : হুজুর এমনটাও তো সম্ভব যে, দাওরার নিচে যেই বিষয়ে দুর্বলতা রয়ে গেছে দাওরার উপরে মানে দাওরার পরে ওই বিষয়েই পড়ালেখায় মনোযোগী হলো। তাহলে তো তার পূর্বের থেকে যাওয়া দুর্বলতা কেটে যাবে। তার যোগ্যতা আরও বাড়বে, ভীত আরও মজবুত হবে।

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : এটা তো যুক্তি দিয়ে মিলাতে চেষ্টা করতেছো। কিন্তু মিলতেছে না। দুর্বল বস্তুর ওপর কিছু রেখে তা মজবুত করা যায় না। বরং দুর্বল বস্তুকে মজবুত করতে হয় দুর্বল বস্তুর স্থানে বা পাশে কিছু রেখে। আর দাওরার পর অন্য কোনো জামাতে ভর্তি হয়ে দুর্বলতা কাটানোর প্রয়াস তো দুর্বল বস্তুর ওপর কিছু রাখারই নামান্তর। এতে দুর্বলতা তো দূর হবেই না বরং আরও বৃদ্ধি পাবে। সুতারাং দুর্বলতা দূর করার একটাই নিয়ম তা হলো দুর্বলতার স্থানে বা পাশে কিছু রাখা বা দুর্বলতার স্থানটিকে মেরামত করে দেওয়া।

Image result for hathajari madrasa
দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম

তাওহীদ আদনান : বর্তমান সময়ের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আরও কিছু বলার থাকলে যদি বলতেন!

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : বর্তমান সময়ের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে নতুন করে আর কী বলবো? বলতে গেলে তো কেবল আমার হাসিই আসতে থাকে। বলতে পারি না। বর্তমান সময়ের শিক্ষাব্যবস্থা একটি গল্পের মতো। গল্পটি হলো এক ব্যক্তি প্রতিদিন এক বদনা পানি নিয়ে বনের মাঝে যেতো, টয়লেটের প্রয়োজন সারতে। এরপর সে বনের মাঝে যেখানে প্রয়োজন সারতে বসতো সেখানে অন্য কেউ যাতে না এসে যায় সে জন্য সে নিদর্শনস্বরূপ বদনাটাকে খানিকটা দূরে রেখে এসে তারপর বসতো। আর প্রতিদিনই একটি কাক এসে তার পানির মাঝে বিষ্ঠা ছেড়ে দিয়ে পানিগুলো নষ্ট করে দিতো। ফলে সে প্রতিদিনই ঘরে এসে আবার পানি চাইতো। তখন ঘর থেকে জিজ্ঞেস করা হতো, প্রথমে যেই পানি নেয়া হয়েছে সেই পানির কী হয়েছে? তখন সে বলতো পানি তো কাকে নষ্ট করে ফেলেছে।

প্রতিদিনই একই কাহিনী ঘটতো তার সাথে। এরপর একদিন সে এসে আর পানি চাইলো না। তখন ঘর থেকে জিজ্ঞেস করা হলো আজ যে পানি চাইলে না? তখন সে বলল, আজ তো আমি কাককে ধোঁকা দিয়েছি। জানতে চাওয়া হলো কীভাবে? সে বললো প্রথমে পানি খরচ করেছি এরপর টয়লেটের প্রয়োজন সেরেছি। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থারও অনুরূপ একইদশা। কুরআন (তরজমা) পড়া শেষ, হাদিস (তরজমা ও ব্যাখ্যা) পড়া শেষ, ফেকাহ পড়া শেষ, এরপর গিয়ে আদব পড়ে।

সবকিছু পড়া শেষ করে আদব পড়ার ফায়দা কী? যেখানে কুরআন তরজমার জন্য আদবের প্রয়োজন ছিল, যেখানে হাদিস ও ফেকাহের জন্য আদবের প্রয়োজন ছিল তা তো সবই পড়া শেষ। তো এমন সময়ে একটা ছাত্র আদব পড়ে কী করবে? কোনো ফায়দা নেই তখন। এলেমের প্রকৃত স্বাদ পেতে হলে আদব পড়লে এগুলো পড়ার আগেই পড়তে হবে। নতুবা নয়।

তাওহীদ আদনান : তো আমাদের বর্তমান সিলেবাসটা তো এমনই। তাহলে এর সংস্কার ছাড়া অন্যকিছু করাও তো সম্ভবও নয়। তো এ ব্যাপারে কীভাবে কী করার? বা কী মতামত আপনার?
মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : মতামত তো কতই আছে। কিন্তু কে মানে এসব মতামত? মতামত তো মতামতেই থেকে যাচ্ছে। মতামত ব্যক্ত করে কোনো ফায়দাও তো হচ্ছে না। তো কী লাভ এসব মতামত বলে বা শুনে?

তাওহীদ আদনান : তবুও যদি একটু বলতেন আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য!

