এ এস এম মাহমুদ হাসান
বিশেষ প্রতিবেদক
মেয়ের নাম তাবাসসুম ঐশি (ছদ্ম নাম)। ১১ বছর বয়সী ঐশি তিন ভাই বোনের মধ্যে বড়। বাবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উচ্চ পদস্থ প্রভাবশালী কর্মকর্তা। বাবা মায়ের একান্ত ইচ্ছায় সে এখন রাজধানীর একটি মাদরাসা পড়াশোনা করছে।
শেফা নামের আরেক কিশোরী প্রাথমিক স্কুলে সমাপনী পরীক্ষায় গোল্ডেন প্লাস অর্জন করে মাদরাসায় ভর্তি হয়। শেফার ছোট দুই ভাই বোনকেও মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে হাফেজে কুরআন বানাবেন বলে বলছিলেন তার অফিসার বাবা।
তারেক মাহি। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাড্ডায় নিজস্ব বাড়িতে থাকে মাহির পরিবার। কুরআনের হাফেজ মাহি এখন পড়ছে উত্তরার আল মানহাল নামে একটি মাদানি নেসাব মাদরাসায়। বাবা সাবেক লেফটেনেন্ট কর্নেল।
মিরপুরের রূপনগরে ঢাকা আইডিয়াল ক্যাডেট মাদরাসার হিফজ বিভাগের মেধাবী ছাত্র এনামুল হাসান। দুই ভাই বোনের মধ্যে সে ছোট। বড় বোন বর্তমানে বুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।
এনামুল হোসেনের বাবা এনায়েত হোসেন সোনালী ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা। ছেলে কুরআনের হাফেজ হওয়ার পরে পূনরায় জেনারেল লাইনে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানানোর শখ রয়েছে। প্রতিবেদকের কাছে এমনটিই আশা ব্যক্ত করছিলেন ব্যাংকার বাবা এনায়েত হোসেন।
কওমি ধারার মাদরাসাগুলোতে জেনারেল শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের এমন অগণিত শেফা, মাহি, এনামুলের সন্ধান মেলে, যারা মাদরাসায় ভর্তি হয়ে ইতোমধ্যে হিফজ সম্পন্ন করেছে অথবা নাজেরায়ে কুরআন বা হিফজ পড়ছে।
অসংখ্য মাদরাসায় সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পাশাপাশি উচ্চ মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা মাদরাসায় পড়ছে।
তবে অনুসন্ধান করে পাওয়া তথ্য বলছে, প্রাথমিক স্তরে কওমি ধারার বড় বড় মাদরাসাগুলোর তুলনায় প্রাইভেট মাদরাসাগুলোকে এসব উচ্চবিত্ত পরিবার সন্তানদের অংশগ্রহণটা একটু বেশি। তবে বড় কওমি মাদরাসায় বিশেষত কিতাব বিভাগ বা আলেম স্তরে এমন পরিবারের বহু সন্তানদেরও খোঁজ পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে শুধু মিরপুরে অন্তত পাঁচটি প্রাইভেট মাদরাসা এমন পাওয়া গেছে, যেগুলোতে অনাবাসিক বা ডে-কেয়ার সিস্টেমে মাসে আট থেকে বারো হাজার টাকা ব্যায়ে কেবল এসব জেনারেল শিক্ষিত পরিবারের সন্তানরাই হিফজ অথবা নাজেরায়ে কুরআন বিভাগে পড়ছে।
জেনারেল শিক্ষত পরিবারগুলো কেন হঠাৎ মাদরাসা ও হিফজুল কুরআন শিক্ষার প্রতি ঝুঁকছে?
কথা বলছিলাম প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কর্মকর্তা ... সাথে। নিজে পুরো দস্তুর জেনারেল শিক্ষিত ও সরকারি বড় কর্মকর্তা হওয়া সত্বেও সন্তানদের জন্য মাদরাসা শিক্ষা বেছে নিলেন কেন?
