হাওলাদার জহিরুল ইসলাম : ভারতের মেওয়াত এলাকায় হজরতজি মাওলানা ইলিয়াস রহ.এর হাতে প্রতিষ্ঠা পায় তাবলিগ জামাত। পরবর্তীতে দিল্লির নিজামুদ্দীন থেকে এ দাওয়াতি কাজ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী।
বর্তমান পৃথিবীতে দ্বীনের যত মেহনত চলছে, তার মধ্যে দাওয়াতে তাবলিগ নিঃসন্দেহে সর্বাধিক সফল মেহনত। এই বরকতপূর্ণ মেহনত আজ দুনিয়ার সব জায়গায় পৌঁছে গেছে। পৃথিবীর সব দেশে এবং সব এলাকায় একই নিয়মে চলছে তাবলিগের কাজ।
দাওয়াতে তাবলিগের সব কাজ সুন্নাতে রাসুল মোতাবেক করা হয়। রাসুল সা. যেভাবে নামাজ পড়েছেন, যেভাবে খেয়েছেন, যেভাবে ঘুমিয়েছেন, যেভাবে মানুষকে ইসলামের পথে দাওয়াত দিয়েছেন-তার সবই অনুসরণ করা হয় তাবলিগের কাজে। পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের মাঝে কিভাবে পুরোপুরি ইসলাম আসে, সে ব্যাপারেও রয়েছে মাসতুরাতের মেহনত।
নিজে আল্লাহর হুকুম ও নবির তরিকা অনুযায়ী জীবন যাপনের পাশাপাশি নিজের পরিবারের সদস্যরা, পাড়া-প্রতিবেশী এবং আশপাশের সবাই যেন দ্বীনদার ও আল্লাহওয়ালা হয়ে যায় সে ব্যাপারেও ফিকির চলে তাবলিগে। উম্মত কিভাবে হেদায়েত পাবে, জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচবে, দাওয়াতে তাবলিগের এটাই প্রধান লক্ষ্য। তাই এখানে সাধারণ মুসলমানদের নিজ জান মালসহ আল্লাহর রাস্তায় সময় দেয়ার জন্য তাশকিল (উদ্বুদ্ধ) করা হয়।তিন দিন, ১০ দিন ও ৪০ দিন এবং সালের জন্য তাশকিল করা হয়।
তাবলিগ জামাতের মৌলিক পাঁচ কাজ। এই পাঁচ কাজ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এর দ্বারা একটা সমাজ খুব সহজেই পরিবর্তিত হতে পারে।
পাঁচ কাজ হলো, ১. প্রতিদিন মাশওয়ারা বা পরামর্শ করা। ২. প্রতিদিন মসজিদে ও ঘরে তালিম করা। ৩. দৈনিক আড়াই ঘণ্টার মেহনত করা । মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করার উদ্দেশ্যে আড়াই ঘণ্টা সময় ব্যয় করা। ৪. প্রতি সপ্তাহে নিজ মহল্লায় ও অন্য মহল্লায় গাশত করা। অর্থাৎ আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করার লক্ষ্যে ঘোরাফেরা করা। ৫. প্রতি মাসে আল্লাহর রাস্তায় তিনদিন সময় লাগানো।
তাবলিগ জামাতে এ ৫ কাজের অত্যাধিক গুরুত্ব রয়েছে। তাবলিগের মারকাজগুলো থেকে পাঁচ কাজের সঙ্গে জুড়ে থাকতে বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দিল্লির নিজামুদ্দিনের মাওলানা সাদ কান্ধলভির কিছু বক্তব্য ও আমির না শুরা-এই বিতর্কে অনেক তাবলিগি সাথী তাবলিগ জামাতের মৌলিক কাজগুলো থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।
এক সময় যারা দুনিয়ার সব খবর বাদ দিয়ে কেবল আল্লাহর ঘর মসজিদে তালিম জিকির আর ইবাদতে মগ্ন থাকতেন এখন তাদের মাঝে বিভক্তি, সমন্বয়হীনতার কারণে মৌলিক কাজ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
‘মাওলানা সাদ চাইলে মিনিটেই এ আগুন নেভাতে পারেন
এক পক্ষ নিজেদেরকে এতায়াতপন্থী বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। তারা দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারী বলে দাবি করে আসছেন। আরেক পক্ষ নিজেদেরকে শুরাপন্থী বলে দাবি করেন। তারা মূলত আমির বা একক নেতৃত্ব নয় আলমি শুরার মাধ্যমে তাবলিগ চলবে বলে দাবি করেন। এ নিয়ে দেশ বিদেশের মসজিদগুলোতে বিবাদ ও একে অপরকে মসজিদ থেকে বের করে দেয়ার মতো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।
তাবলিগের সাথীদের কীভাবে তাবলিগের মৌলিক কাজে ফেরানো যায় এবং উভয় পক্ষ শান্তি, সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে কাজ করতে পারে সে বিষয়ে কথা হয় দেশের তিন জন চিন্তাশীল আলেমের সঙ্গে।
ড. আফম খালিদ হোসেন
চট্টগ্রারেম ওমর গণি এম ই এস ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক দেশের শীর্ষ এই চিন্তক আলেম বলেন, তাবলিগ জামাতে চলমান বিভক্তি খুবই বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। সমাধান করতে চাইলে উভয় পক্ষকে এক জায়গায় বসতে হবে। এক দু বার বসেই সমাধান না হলে বার বার বসার প্রয়াস চালাতে হবে।