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : হ্যাঁ আসলে বলতে তো কোনো সমস্যাও নেই। বলার কাজ বলি। কেউ মানলে মানলো না মানলে নেই। মূলত কথা হলো, আমাদের যে দশ-বারো বছরের নেসাব তাতে যথাযথ এস্তেদাদ বা যোগ্যতা তৈরি হচ্ছে না। এর সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন। এই নেসাব ও সিলেবাস সংস্কার করে যথাযথ যোগ্যতা অর্জনের পথ অবলম্বন করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সকলের জন্য। তাহলে আর দাওরার পরে কোনো আদব বা অন্যান্য তাকমিলাতের প্রয়োজন পড়বে না বলে মনে করি।

তাওহীদ আদনান : তবুও যদি একান্তই তাকমিলাতের প্রয়োজন পড়েই যায় তাহলে কী করণীয়?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : হুম, যদি একান্তই তাকমিলাতে আদব বা উলুম বা তাফসিরের প্রয়োজন পড়েই যায় তাহলেও যেন ছাত্ররা পড়তে পারে সেই চিন্তাটাও নতুন সিলেবাস তৈরি করার ক্ষেত্রে করা উচিত। যাতে কোনো ছাত্রের যদি ওই তাকমিলাতসমূহ পড়তেই হয়, তাহলে সে যেন দাওরার আগেই পড়ে নিতে পারে। এরপর তাকমিলাতের প্রয়োজন শেষ, তো সে আবার নিয়ম মাফিক দাওরা পর্যন্ত পড়ে নেবে।

মোট কথা, যদি তাকমিলাতে আদব করতে মনে চায়, তাহলে আগেই করো যাতে কুরআন বুঝতে পারো। যদি তাকমিলাতে উলুম করতে মনে চায়, তাহলে আগেই করো যাতে হাদিস বুঝতে পারো। যদি তাকমিলাতে তাফসির করতে মনে চায়, তাহলে আগেই করো যাতে মাসআলা-মাসায়েল বুঝতে সহজ হয়ে যায়। দাওরার পর আর এগুলো পড়ে কোনো ফায়দা নেই। তবে তাকমিলাতে ফেকাহের কথা ভিন্ন। এটা দাওরার পরই পড়তে হবে।

তাওহীদ আদনান : হুজুর তাহলে নেসাবের ক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : যেহেতু আমাদের নেসাব দুর্বল তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় হলো, নেসাব মজবুত করার বিষয়ে জোরদার ফিকির করা।

তাওহীদ আদনান : নেসাব জোরদার করার পদ্ধতিটা কী হতে পারে?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : নেসাব জোরদার করার জন্য নেসাবটিকে মূলত দুটি অধ্যায়ে ভাগ করা দরকার। প্রথম অধ্যায় হবে প্রথম জামাত থেকে শরহে বেকায়া পর্যন্ত। আর দ্বিতীয় অধ্যায় হবে হেদায়া থেকে দাওরা পর্যন্ত। নিয়ম থাকবে, প্রথম অধ্যায়ের সফলতার পরই যেতে পারবে দ্বিতীয় অধ্যায়ে। আর সফলতার মাপকাঠি হলো যথাযথ যোগ্যতা অর্জন হওয়া। আবার প্রথম অধ্যায় ও দ্বিতীয় অধ্যায়ের মাঝে থাকবে তাকমিলাতের একটি অতিরিক্ত অধ্যায়। এ অধ্যায়টা থাকবে ঐচ্ছিক।

কেউ চাইলে পড়বে, না চাইলে নেই। তবে কেউ যেদি নেসাবের প্রথম অধ্যায়ে যথাযথভাবে সফল হতে না পারে এবং যথাযথ যোগ্যতা অর্জন করতে না পারে তাহলে তাকে অবশ্যই নেসাবের দ্বিতীয় অধ্যায়ে যেতে হলে দুই নেসাবের মাঝের এই অতিরিক্ত অধ্যায় পার করেই যেতে হবে। তখন আর তার জন্য এটা ঐচ্ছিক থাকবে না। বাধ্যতামূলক করা হবে। এরপর সে তাকমিলাতের অতিরিক্ত অধ্যায় শেষ করেই তবে দ্বিতীয় অধ্যায়ে উত্তীর্ণ হতে পারবে। নতুবা নয়। কেননা পড়ালেখার মূল ভিত্তিই হলো হেদায়ার আগ পর্যন্ত।

তাই যোগ্যতা যতটুকু অর্জন করার হেদায়ার আগেই করে নিতে হবে। হেদায়া থেকে শুরু করে হেদায়ার পর আর যোগ্যতা অর্জনের সময় থাকে না। তখন হলো যোগ্যতাকে কাজে লাগানোর সময়।

তাওহীদ আদনান : আচ্ছা তাহলে এই যে শরহে বেকায়া পর্যন্ত পড়েও যে বর্তমান সময়ে ছাত্রদের যথাযথ যোগ্যতা অর্জন হচ্ছে না, এর পেছনে কী কারণ রয়েছে? কেন অর্জন হচ্ছে না যথাযথ যোগ্যতা?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : সুন্দর একটি পয়েন্ট বলেছো। কেনো যোগ্যতা হচ্ছে না বা যোগ্যতা না হওয়ার পেছনে কারণ কী? আসলে কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন না হওয়ার পেছনে মূল কারণই হলো এলেমের প্রতি অনাগ্রহ। মূলত এই অনাগ্রহের কারণেই অর্জন হচ্ছে না যথাযথ যোগ্যতা।

