মাওলানা যুবায়ের আহমাদ
আমাদের সমাজের এক শ্রেণির মানুষ অজ্ঞাতাবশত লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান (শবেবররাত) নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে করতে একে ‘ভাগ্য রজনী’ মনে করেন যা ঠিক নয়।
এ রাতে হায়াত, মওত, রিজিক ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয় এ ধারণা কুরআন হাদিসের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। সুরা দুখানের ৩-৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় কেউ কেউ এ রাতকে অন্তুর্ভুক্ত করতে চেয়েছেন। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চই আমি একে (পবিত্র কুরআন) এক মুবারক রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, আমি তো সতর্ককারী। এ রাতেই প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সুরা দুখান : ৩-৪)।
অর্থাৎ কুরআন নাজিলের রাতেই হায়াত, মওত, রিজিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্থির করা হয়। এখানে একটি ব্যাপার স্পষ্ট, যে রাতে (লাইলাতুম মুবারাকা) গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্থির হয় তা হলো কুরআন নাজিলের রাত।
আর কুরআনুল কারিম কোন রাতে নাজিল হয়েছে তা সচেতন মুসলিমমাত্রই জানার কথা। কারণ কুরআন কোন রাতে নাজিল হয়েছে, তা কুরআনুল কারিমে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চই আমি একে (কুরআনকে) লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ করেছি। (সুরা কদর : ১)।
সুতরাং এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ স্থির হওয়ার যে রাতের কথা বলা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে লাইলাতুল কদর। লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান (মধ্য শা’বানের রাত বা শবে বরাত) নয়।
সুরা দুখানের ৩য় আয়াতের ‘লাইলাতুম মুবারাকা’র ব্যখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির বলেন, ‘কোনো কোনো লোক এ কথাও বলেছেন, যে মুবারক রজনীতে কুরআনুল কারিম অবতীর্ণ হয় তা হলো শা’বানের পঞ্চদশ তম রজনী।
এটা সরাসরি কষ্টকর উক্তি। কেননা কোরআনের স্পষ্ট ও পরিষ্কার কথা দ্বারা কুরআনের রমজান মাসে নাজিল হওয়া সাব্যস্ত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা সুরা বাকারার ১৭৭ নং আয়াতে বলেছেন, ‘রমজান ওই মাস যাতে কোরআনুল কারিম অবতীর্ণ করা হয়।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ১৬/৬১০)।
শবেবরাত বা লাইলাতুল বারাআত কিংবা লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান ভাগ্য রজনী হওয়ার বিষয়টি যেমন ঠিক নয়, তেমনি এ ‘শবেবরাতের কোনো ভিত্তি নেই’ এ কথাও ঠিক নয়।
তবে একথা সত্য, ‘শবেবরাত’ শব্দটির অস্তিত্ব কুরআন হাদিসে কোথাও নেই। যেমন কুরআনে ‘নামাজ’, ‘রোজা’ শব্দগুলো নেই। আছে সালাতা এবং সাওম। শবেবরাত বা লাইলাতুল বারাআত নেই, কিন্তু লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান (মধ্য শা’বানের রাত) আছে ।
কিন্তু শবেবরাত বা লাইলাতুল বারাআত নামটিও অশুদ্ধ নয়। কারণ, শবেবরাত বা লাইলাতুল বারাআতের বারাআত মানে ভাগ্য নয় বরং বারাআত অর্থ হলো মুক্তি।
আল্লাহ তাআলা এ রাতে বান্দাদের ক্ষমা করে দেন তাই এ রাত মুক্তির রাত। এ রাতে কী আমল, তা সম্মিলিত, নাকি একাকী; এ রাতের বিশেষ পদ্ধতির কোনো নামাজ আছে কিনা তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে কিন্তু এ রাত যে ক্ষমার রাত তা অস্বীকারের সুযোগ নেই।
নির্ভরযোগ্য হাদিস দ্বারা তা প্রমাণিত। হজরত আবু মুসা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, মহানবী সা. বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা অর্ধ শা’বানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং মুশরিক ও মুশাহিন (বিদ্বেষপোষণকারী) ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (ইবনে মাজাহ: ১/৪৪৫)।
মুহাদ্দিনগণ এ হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। বিখ্যাত হাদিস গবেষক নাসিরুদ্দিন আলবানীর রহ. মতে এ হদিসটি হাসান। (সিলসিলাতুল আহাদিস আস সহিহাহ: ৩/১৩৫)।
সুতরাং মধ্য শা’বানের রাত বা শবে বরাত আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ক্ষমার এক বিশেষ সুযোগ এতে সন্দেহ নেই। তাই মুসলমানদের উচিত বিতর্কে না জড়িয়ে এ রাতে ক্ষমা পাওয়ার শর্তগুলো (অন্তরকে শিরক ও বিদ্বেষমুক্ত করা) পূরণ করা।
আর যদিও লাইলাতুল বারাআত বা শবেবরাত বলা ভুল নয় কিন্তু হাদিসে যেহেতু এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান’ বা মধ্য শা’বানের রাত হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে তাই আমরা যদি এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান’ বলি তাহলে একদিকে যেমন এ রাতের নামের ক্ষেত্রে সুন্নত পালন হয় অন্যদিকে বিতর্ককারীদের ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান’-এর কোনো অস্তিত্বই হাদিসে নেই এ কথাও বলার সুযোগ থাকে না।
কারণ হাদিসে ‘শবেবরাত’ বা ‘লাইলাতুল বারাআত’ নেই কিন্তু লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান তো আছে!
লেখক: খতিব বায়তুশ শফীক জামে মসজিদ গাজীপুর
-আরআর