ভারতের দারুল উলুম দেওবওবন্দের উলামা হজরত ও নিজামুদ্দিন মারকাজের মুরুব্বীদের সম্মিলিত বৈঠকের মাধ্যমে সামাধানে আসতে হবে। তাবলিগ জামাতের উভয় পক্ষকেই নমনীয় হতে হবে, ছাড় দিতে হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে শুরা-এমারাত সংকট সামাধান হলে মাঠ পর্যায়ে বিভক্তি থাকবে না বলে আশা করা যায়।
তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা হজরত ইলিয়াস রহ. এর সেই চিন্তা চেতনা ও আদর্শের উপর তাবালিগের কাজকে ফিরিয়ে আনতে তাবলিগের বর্তমান মুরুব্বীদের চেষ্টা করা দরকার। অন্যথায় শত বছরের দাওয়াতি মেহনত এই বিভক্তির কারণে বাধাগ্রস্ত হবে।
তিনি মনে করেন, সমস্যার স্থায়ী সমাধানে তাবলিগ জামাতের নেতৃত্ব আলেমদের হাতে থাকা জরুরি। তাবলিগ জামাতে আলেম না থাকলে মেহনত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সাধারণ শিক্ষিতদের যারা তাবলিগের যিম্মাদারি পালন করছেন আমরা তাদেরও সম্মান জানাই। তবে মূল কাজে আলেমগণের থাকা চাই।
সাধারণ তাবলিগের সাথীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আম সাথীরা কোন প্রকারের বিবাদে জড়াবেন না। তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দাওয়াতি মেহনতের নিয়মিত আমল করবেন। যেখানে যে পক্ষ দাওয়াতে কাজ করছেন তাদেরকে সেখান থেকেই কাজ করে যেতে হবে।কোন অবস্থাতেই বিরোধি মনোভাব পোষণ করা উচিত হবে না।
মাওলানা নেয়ামাতুল্লাহ ফরিদী
মাদারীপুরের জামিয়াতুস সুন্নাহর মুহতামিম, দেশের এই চিন্তাশীল আলেম তাবলিগ জামাতে চলমান বিভক্তি দূর করতে করণীয় সম্পর্কে বলেন, সাধারণ তাবলিগি ভাইয়েরা উলামায়ে কেরামের পরামর্শ মোতাবেক কাজ করলে সংকট কেটে যাবে।
উলামায়ে কেরাম যেভাবে কাজ করতে পরামর্শ দেন সেভাবেই দাওয়াতের মেহনত করা চাই। তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হজরত ইলিয়াস রহ. এর তাবলিগ জামাতের নেতৃত্ব গাইরে আলেমদের হাতে চলে যাওয়ার যে আশংকা করেছিলেন এখন তা-ই চলমান। এ জায়গাটা থেকে বেরিয়ে আসা চাই। তাহলে চলামান বিভক্তির অবসান হতে পারে।
সাধারণ তাবলিগি মুসল্লিদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ তাবলিগি সাথীদের কাজ হবে মেহনত নিয়ে পড়ে থাকা। সংঘাত বা বিবাদে না জড়ানো। আলেমদের সমালোচনা, গীবত না করা। আলেমদের অধীনে থেকে তাবলিগের দৈনন্দিন কাজ আঞ্জাম দেয়া। আলেমদের মাঝে দূরত্ব তৈরির চেষ্টা না করা।
মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক
তাবলিগি সাথীদের নিয়মতান্ত্রিক দাওয়াতি মেহনতে ফেরাতে তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, দীনের বড় বড় কাজে কোন কোন সময় কিছু সমস্যা হতে পারে। তেমনটা তাবলিগের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। তবে একটু দেরি হলেও সমস্যার সামাধান হয়ে যাবে। সাধারণ তাবলিগি সাথীদের এ নিয়ে ভাবানার কিছু নেই।
সাথীরা কোন বিরোধে যাবেন না। তারা কেবল দাওয়াতি মেহনত নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন।সমস্যার সমাধান বিষয়ে কাজ করবেন উলাাময়ে কেরাম। তাবলিগের সাথীদের কাজ হবে, পরস্পররে মাঝে, উলামাদের সঙ্গে মুহাব্বত বাড়ানো, জোরদার করা।
তাবলিগ জামাতের অন্যতম শিক্ষা হলো সুসম্পর্ক তৈরি করা। একজন তাবলিগি সুসম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে অমুসলিমকেও ইসলামের সৌন্দর্যের দিকে আহ্বান করে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে তাবলিগি সাথীদের পরস্পরের মাঝেই সম্পর্কের অবনিত পরিলক্ষিত হচ্ছে।সামান্য এক বিভক্তিকে কেন্দ্র করে তাবলিগের উদারতার প্রতীক একরাম-মুহাব্বত ভুলে যাওয়া সমীচীন হবে না। সমস্ত সাথীদে মাঝে মুহাব্বত, পারস্পরিক সম্মানবোধ জাগিয়ে তুলতে না পারলে তা মেহনতের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাাঁড়াবে।
সিলেবাসে থাকছে মাওলানা আবুল ফাতাহ’র ‘দেওবন্দ আন্দোলন’
পাকিস্তানের হাজি আবদুল ওয়াহহাবকে মাওলানা সাদের চিঠি
এসএস