তাওহীদ আদনান : অনাগ্রহটা তৈরির কারণ তাহলে কী? এটা কি পূর্বে ছিল না? না থাকলে বর্তমানে কোত্থেকে এলো? বা কীভাবে এলো? আর যদি এমন হয় যে, পূর্বেও ছিল, তাহলে পূর্বে কেন অন্তরায় হয়নি এই অনাগ্রহ?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : আসলে কারণ মূলত আমরা নিজেরাই। একটু পেছনের দিকে তাকাও। আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি রহ.-এর সময়ও দেওবন্দে দাওরায় ছাত্র ছিল মাত্র ৩৫ জন। আর বর্তমানে সেখানে ছাত্র সংখ্যা ১৫০০। এই ছাত্র বৃদ্ধির বিষয়টা শুরু হয়ছে মাদানি রহ.-এর সময় থেকে। কয়েক বছর পূর্বেও পুরো মাদরাসায় ছাত্র ছিল কেবল ৮০০। আর বর্তমানে পুরো মাদরাসায় ছাত্র হয়ে গেছে ৪০০০। তো দিন দিন যে এতো ছাত্র বাড়তেছে এর কারণ কী বলতে পারো?

তাওহীদ আদনান : জি সম্ভবত এলেমের প্রতি আগ্রহ বাড়তেছে মানুষের, তাই ছাত্রও বাড়তেছে সব জায়গাতেই।

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : (হাসতে হাসতে) কী বললে তুমি? এলেমের প্রতি আগ্রহ? তো পূর্বের যুগে কি মানুষের মাঝে এলমের প্রতি আগ্রহ ছিল না? না সব আগ্রহ কেবল তোমাদের এই বড় বড় মোবাইলের যুগেই?

তাওহীদ আদনান : হয়তো আগেও আগ্রহ এমনই ছিল। বা কম বেশি হতে পারে। তবে আগে তো মানুষ সংখ্যায়ও কম ছিল। বর্তমানে মানুষের সংখ্যা বেশি। তাই ছাত্রও বেশি। এমন কিছু হতে পারে। তবে সঠিক জানি না।

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : তোমার যুক্তি এক হিসেবে ঠিক আছে। তবে এটা মূল বিষয় নয়। বরং মূল বিষয় হলো অন্যটা। খেয়াল করে দেখো বর্তমান সময়ের ছাত্ররা মাদরাসায় কার আগ্রহে আসে? নিজ আগ্রহে নয়। মা-বাবার আগ্রহে। আর পূর্বেকার সময়ের ছাত্ররা তো মাদরাসায় আসতো নিজ আগ্রহে। এলেমের আগ্রহে। ফলে পড়া-লেখায়ও উন্নতি হতো। কিন্তু বর্তমান সময়ের ছাত্রদের বিষয়টি এমন নয়।

তারা যেহেতু স্বেচ্ছায় আসছে না, বরং তাদের মা-বাবা মাদরাসায় দিয়ে যাওয়ার দরুন তারা মাদরাসায় পড়ে রয়েছে, তাই তাদের উন্নতিও হচ্ছে না। আর যে নিজ আগ্রহে আসেনি বা যার মাদরাসায় আসার পেছনে বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই তার পড়া-লেখার প্রতিই বা আগ্রহ আসবে কোত্থেকে? পড়া-লেখার প্রতি যার আগ্রহই নেই সে উন্নতিই বা করবে কোত্থেকে? তো এক্ষেত্রে এই স্বেচ্ছায় না আসাটাই অনাগ্রহ তৈরির মূল কারণ বলা চলে। ফলে বর্তমান সময়ে চাহিদানুপাতে ছাত্রদের মাঝে কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন হচ্ছে না।

Related image
জামিয়া দারুল উলুম, করাচি, পাকিস্তান

তাওহীদ আদনান : এই একটাই কি মূল কারণ যা কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন না হওয়ার অন্তরায়?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : মূল কারণসমূহের মধ্যে একটা কারণ এটাও। তবে এটাই যে মূল কারণ তা তো বলিনি। মূল কারণের মধ্যে আরও কিছু বিষয় আছে। যেমন বর্তমানে পড়া-লেখার গতি পাল্টে গেছে। উস্তাদগণ ছাত্রদের থেকে সবক শুনেন না। এটাও একটা বিশেষ কারণ। পূর্বেকার সময়ে তো উস্তাদগণ নিয়মিত সবক শুনতেন। সবক না পারলে ছাত্রদের লজ্জিত হতে হতো।

তখন ছাত্ররা এই লজ্জা পাওয়ার ভয়েই সবক শিখে ফেলতো। কিন্তু বর্তমানে আর সেই অবস্থা নেই। এখন তো সবক শুনতে চাওয়া উস্তাদদের জন্য লজ্জার কারণ। ফলে উস্তাদগণও সবক শুনেন না। তাই ছাত্ররাও সবক ইয়াদ করে না।

তাওহীদ আদনান : আচ্ছা তাহলে এই যে উস্তাদগণ সবক শুনেন না বা ছাত্ররা সবক ইয়াদ করে নাÑ যেটাই বলি, এর দায়ভারটা মূলত কাদের? উস্তাদদের না ছাত্রদের?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : এর দায়ভার যাদেরই হোক না কেন, এমন একটি সমস্যা যে বিরাজমান তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই, তাই না?