চলতি শতকে আধুনিক যুগের ছেলে মেয়েদের চারিত্রিক অধঃপতনের নানান দিকের পর্যালোচনা করে তিনি আমাকে বলছিলেন, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় আত্মশুদ্ধি গঠন ও চারিত্রিক পতন থেকে উত্তরণের দীক্ষা একেবারেই অনুপস্থিত।
আমার পরিচিত অনেকেই বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছে। যা অত্যন্ত নিষ্ঠুর আচরণ। অথচ পুরো পরিবারে মাত্র একজন ছেলে মাদরাসায় পড়েছে এমন সন্তানের বাবা মা বৃদ্ধাশ্রমে থাকে এমন তথ্য আমি পাইনি।
দেখুন ও সাবস্ক্রাইব করুন ourislam tv
আমার যে ধন সম্পদ রয়েছে, তা ছেলে মেয়েরা ভোগ করার পর আরো উচ্ছিষ্ট থাকবে। তাই কেবলমাত্র কর্মসংস্থানের আশায় উচ্চ শিক্ষার নামে ভার্সিটিতে পাঠাতে চাই না আমার সন্তানদের। তাছাড়া ইন্টারনেট ও টিভি প্রোগ্রামের ইসলামিক অনুষ্ঠানে প্রভাবিত হয়ে মাদরাসা শিক্ষার প্রতি উদ্বুদ্ধ হওয়ার কারণও বলছিলেন শেফার অফিসার বাবা।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিবৃত্তিক শিক্ষার অনুশীলনের দরুন উচ্চবিত্ত বা এলিট শ্রেণির লোকেরা জেনারেল ও মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার মাঝে তুলনামূলক হিসাব কষছে। ফলে মাদরাসা শিক্ষা ধারায় একটি গোছালো জীবন ব্যবস্থার যৌক্তিক ফলাফল বেরিয়ে আসছে। তাই এলিট শ্রেণির একটি অংশ চাইছে, তারা তাদের সন্তানদের পার্থিব জগতটাকে অন্তত সুশৃঙ্খল ও কলুষহীন করতে।
মাদরাসার ছেলেদের থেকে বেপরোয়া হওয়া, মা বাবাকে শারীরিক ও মানসিক আঘাত করা, তাদের কেয়ার না করা, অশালীন আচরণে ডুবে যাওয়া বা নেশায় বুধ হয়ে থাকার তথ্য তুলনামূলকভাবে নেই বললেই চলে।
মুফতি সাঈদ আহমাদ
হয়ত সে ভাবনা থেকেই এলিট শিক্ষিতরা মাদরাসা শিক্ষাকে উপযুক্ত ভাবছেন। এমনটিই বলছিলেন মিরপুর ৬ নং সেক্টরের বায়তুল ফালাহ মসজিদ ও মাদরাসা কমপ্লেক্সের খতিব মুফতি সাঈদ আহমাদ।
ইসলামকে নিয়ে বৈশ্বিক ষড়যন্ত্র বিশেষত আমেরিকার অতি মাত্রায় মুসলিম বিদ্বেষমূলক প্রচারণায় কৌতূহলি হয়ে হলেও মানুষ ইসলামি জীবন ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা ও পড়াশুনা করছে। ফলশ্রুতিতে একটি এলিট শ্রেণির মাঝে ইসলামের সুমহান জীবন ব্যবস্থা প্রভাব ফেলায় তারা মাদরাসা শিক্ষার প্রতি ঝুঁকছে।
মাদরাসা শিক্ষায় প্রথমেই ইসলামি জীবন ব্যবস্থার প্রধান লিপিবদ্ধ সংবিধান কুরআন শরিফ হিফজ করাকে তারা সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিচ্ছে। বলছিলেন মুফতি সাঈদ আহমাদ।
ইসলামি গবেষক, মাদরাসা শিক্ষা পর্যবেক্ষক হাফেজ মুফতি মামুনুর রশীদ। তার কাছেও জানতে চাইলাম জেনারেল পরিবারের অনেকে হিফজ পড়ছেন। এমন ধারণা সৃষ্টি হলো কিভাবে?
তিনি চলতি দশকে বেশি সংখ্যক জেনারেল পরিবারে হাফেজ সন্তান তৈরির মানসিকতা সৃষ্টি হওয়ার শুরুর গল্পটা বললেন ভিন্ন আঙ্গিকে। তিনি একটু রঙ মাখিয়ে ঢালিউডের সাবেক তারকাজুটি অনন্ত জলিল ও বর্ষার ছেলেকে মাদরাসায় পড়ানোর গল্পটা শুনালেন।
হাফেজ মুফতি মামুনুর রশীদ
তারকাদ্বয় একটি টিভিতে এক ছোট্ট শিশুর কণ্ঠে সুমধুর তেলাওয়াত শুনে প্রভাবিত হয়েছেন। আবার মাহে রমজানসহ বিভিন্ন সময়ে হাফেজ ছাত্রদের টিভিতে হিফজ প্রতিযোগিতার তেলাওয়াতে ও ইসলামিক টিভি প্রোগ্রামে অবশ্যই প্রভাবিত হচ্ছে একটি বোধসম্পন্ন আধুনিক ও জেনারেল শিক্ষিত সমাজ।
তাই চলতি দশকে মাদরাসার হিফজ বিভাগে তুলনামূলক জেনারেল শিক্ষত পরিবারের সন্তানরা বেশি। বলছিলেন মুফতি মামুনুর রশীদ।
এ ব্যাপারে প্রাইভেট মাদরাসা এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি মুফতি নেয়ামতুল্লাহ আমিন টেলিফোনে বলছিলেন, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের পারিবার আবহমানকাল ধরে ঐতিহ্যগত ভাবে শান্তিপ্রিয়। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আদব আখলাক, আচার ব্যবহারের প্রভাবে পরিবারগুলোতে মানসিক শান্তির বিস্তার ঘটে। কিন্তু জেনারেল শিক্ষিত অধিকাংশ পরিবারে রয়েছে গোমট অশান্তি।
নেয়ামতুল্লাহ আমীন বলছিলেন, আমার অনেক পরিচিত ও মুসল্লিরা বাসায় ঘুমোতে গেলে সন্তানদের ভয়ে দরজা বন্ধ করে ঘুমায়। তিনি অসংখ্য পরিচিতজনের নাম উল্লেখ করে বলছিলেন, এসব জেনারেল শিক্ষিত ধনাঢ্য পরিবার সন্তানদের মাদক, নেশা, সন্ত্রাস, মেয়েলি দুর্ঘটনা থেকে দূরে রাখতে অন্তত পার্থিব শান্তির জন্য সন্তানদের মাদরাসায় ভর্তি করছেন। আর সে ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা হিসেবে হিফজকে বেছে নিচ্ছেন।
মুফতি নেয়ামতুল্লাহ আমিন
সুখ্যাতি পাওয়া বড় কওমি মাদরাসার বদলে প্রাথমিক স্তরে প্রাইভেট মাদরাসায় ভর্তি হচ্ছে কেন?
