সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ করলেও এর নেতিবাচক ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অনেকেই। বলা যায়, অনেকের ক্ষেত্রে তা পরিণত হচ্ছে আসক্তিতে। বিশেষ করে ইন্টারনেটে আসক্তি শিশুদের ক্ষতি করছে অনেক বেশি। এমতাবস্থায়, স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হলে নিয়ন্ত্রিত এবং সর্তকতার সাথে ইন্টারনেট ব্যবহারের বিকল্প নেই।
দৃষ্টান্ত হিসেবে বলছি- দুই বছরের শিশু মালিহা। মোবাইলফোন বা টিভি স্ক্রিনে চোখ রেখেই অনেক সময় কাটে তার। মালিহার মা ও বাবা দুজনেই কাজে ব্যস্ত থাকেন। ব্যস্ততার সময় মেয়েকে খুব সহজেই সামলানো যায় বলে মেয়ের হাতে প্রযুক্তির ফসল তুলে দেওয়া। কিন্তু এতে করে শিশুটির যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে!
আমরা সবাই আমাদের আগামী দিনগুলো উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত দেখতে চাই। কিন্তু শুধু চাইলেই তো হবে না। সেই চাওয়া অনুযায়ী কাজও করতে হবে। বলতে চাচ্ছি, সন্তানকে সুষ্ঠুভাবে লালন করতে হবে।
অবশ্য বর্তমানে যে প্রান্তে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে থেকে একটি শিশুকে সঠিকভাবে লালন-পালন করে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। কারণ বর্তমানে সুইচ টিপলেই গান বাজে, ছবি আসে, আলো জ্বলে, পাখা ঘোরে, নিমিষেই উড়া যায় আকাশ নীলে। আর এ সবই সম্ভব হচ্ছে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বদৌলতে।
ইন্টারনেট দৈনন্দিন জীবনটাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। এক কথায়, ক্লিক করলেই যেন হয়ে গেল। যে কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে, অবসর কাটাতে, প্রিয়জনের সঙ্গে আড্ডা কিংবা ভার্চুয়াল জগতের খোঁজ নিতে ইন্টারনেটের বিকল্প নেই।
একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে- আমরা অবসর যাপনের অনেকটা সময় ব্যয় করছি এই ইন্টারনেটের পেছনে, যার মারাত্মক কুফল হিসেবে দেখা দিয়েছে শিশুদের ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তি। এরা বিকালে মাঠে খেলতে যেতে পছন্দ করে না; প্রকৃতির সবুজ রঙ তাদের দৃষ্টি কাড়ে না। সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে বসে মোবাইল অথবা ট্যাব ব্যবহারে ব্যস্ত থাকে।
এতে করে বাচ্চাদের ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে আর দৃষ্টিশক্তি কমে যাচ্ছে, যা রীতিমতো চিন্তার বিষয়। এই বাচ্চারা কোনো অনুষ্ঠানে গেলেও তাদের চোখ স্থির থাকে মোবাইলে। একই রুমে বসে একজন অন্যজনের সঙ্গে কথা বলে না। কারণ একটাই- প্রযুক্তির ব্যবহার। ফলে তারা অনেকাংশেই অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে।
নিত্যনতুন তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাটা অবশ্যই ভালো, তবে তা যদি বাচ্চাদের অবসর যাপন অথবা খেলাধুলার একমাত্র সঙ্গী হয়, তবে তা কিন্তু চিন্তার বিষয় অবশ্যই। সময় থাকতেই এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে বাবা-মাকেই। কারণ ইন্টারনেটের আসক্তি খুবই ভয়াবহ। বলা যায়, অনেক সৌন্দর্যের মধ্যে থাকা কালো তিলের মতো!
শিশুর ইন্টারনেট আসক্তি কাটাতে হলে বাবা-মাকেই কিছু বিষয় খেয়াল করতে হবে। যেমন বাবা-মাই যদি সারাক্ষণ মোবাইলে চ্যাট করে অথবা সোসাল সাইটে ব্যস্ত থাকে, তাহলে বাচ্চাদের কাছে এটিকে স্বাভাবিক মনে হওয়াটাই কিন্তু স্বাভাবিক।
তাই সন্তানের নেশা কাটানোর জন্য বাবা-মার নিজেদেরই মোবাইল ব্যবহার কমাতে হবে। অন্তত বাচ্চাদের সামনে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মোবাইল বা ইন্টারনেট ব্যবহার না করাই ভালো।
বাচ্চাদের খেলা ও অবসর সময়ের পরিকল্পনাটি সঠিকভাবে করতে হবে। সামনে যদি খেলার মাঠ থাকে সেখানে বিকাল বেলা বাচ্চাকে খেলতে পাঠালে সে প্রকৃতির সান্নিধ্য পাবে এবং অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিশে তার সামাজিক দিকটাও উন্নত হবে। মূলকথা, মোবাইল ও ইন্টানেটের অপব্যবহার থেকে বাচ্চা দূরে থাকবে।
অবাক হতে হয় যখন দেখি-অনেক বাড়িতেই আজকাল ছোট্ট শিশুটিকে খাওয়ানোর মোক্ষম হাতিয়ার হচ্ছে মোবাইল। অর্থাৎ ইন্টারনেটে ভেসে আসা রংবেরংয়ের নাচগান, কার্টুন, ছড়া। পন্থাটা সহজ, কিন্তু সমস্যার বীজ কিন্তু রোপণ করা হয়ে গেল। বাচ্চা যতই বড় হবে তার আসক্তি ততই যে বাড়তে থাকবে। এই ইন্টারনেট ছাড়াও যে কতকিছু করার আছে, তা বাচ্চাদের বোঝাতে হবে।
রাতে ঘুমানোর আগে, গল্পের বই পড়ে শোনানো যেতে পারে এতে করে বাচ্চার বই পড়ার মতো ভালো অভ্যাস তৈরি হবে। ধর্মীয় জ্ঞানও বাচ্চাদের জন্য জরুরি ।
ছোট থেকেই বাচ্চাদের নিজ নিজ ধর্মীয় নিয়মগুলো শেখাতে হবে। আর এই সময়টুকু বাবা-মাকেও মোবাইল থেকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া দূরে থাকতে হবে। আর এসব মেনে চলতে পারলেই আজকের শিশুটিকে ভবিষ্যতের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
[email protected]
১৬ এপ্রিল ২০১৮