তাওহীদ আদনান : জি, এমন একটি বিষয় তো আমরা দেখেই আসছি। তবুও যদি একটু স্পষ্ট করতেন, এর দায়ভারটা মূলত কাদের? বা এমনটা কেন হচ্ছে? পূর্বে তো ছিল না এই সমস্যাটা। তো তখনই বা কেন ছিল না?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : আসলে তুমি তো আমাকে বিপদে ফেলে দিলে। আমি কাকে ছেড়ে কার ওপর দায়ভার চাপাবো? তবুও বলি দায়ভারের জায়গাটা মূলত এখানে খালি। মূল সমস্যা হলো পূর্বেকার সময়ে তো মাদরাসাগুলো ছোট ছোট ছিল। ছাত্র ছিল অল্প অল্প। তাই উস্তাদগণ চাইলেই যে কাউকে সবক ধরতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে মাদরাসা হয়ে গেছে বড় বড়। তাই ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব নয় সকলের সবক ধরা। তদুপরি নিয়মটা চালু থাকা দরকার।

একেবারে বন্ধ করে দিলে ছাত্ররা তো স্বাধীন হয়ে যাবে। তার চেয়ে যদি প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে সবক ধরা হয় তাহলেও অন্তত সবার মাঝে এই ভীতিটা থাকবে। তখন সকলে অন্তত এই ভয়ে হলেও সবক ইয়াদ করবে যে, না জানি আজ কাকে সবক ধরে বসে!

তাওহীদ আদনান : আরও কি কোনো কারণ আছে বলে মনে করেণ? থাকলে কী হতে পারে সেগুলো?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : প্রথমেই তো বললাম কারণ আছে বহু। কয়টা বলবো? এখানে আলোচনার সুবাদে যা উঠে আসছে তাই তো বলছি। অন্য তো আরও বহু কারণ রয়েছে। সেগুলোও নির্ণয় করা দরকার। যেমন বর্তমানে ছাত্র কর্তৃক এবারত পড়ার প্রচলন উঠে গেছে। ছাত্ররা এবারত না পড়াটাও একটা মূল কারণ কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন না হওয়ার পেছনে। তাই উচিত হলো প্রথম জামাত থেকে অন্তত শরহে বেকায় পর্যন্ত সকল জামাতে এবারত পড়বে ছাত্ররা। তাহলেই কেবল পড়া-লেখায় উন্নতি হবে। কিন্তু বর্তমানে তো এই নিয়ম কোথাও পাওয়া যায় না। এটা দুঃখজনক।

তাওহীদ আদনান : হুজুর আপনি বললেন ছাত্ররা এবারত পড়ে না। কিন্তু আমরা তো দেখি সব জায়গাতেই শরহে বেকায় পর্যন্ত তো ছাত্ররা এবারত পড়েই এমনকি শরহে বেকায়ার পরও একদম দাওরা পর্যন্ত বা আরও এগুলো তাখাসসুসাত ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই এবারত তো ছাত্ররাই পড়ে। তাহলে এ বিষয়টিকে কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন না হওয়ার পেছনে অন্তরায় ধরাটা কেমন?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : আহহা! তুমি এবারত পড়ার অর্থটাই বুঝোনি। এবারত পড়ার দ্বারা সম্ভবত তুমি বুঝেছো আমাদের বর্তমান সময়ে এবারত পড়ার প্রচলিত নিয়ম। কিন্তু এবারত পড়ার দ্বারা মূল উদ্দেশ্য কী সেটা তাহলে তুমি জানোই না। এবারত পড়ার মানে হলো, এবারত পড়াসহ তরজমা করা, তাশরিহ করা সবই ছাত্রের দায়িত্ব। উস্তাদ শুধু শুনবেন এবং ভুল হলে বলে দিবেন। এছাড়া আর কিছুই করবেন না। এই নিয়মটা আগে ছিল কিন্তু বর্তমানে নেই। আর এবারত পড়ার মূল মাকসাদ এটাই। কিন্তু এই নিয়ম এখন কোথায় আছে বলো তুমি?

তাওহীদ আদনান : জি হুজুর, আমি এবার বুঝতে পেরেছি বিষয়টি। তবে এ বিষয়টি যদিও ব্যাপকভাবে নেই, তবে কিছু কিছু জায়গায় আছে। যেমনÑ আমি বাংলাদেশে থাকতে যে মাদরাসায় পড়েছি সেটা ঢালকানগর মাদরাসা নামে পরিচিত। সেই মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা জাফর আহমাদ সাহেব দা.বা. যিনি করাচি হযরতের খলীফা।

সম্ভবত আপনি চিনেনও তাকে। আপনাকে গত বছর সেই মাদরাসায় একটি প্রোগ্রামে দাওয়াতও করা হয়েছিল। কিন্তু বিশেষ কোনো কারণে হয়তো আপনি যেতে পারেননি। সেই মাদরাসায় একজন উস্তাদ আছেন যাকে নেত্রকোণা হুজুর বলা হয়। অই নেত্রকোণা হুজুর আমাদের এভাবে পড়াতেন। অনেক উপকার পেয়েছিলাম এই পদ্ধতিতে পড়ে।