তথ্যসূত্র বলছে, এসব জেনারেল শিক্ষিত ও ধনাঢ্য পরিবারগুলো সন্তানের জন্য প্রাথমিকভাবে প্রাইভেট মাদরাসাগুলোকেই বেছে নিচ্ছেন।
হাফেজ মুফতি মামুনুর রশীদ বলেন, বড় বড় কওমি মাদরাসার চেয়ে নগরীতে গড়ে ওঠা প্রাইভেট মাদরাসাগুলোয় ছাত্রদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার হয়। ক্লাশের সময়ে গেইটের সিকিউরিটির কড়াকড়ির সাথে সাথে ক্লাশের ফাঁকে অবকাশকালীন সময়েও মাদরাসা কর্তৃক শিক্ষকরাই সাধারণত ছাত্রদের গেইটের বাইরে ঘোরাফেরা, খেলাধুলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে দেখভাল বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকেন।
জেনারেল শিক্ষিত পরিবার আদূরে সন্তানকে মাদরাসার অভ্যন্তরীন ও বহিরাংশে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই ভর্তি করানোর মানসিকতা থেকেই প্রাইভেট মাদরাসাগুলোকে তারা বেছে নিচ্ছেন।
তবে মুফতি মামুনুর রশীদ বলছিলেন, ধনী গরিব সবার জন্য কিতাব বিভাগ বা আলেম স্তরে পড়ার জন্য বড় মাদরাসার বিকল্প নেই।
তবে অভিভাবকরা প্রাইভেট বা কিন্ডারগার্টেন মাদরাসাগুলোকে গুরুত্ব দেয়ার আলাদা কারণ হিসেবে স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়েছেন ঢাকার শনির আখড়ায় অবস্থিত মারকাজুত তানযীল আল ইসলামিয়া মাদরাসার মুহতামিম হাফেজ কারী মাওলানা সাইফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, প্রাইভেট মাদরাসাগুলোতে আলাদা করে কেমন শিশুবিভাগই থাকে এবং শিশুদের যত্নআত্মিতেই বিশেষ নজর দেয়া হয়। আর বড় মাদরাসাগুলোতে বেশি গুরুত্ব পায় উপরের শ্রেণিগুলো।
হাফেজ কারী মাওলানা সাইফুল ইসলাম
এছাড়াও প্রাইভেট মাদরাসাগুলো কুরআন হিফজ ও চর্চার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যেমন দেশে অনুষ্ঠিত নানা প্রতিযোগিতা ও বিদেশের আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতাগুলোতে তাদের পাঠানো এবং সেভাবে গড়ে তোলায় গুরুত্ব দেয়া হয়। যেমনটিতে বিশেষ গুরুত্ব দেয় মারকাজুত তানযীল আল ইসলামিয়া। বলছিলেন কাতার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদের বর্তমান খতিব মাওলানা সাইফুল ইসলাম।
মাদরাসার একজন অভিভাবকের কাছে তার ছেলের জন্য কোন ধরনের মাদরাসা বেশি পছন্দ তা জানতে চেয়েছিলাম ঢাকা আইডিয়াল ক্যাডেট মাদরাসায় পড়ুয়া মুহাম্মাদের উকিল বাবা আবদুল্লাহ।
তিনি বললেন, সন্তান আমাদের অতি আদূরে ও সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষায় একটু সেন্সেটিভ হওয়ায় আমরা আমাদের ছেলেকে প্রাথমিকভাবে প্রাইভেট মাদরাসায় ভর্তি করেছি। এতে আমরা প্রতিনিয়তই ছেলের লেখা পড়ার প্রোগ্রেস ও তার সার্বক্ষণিক অবস্থা সম্পর্কে প্রিন্সিপাল বা দায়িত্বশীল শিক্ষকের মাধ্যমে খোঁজ নিতে পারছি।
আরও পড়ুন: বিশ্বদরবারে দেশের মান উঁচু করা ৮ জন তারকা হাফেজ
-আরআর