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : আমি চিনি মাওলানা জাফর আহমাদ সাহেবকে। অনেক ভালো মানুষ তিনি। তাকে অনেক মুহব্বতও করি আমি। তবে তুমি যেটা বললে যে, অই মাদরাসায় এই নিয়ম আছে তা মানলাম। তবে সেটাও তো কেবল একজন উস্তাদের কথা বললে। সবাই তো আর এরকমভাবে পড়াচ্ছেন না, তাই না? তো দু-একজন নিয়মটা চালু রাখলেও তো বৃহৎ ক্ষতি যেটা হওয়ার, সেটা কী আর বন্ধ থাকবে? তো ক্ষতি যেটা চালু রয়েছ সেটা চালু থাকবেই।

তাওহীদ আদনান : জি অবশ্যই। তো হুজুর, সংক্ষেপে আরও কিছু মৌলিক কারণ যদি বলতেন!
মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : দেখো বর্তমান সময়ে ছাত্রদের মাঝে মুতালাআর অভ্যাস কমে গেছে। ছাত্ররা মুতালাআ করে দরসে আসে না। মুতালাআ না করলে কখনো কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন হবে না। এরপর ছাত্রদের মাঝে উস্তাদদের প্রতি শ্রদ্ধা কমে গেছে।

ছাত্ররা উস্তাদদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা বজায় না রাখতে পারলেও কিন্তু কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন হবে না। কারণ এলেম হলো সিনা-বাসিনা। এখন উস্তাদের সিনা থেকে যদি ছাত্রের সিনায় এলেম নিতেই হয় তাহলে উস্তাদের প্রতি ছাত্রের শ্রদ্ধা বজায় রাখা জরুরি। এরপর তাকরারের গুরুত্ব কমে গেছে ছাত্রদের মাঝে। তাকরার করাও অনেক উপকারী যোগ্যতা অর্জনের জন্যে। এরপর দরসে ছাত্ররা উস্তাদদের বলা কথাগুলো নোটও করে না ঠিক মতো। দরসে উস্তাদের কথা নোট করারও ফায়দা অনেক। এরপর ছাত্ররা সবক ইয়াদ করে না তাতো বললামই। এর জন্য মূল কারণ তারাই, যে সবক ধরা হয় না।

সবক ধরা হলেই ছাত্ররা সবক ইয়াদ করতো। আর নিয়মিত সবক ইয়াদ করলে যোগ্যতা তার হবেই। এতে কোনো সন্দেহ নেই।

Image result for darul uloom karachi
দারুল উলুম যাকারিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা

তাওহীদ আদনান : হুজুর আপনি বলেছিলেন ছাত্রদের মাঝে পড়া-লেখার প্রতি অনাগ্রহের দরুন কাক্সিক্ষত যোগ্যতা তৈরি হচ্ছে না। তো এই অনাগ্রহ তৈরির পেছনে বিশেষ আর কোনো কারণ আছে কিনা আপনার মতে?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : হ্যাঁ, আছে। বর্তমান সময়ে মারপিট করার একটি প্রবণতা আছে অনেক মাদরাসায়। এই মারপিট একটা ক্ষতিকর দিক। মারপিট করে মূলত কোনো ফায়দা হয় না। বা ফায়দা যতটুকুই হোক ক্ষতি তার চেয়ে বেশি। কেননা একটা ছাত্র যখন প্রায় প্রায়ই মার খেতে থাকবে তখন সে অতিষ্ঠ হয়ে যাবে। ফলে এলেমের প্রতি তার অজান্তেই একটা অনাগ্রহ তৈরি হয়ে যাবে। তখন সে পড়া-লেখায় অমনোযোগী হয়ে যাবে। সে ভাববে আমি কিছু পারি না। তাই সে পড়বেও না। এভাবে এভাবে সময় কেটে যাবে কিন্তু তার যোগ্যতা বা দক্ষতা আর অর্জন হবে না।

তাওহীদ আদনান : মারপিট তো হুজুর উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে করা হয়। যেসব ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না তাদেরই তো মারপিট করা হয়। তাহলে এখন যদি মারপিটই বন্ধ করে দেয়া হয়, তো যাদের নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট তাদের কীভাবে কী করবেন উস্তাদগণ?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : যদি কোনো ছাত্র উচ্ছৃৃঙ্খল হয় আর উস্তাদ তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন তাহলে মুহতামিম সাহেবের শরণাপন্ন হবেন। মুহতামিম সাহেবও যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, তাহলে তিনি তার গার্ডিয়ানকে খবর দিবেন। সে তার গার্ডিয়ানের কথাও যদি না মানে তাহলে গার্র্ডিয়ান তাকে অন্য মাদরাসায় ভর্তি করে দিবেন। ব্যস, সমাধান।

তাওহীদ আদনান : কেন হুজুর? অন্য মাদরাসায় ভর্তি করলে কী ফায়দা? তার অভ্যাস তো থেকেই যাবে। কথা তো একই। উচ্ছৃঙ্খলতা এখানেও করবে ওখানেও করবে। তাহলে অন্য মাদরাসায় ভর্তি করার মাকসাদ কী?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : শোনো হাদিসে হুবহু এরকমই একটি ঘটনা আছে। ঘটনাটি হলো, যদি কারো মালিকানাধীন কোনো বান্দি ব্যভিচার করে তাহলে তাকে ব্যভিচারের শাস্তি দাও। ২য় বার যদি করে আবারো শাস্তি দাও। এরপর ৩য় বারও যদি করে আবার শাস্তি দাও। ৪র্থ বার যদি করে তাহলে তাকে বিক্রি করে দাও। এখন বলো, চারবার সে এখানে ব্যভিচার করলো। তো তাকে বিক্রি করে কী ফায়দা হবে? সে তো অন্যের মালিকানায় গিয়েও ব্যভিচার করবে। নাকি সে শুধরে যাবে? কোনটা? তাকে যে বিক্রি করতে বলা হলো এর কারণ কী? সে অন্যের মালিকানায় গেলেই কি তার অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে যাবে? বলো কী কারণে হাদিসে তাকে বিক্রি করে দিতে বলা হয়েছে?

তাওহীদ আদনান : তা তো বলতে পারি না। হুজুর, আপনিই যদি বুঝিয়ে দিতেন বিষয়টি!

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : শোনো যুক্তি তো চলেই যে অন্যের মালিকানায় গেলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বিক্রির দ্বারা এখানে অন্যের মালিকানায় গিয়ে শুধরে যাওয়া মাকসাদ না। মাকসাদ ভিন্ন কিছু। অর্থাৎ এখানে মূল মাকসাদ হলো বর্তমান মালিক তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তাই বিক্রি করে দিতে বলা হয়েছে। যাতে অন্য মালিক তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। হুবহু ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এমনই। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো ছাত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের উচিত গার্ডিয়ানকে ডেকে বুঝিয়ে দেয়া যে, তাকে যেন অন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে দেয়া হয়। যাতে অন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

তাওহীদ আদনান : বর্তমান সময়ে পড়া-লেখার পেছনে এই অনাগ্রহের মূল কারণ কী?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : মূল কারণ তো ধরা যায় না, তবে বিশেষ একটি সমস্যা হলো বর্তমান সময়ের মোবাইল। ছোট-বড় যেটাই হোক মোবাইল বলতেই ক্ষতিকারক। মোবাইলের ব্যাপারে কঠোর থেকে কঠোর হওয়া উচিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের। ছাত্ররা তো এখন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল খোঁজে। কিতাব খোঁজে না। সকালে উঠেই মোবাইল নিয়ে দেখে কে কে কল দিলো? কে কে ম্যাসেজ দিলো? কিতাবের পরিবর্তে মোবাইল তাদের নিত্যসঙ্গী।

আগের যমানায় মোবাইল ছিল না। ফলে তখন ছাত্রদের মাঝে এলেমের প্রতি আগ্রহ ছিল। বর্তমান সময়ে মোবাইলই ছাত্রদের ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন তো ছাত্রদের আগ্রহ মাত্র একটাই। মোবাইলই তাদের সবকিছু। এই মোবাইলের ব্যাপারে ছাত্রদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো উচিত। তাই মোবাইলের ব্যাপারে যতো কঠিন থেকে কঠিন ব্যবস্থা নেয়া হবে ততই ফায়দা। মোবাইল ব্যবহার সম্পূর্ণরুপে বন্ধ করা দরকার। নেটওয়ালা মোবাইল তো চালাতে পারবেই না ছাত্ররা। এমনকি ছোট মোবাইলও চালাতে পারবে না।

মোবাইল বলতেই ক্ষতিকারক। তাই কর্তৃপক্ষের উচিত এই একটি বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা। এই মোবাইলই সব সমস্যার মূল উৎস। মোবাইল চালানো বন্ধ করলেই অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। মোট কথা মোবাইল চালানো যাবেই না। শুধু এই মোবাইলটা বন্ধ করা যায় দেখবে সবক্ষেত্রে উন্নতি হবে। পড়া-লেখা, আমল-আখলাক, নামাজ-কালাম ও মুআমালা-মুআশারা সবকিছু নিয়ম মাফিক চলবে। একমাত্র এই মোবাইল রোধ করতে পারলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ছাত্রদের ধ্বংসের একমাত্র উপকরণ এই মোবাইলই।

তাওহীদ আদনান : ছাত্রদের মাঝে কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জনের জন্য মাদরাসা কর্তৃপক্ষের বিশেষ কোনো করণীয় আছে?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : বিশেষ করণীয় বলতে আর কী? অনেক বিষয়ই তো বললাম। তবে একটি বিষয় বলা হয়নি। সেটাই বলি। মাদরাসা কর্তৃপক্ষের উচিত ছাত্র-সংখ্যানুপাতে উস্তাদ নিয়োগ দেয়া। যাতে উস্তাদগণ ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। মাদরাসাগুলোর তো বর্তমান পরিস্থিতি এমন যে, মাদরাসায় প্রথমে উস্তাদ নিয়োগ দেয়া হয় ২৫-৩০ জন। এরপর ছাত্র ভর্তি নেয়া শুরু হয়। এখন ছাত্রসংখ্যা যদি ২০০ হয় তাহলেও এই উস্তাদগণই পরিচালনা করেন, আবার ছাত্রসংখ্যা ২০০০ হলেও এই উস্তাদগণই পরিচালনা করেন। তো যখন ছাত্রসংখ্যা অতিরিক্ত হয়ে যায় তখন ছাত্ররা আর নিয়ন্ত্রণে থাকে না উস্তাদদের।

আর ছাত্ররা যদি উস্তাদদের নিয়ন্ত্রণেই না থাকে তো ছাত্ররা উস্তাদদের থেকে কী ফায়দা হাসিল করবে? আর ছাত্রদের কী যোগ্যতা তৈরি হবে? তাই মাদরাসা কর্তৃপক্ষের উচিত ছাত্রসংখ্যানুপাতে উস্তাদ নিয়োগ দেয়া।

তাওহীদ আদনান : শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে আপনার বিশেষ কোনো মূল্যায়ণ থাকলে বলুন!

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে মূল বিষয় তিনটি। এই তিনটি বিষয়ের উপরই তালিম নির্ভরশীল।
প্রথম হলো, উস্তাদের ইলমি যোগ্যতা। দ্বিতীয় হলোÑ ছাত্রের নিরলস মেহনত। তৃতীয় হলোÑ নিখুঁত সিলেবাস। আবার ওই তিনটি বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রথম দুইটি। কেননা যদি উস্তাদের ইলমি যোগ্যতাই কম থাকে, তাহলে সুন্দর সিলেবাসে কী আসে যায়? শিক্ষার উন্নতি হবেই না বলতে পারি। আবার যদি উস্তাদের যোগ্যতা থাকে কিন্তু ছাত্রের মেহনত নেই তাহলেও ফায়দা নেই। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, তিনটি বিষয়ের মধ্যে তৃতীয়টি প্রথম দুটির ওপর নির্ভরশীল। প্রথম দুটি যথাযথভাবে পাওয়া গেলেই কেবল তৃতীয়টি কাজে আসবে। নতুবা নয়।

তাওহীদ আদনান : তো এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : তোমাদের কোনো করণীয় নেই। মূল করণীয় হলো প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের। সকল প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষেরই উচিত অন্তত পক্ষে শরহে বেকায়া পর্যন্ত হলেও যোগ্যতাসম্পন্ন উস্তাদ নিয়োগ দেয়া এবং মেহনতকারী ছাত্র ভর্তি নেয়া। উভয়টি হয়ে গেলে এবার সিলেবাসকে উপযুক্তকরণের ফিকির করা। তাহলেই কেবল তালিমটা ফলপ্রসূ হবে।

তাওহীদ আদনান : সবাই তো যোগ্যতাসম্পন্ন উস্তাদই নিয়োগ দিয়ে থাকেন। কিন্তু যোগ্যতার মানদ-টা কী? সেটা জানতে চাই!

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : নাহ! কে বলেছে তোমাকে সবাই যোগ্যতাসম্পন্ন উস্তাদই নিয়োগ দিয়ে থাকেন? এটা তোমার একটি ভুল ধারণা। আরে বর্তমানে তো মাদরাসাগুলোর অবস্থা হলো তারা খোঁজে কার বেতনের চাহিদা সবচেয়ে কম? তাকেই সবাই নিয়োগ দিতে উঠে পড়ে লাগে। কার যোগ্যতা কত বেশি অধিকাংশ লোকই তা খোঁজে না। এমনকি যাকে নিয়োগ দেয়া হলো তার যোগ্যতা কতটুকু তাও একটিবার ভাবে না। বাস্তবতা তো এটাই যে, অধিকাংশ লোকই যোগ্যতার বিচারে উস্তাদ নিয়োগ দেয় না। নিয়োগ দেয় বেতনের বিবেচনায়। আর যোগ্যতার মানদ-ের কথা বললে না? যোগ্যতার মানদ- হলো যেই উস্তাদ যেই কিতাব পড়ান সেই উস্তাদের অন্তত পক্ষে সেই কিতাবটা ফাস্ট টু লাস্ট ইয়াদ থাকা। নতুবা তাকে যোগ্যতাসম্পন্ন ধরা হবে না।

Image result for al azhar university
জামিয়া আল আযহার, মিশর

তাওহীদ আদনান : কোনো উস্তাদ কিতাবের যে অধ্যায় যখন পড়াবেন তার তখন সেই অধ্যায় ইয়াদ থাকলেই তো হলো। পুরো কিতাব শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইয়াদ না থাকলে ক্ষতি কী?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইয়াদ থাকার ব্যাপারে যেটা বলেছি সেটা তো হলো যোগ্যতর মানদ-ের কথা। আর ক্ষতি হলো যদি কোনো উস্তাদের পুরো কিতাব ইয়াদ না থাকে, তাহলে ছাত্ররা তার থেকে সঠিকভাবে ফায়দা পাবে না। কেননা কিতাবের অনেক মাসআলা থাকে যা পূর্বের বা পরের সাথে সম্পৃক্ত। তো যখন কোনো মাসআলা তার পরবর্তী অধ্যায়ের সাথে সম্পৃক্ত হবে তখন তো প্রথম দিকে মাসআলাটি অস্পষ্ট থাকবে। তখন তো ছাত্রদের বিভিন্ন এশকাল থাকতে পারে মাসআলাটির ওপর।

তো উস্তাদ তখন কী উত্তর দিবেন ছাত্রদের? আর যদি উস্তাদের ইয়াদ থাকে কিতাব তাহলে তো তিনি সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হবেন। সুতরাং উস্তাদের ক্ষেত্রে যোগ্যতার মানদ-ই হলো কিতাবের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইয়াদ থাকা।

তাওহীদ আদনান : এ তো গেলো উস্তাদের যোগ্যতার কথা। তো ছাত্রদের মাঝে মেহনতের মেজাজ তৈরির ব্যাপারে উস্তাদের কি কোনো করণীয় আছে? থাকলে কী? না থাকলে ছাত্রদের মাঝে মেহনতের মেজাজ তৈরির পদ্ধতি কী?

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : ছাত্রদের মাঝে মেহনতের মেজাজ তৈরি ব্যাপারে করণীয় উস্তাদেরই। ছাত্রের জন্য জরুরি কেবল মনোযোগী হওয়া। বাদবাকি কাজ উস্তাদের। উস্তাদ মাসআলা ও মাসায়েলগুলো সহজ ও স্ন্দুরভাবে ছাত্রের সামনে পেশ করবেন। তো ছাত্রের মাঝে যখন এলেমের আগ্রহ না থাকবে তখনও সে যখন মাসআলা-মাসায়েলগুলো সহজেই বুঝতে সক্ষম হবে।

ফলে এলেমের প্রতি তার একটা আগ্রহ তৈরি হবে। আর আগ্রহটা তৈরি হয়ে গেলেই সে মেহনতী হয়ে যাবে। আর যদি তার জন্য মাসআলাগুলো বুঝা কঠিন হয় তাহলে সে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যাবে। ফলে এলেমের প্রতি তার অনাগ্রহ আরও বৃদ্ধি পাবে। তখন সে মেহনত করা বিলকুলই ছেড়ে দেবে। তাই উস্তাদগণ যত সুন্দর ও সহজভাবে মাসআলা-মাসায়েলগুলো উপস্থাপন করবেন ছাত্রদের মাঝে এলমের অগ্রহ ও মেহনত ততই বৃদ্ধি পাবে।

তাওহীদ আদনান : ছাত্রদের মাঝে মেহনতের মেজাজ বৃদ্ধির আরও কোনো উপায় থাকলে যদি বলতেন!

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : উপায় বলে তো শেষ করা যাবে না। কিন্তু দুই একটা যাই বলা হয় তাও তো আমলে আসে না। আমলে আনলে তো আসলে দুই একটা উপায়ই অনেক ফায়দা দিতো। যেমন ছাত্রদের মাঝে মেহনতের মেজাজ তৈরির ব্যাপারে আমি প্রায়ই বলে থাকি ছাত্রদের বেশি বেশি আকাবিরদের ইলমী ঘটনাবলি শোনাতে। এমন এমন ঘটনা শুনাতে হবে যার দ্বারা ছাত্ররা প্রভাবিত হয় বেশি। তো যখন আকাবিরদের ইলমি ঘটনাবলির প্রভাব ছাত্রদের মাঝে পড়বে তখন ছাত্রদের মাঝে অটোমেটিকই মেহনতের মেজাজ তৈরি হয়ে যাবে।

তাওহীদ আদনান : আচ্ছা তাহলে তৃতীয় যেই বিষয়টি ছিল নেসাব বা সিলেবাসÑ এ ব্যাপারে কিছু শুনতে চাই!

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : নেসাব বা সিলেবাসের কথা কথা তো প্রথমেও বলেছি, এটা আকাবিরদের ধারায়ই থাকবে। তবে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কিছুটা আধুনিকায়নও করতে হবে। নতুবা সমাজ আমাকে গ্রহণ করবে না। যুগ চাহিদার কোনো কমতি যদি থেকে যায় তাহলে সমাজ তো আমাকে ঠেলে দেবেই। তাই আকাবিরদের ধারাকে বজায় রেখেই নেসাব আরও উপযুক্ত করার প্রয়াস চালানোও খুব প্রয়োজন।

তাওহীদ আদনান : হুজুর আপনার লম্বা সময় নষ্ট করলাম। সময় দেয়ার জন্য শুকরিয়া।

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : জাযাকাল্লাহ তোমাকে। শিক্ষা-দীক্ষাবিষয়ক কথাগুলো তোমরা খেদমতের লক্ষ্যে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবে জেনে খুশি হলাম। ঠিক আছে তাহলে। ভালো থাকো। আর আমার শারীরিক অবস্থার জন্য দোয়ার দরখাস্ত রইলো সবার কাছে।

তাওহীদ আদনান : ফি আমানিল্লাহ। হুজুর, আমার জন্য এবং আমাদের আওয়ার ইসলামের জন্যও দোয়া কামনা।

মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী : ফি আমানিল্লাহ।

এসএস


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